অগ্রন্থিত – গান ও আত্মস্মৃতি

অগ্রন্থিত – গান ও আত্মস্মৃতি – শাহ আবদুল করিম

নাও যেন গাঙে ডোবে না
ওরে মাঝি খবরদার
খবরদার হুঁশিয়ার
আছে ছয় ডাকাইতের অত্যাচার ॥

এই ভবের বাজারে আইলায়
হয়ে দোকানদার
কেউ হাসে কেউ কাঁদে
পাগলের বাজার রে ॥

নাম সম্বলে বাও রে তরী
থেকে হুশিয়ার
দিন যাইতেছে সামনে আছে
বিষম অন্ধকার রে ॥

বেলা গেল সন্ধ্যা হলো
দেয়ায় মারল ডাক
মধ্য গাঙে গিয়া মাঝির
নৌকায় মারল পাক রে ॥

সামিউন বাসির আল্লা
সব দেখে সব শোনে
যারে করিবে পার
মনে মনে জানে রে ॥

নৌকায় বসে আবদুল করিম
ভাবে মনে মনে
অকূল নদীর কূল কিনারা
পাব কত দিনে রে ॥

.

মন যদি হতে চাও মানুষ
মানুষকে ভিন বাসিও না
থাকিতে দোষ হয় না মানুষ
করে দেখো বিবেচনা ॥

অজু গোসল করি নিত্য
এতে হয় দেহ পবিত্র
মনের ময়লা না গেলে তো
মন পবিত্র হয় না ॥

মকরম ছিল এ জগতে
সৃষ্টির সেরা এক কালেতে
লান্নতের তক্ত গলেতে
মানুষকে করিয়া ঘৃণা ॥

মানুষ মানুষের বন্ধু হয়
সর্বশাস্ত্রে প্রমাণ রয়
পাগল আবদুল করিমে কয়
এই কথা ভুলিও না ॥

.

বন্ধু তুমি জীবনের জীবন
দয়া করে একবার মোরে
দাও তোমার রাঙা চরণ ॥

পুড়িয়া হইলাম সারা
তুমি বন্ধু দেও না ধরা রে
আমি তোমা হইয়া হারা
জল ছাড়া মীনের মতন ॥

নূতন যৌবনের জ্বালা
আর কত সহিব কালা রে
বাঁচন হইতে মরণ ভালা
যদি না হইল মিলন ॥

বাউল আবদুল করিম বলে
রেখ তোমার চরণ-তলে রে
তুমি বন্ধে ভিন্ন বাসলে
কে আছে আমার আপন ॥

.

পিরিত করে সুখ হইল না
যৌবন গেল বিফলে
দিনে দিনে বাড়ে ব্যথা
কলিজায় আগুন জ্বলে ॥

লাগল গো সই পিরিতের নেশা
একদিন তারে পাব বলে ছিল গো আশা
ঘটল আমার এ দুর্দশা
কাঁদি বসে নিরলে ॥

সখি তোরা জান নি কৌশল
কী দিয়া নিভাব আগুন বল গো তোরা বল
জল দিলে নিভে না অনল
পাব তারে কই গেলে ॥

যার লাগিয়া হইলাম কুলের বার
সে কেন গো প্রাণসজনী হইল না আমার
সে বিনে মোর জীবন অসার
ও এ করিম কেঁদে বলে ॥

.

প্রাণনাথ বন্ধু আমার
কই রইল গো
এ জীবনে ছাড়িবে না
কথা দিল গো ॥

কী সন্ধানে কাছে এল
কী করে যে কই লুকাইল গো
কী জাদু করিয়া আমায়
পাগল করল গো ॥

সে যদি ছাড়িয়া গেল
প্রাণ গেলেও হইত ভালো গো
সখি তোরা এখন আমার
উপায় বলে গো ॥

কী করিব কোথায় যাব
কই গেলে বন্ধুরে পাব গো
করিম বলে আশায় আশায়
জীবন গেল গো ॥

.

সে হইল গো নিষ্ঠুর কালিয়া
সোনার অঙ্গ পুড়ে আঙ্গার সই গো
হইল যার লাগিয়া গো ॥

আসবে বলে চলে গেল সই গো
না এল ফিরিয়া
শ্মশান ঘাটের পোড়ার মতন সই গো
গিয়াছে পুড়িয়া গো ॥

যে-দুঃখ অন্তরের মাঝে সই গো
রেখেছি চাপিয়া
বুক চিরে দেখাইবার হইলে সই গো
দেখাইতাম চিরিয়া গো ॥

যে দেশে প্রাণবন্ধু গেছে আমি
যাব গো চলিয়া
সবে মিলে দেও আমারে সই গো
যোগিনী সাজাইয়া গো ॥

বন্ধু যদি দেশে আসে তোরা
কইও গো বুঝাইয়া
তোমার আবদুল করিম গেছে সই গো
দেশান্তরী হইয়া গো ॥

.

পোড়া অঙ্গ পুড়িবার বাসনা রে
ও কোকিলা
পুড়তে পুড়তে সোনার অঙ্গ
হইয়া গেল কালা রে ॥

কোকিল রে তোর কুহু স্বরে
মনের আগুন দ্বিগুণ বাড়ে রে
কেমনে থাকিব ঘরে
অবলা সরলা রে ॥

পুড়তে পুড়তে হইলাম ছাই
আর তো পোড়ার বাকি নাই রে
কাঁদিয়া বসন ভিজাই
বসিয়া নিরালা রে ॥

বাউল আবদুল করিম বলে
দারুণ বসন্তকালে রে
এই দেশে তুই কেন আইলে
আমায় দিতে জ্বালা রে ॥

.

আর কি আশা পুরিবে আমার
দারুণ বিধি হইল বাদি
জানিয়াছি সারাসার ॥

আশা দিয়া প্রেম বাড়াইল
কী দোষে নিরাশ করিল গো
নয়নজলে বুক ভাসাইল
এই ছিল বাসনা তার ॥

সখি আমার উপায় বলো
প্রাণবন্ধুর তালাশে চলো গো
কী আগুন জ্বালাইয়া গেল
কলিজা হইল আঙ্গার ॥

আমি কুলের কলঙ্কিনী
শান্তি নাই দিন রজনী গো
বাকি আছে নিতে প্রাণী
আবদুল করিম পাগেলার ॥

.

সোনা বন্ধে মোরে করিল উদাসী
মনপ্রাণ কাড়িয়া নিল বন্ধে
দিয়া মধুর হাসি গো ॥

তার সনে পিরিতি করিয়া আমি
হইলাম কুল-বিনাশী
যে দিন হতে লইলাম গলে সই গো
দারুণ প্রেমের ফাঁসি গো ॥

অন্তরে পাইয়া দুঃখ আমি
কাঁদি দিবানিশি
মনপ্রাণ দিয়াছি যারে সে যে
হইল বিদেশী গো ॥

বাউল আবদুল করিম বলে
আমি হইমু সন্ন্যাসী
নইলে জলে ঝম্প দিমু
গলায় বান্ধিয়া কলসি গো ॥

.

১০

প্রেম রোগের ঔষধ নি গো সখি
এই দেশে কেউ জানে
আর কত পুড়িব আমি
জ্বলন্ত আগুনে গো সখি ॥

আহার না চায় গো মনে
নিদ্রা নাই নয়নে
পাগলিনীর মতো হয়ে
ঘুরি বনে বনে গো সখি ॥

কেউ যদি দরদি থাকো
দেও গো তারে এনে
পোড়া অঙ্গ জুড়াই একবার
দেখিয়া নয়নে গো সখি ॥

কাঁচা বাঁশের মধ্যে সই গো
ধরে যেমন ঘুণে
সেই মতো করিমের অন্তর
কাটে নিশিদিনে গো সখি ॥

.

১১

মর্ম না জানিয়া তোরা প্রেম করিও না
দারুণ পিরিতে ধরে কলিজাতে
জীবন থাকতে অনল নিভে না ॥

প্রেমের আছে একটা ওজন
জানে না যে জন
ঘটে তার বিড়ম্ভন সুখ হয় না
কালার প্রেমের রীতি
মজাইয়া কুল জাতি
শেষে হয় না সাথি, ঘটায় লাঞ্চনা ॥

আপন বলি যারে
শেল দিল আমারে
বিন্ধিল অন্তরে খুলতে পারি না
কপালে যা ছিল
তাহাই ঘটিল
নিজে দোষী আমি, কেউরে দুষি না ॥

পাগলিনীর প্রায়
ঘুরি সর্বদায়
প্রেমের ঔষধ কোথায় কেউ বলে না
আবদুল করিম বলে
শোনো সকলে
আমার মতো তোরা কেউ মরিও না ॥

.

১২

তোর সনে মোর ভাব রাখা দায়, সোনা বন্ধু রে
তোর সনে মোর ভাব রাখা দায় ॥

বন্ধু রে, তিলেক মাত্র না দেখিলে কলিজা জ্বলিয়া যায়
আমার দুই নয়নে বহে ধারা রে যেমন যমুনাতে ঢেউ খেলায় ॥

বন্ধু রে, পাড়া-পড়শি যত তারা কলঙ্ক নাম সদায় গায়
লোকের নিন্দন পুষ্পচন্দন রে যেমন অলংকার পরেছি গায় ॥

বন্ধু রে, বলে বলুক লোকে মন্দ ভাবি না তাহারই দায়
তুমি যদি দয়া কর রে বন্ধু স্থান দাও তোমায় রাঙা পায় ॥

বন্ধু রে, আমার বলতে আর কিছু নাই যা ছিল দিলাম তোমায়
পাইলে চরণ সফল জীবন রে বলে আবদুল করিম পাগেলায় ॥

.

১৩

মুর্শিদ বাবাজান
তোমার লাগি কান্দে মনপ্রাণ
তুমি না করিলে দয়া
দুই কুলে নাই পরিত্রাণ ॥

অন্তরের ভেদ জানো তুমি
অন্তর্যামী তোমার নাম
তুমি কি জান না মুনিব
কী করে তোমার গোলাম
তুমি যারে কর দয়া
কী করতে পারে শয়তান ॥

তুমি নামাজ তুমি রোজা
তোমায় ভাবি নিশিদিন
চাই না আমি স্বর্গ শান্তি
তুমি যদি বাসো ভিন
নয়নে দেখেছি যারে
লাগে না সাক্ষী প্রমাণ ॥

বাউল আবদুল করিম বলে
কুলমানে দিলাম ছাই
যা ইচ্ছা তা বলুক লোকে
তাতে আমার ক্ষতি নাই
তোমার কাছে এই ভিক্ষা চাই
চরনছায়া কর দান ॥

.

১৪

আরে ও সর্বহারার দল
ভয় কিরে আর বন্দুক কামান
একযোগে সব চল রে
সর্বহারার দল ॥

ভাই রে ভাই
অর্ধহারে অনাহারে হয়েছি দুর্বল
দিনে দিনে ধনেমানে
হইলাম রসাতল রে ॥

ভাই রে ভাই
যদি থাকি উপবাসী তবু বাই লাঙ্গল
দুঃখের উপরে দুঃখ
বন্যায় নেয় ফসল রে ॥

ভাই রে ভাই
স্বার্থভোগী শোষকদলে করেছে কৌশল
আমাদের প্রাণে মেরে
তাদের চায় মঙ্গল রে ॥

ভাই রে ভাই
ধর্মের ভাওতা দিয়া কত মাথায় ঢালে জল
শিকড় কাটা গাছে কি আর
ধরে কখন ফল রে ॥

ভাই রে ভাই
ধনে হীন মানে হীন শক্তিতে দুর্বল
একতা বিনে আমদের
কী আছে সম্বল রে ॥

ভাই রে ভাই
ভাঙো জালিমের শাসনশোষণ ভাঙো জালিমের বল
করিম বলে প্রতিজ্ঞা করো
দেশের হউক মঙ্গল রে ॥

.

১৫

সোনার বাংলার ঘরে ঘরে
সকলে মিলিয়া জয়বাংলা বলিয়া
আনন্দে হাসিয়া চলিয়া পড়ে ॥

পেয়ে স্বাধীনতা হাসে তরুলতা
বাঙালির মনোব্যথা গেল দূরে
অবিচার অনাচার এ দেশে চলবে না আর
ঘুচিল আঁধার একেবারে ॥

ন্যায্য দাবি আমাদের দল আসিল জল্লাদের
কত মা বইনের ইজ্জত মারে
যত দুঃখ দিলো কী বলিব বলো
দ্বিগুণ জ্বালাইল বাংলার মীরজাফরে ॥

মোল্লা-মুন্সি বাংলার ধর্মের দোকানদার
তাদের কথা চমৎকার মনে পড়ে
বাংলার দুর্দিনে নায়েবে রাসুলগণে
শত্রুর সমর্থনে অস্ত্র ধরে ॥

লুটের মাল পাইয়া লুটের গরু খাইয়া
লম্বা তসবি লইয়া খতম পড়ে
জালিম যাতে বেঁচে রয় জুলুম যাতে আরো হয়
এই বিষয় খোদার কাছে মোনাজাত করে ॥

খুন খারাবি লুটতরাজ জুলুমবাজি যত কাজ
এবার আলেম সমাজ অনেকে করে
মা বইনের ইজ্জত মারা কোলের শিশু হত্যা করা
এই কি ইসলামের ধারা দেখো বিচারে ॥

দালাল রাজাকার বদর মোজাহিদ আর
হয়ে গেল ছারখার একেবারে
বাঙালি হাসে–তারা মরে ত্রাসে
করিম কয় কর্মদোষে পড়িল ফেরে ॥

.

আত্মস্মৃতি

সুর তাল ছন্দে যখন গান গেয়ে যাই।
আমার জীবন কাহিনী ছন্দে লেখতে চাই ॥
আমার নাম আবদুল করিম উজান ধল ঠিকানা।
পোস্ট আফিস ধল বাজার দিরাই হলো থানা ॥
মহকুমা সুনামগঞ্জ সিলেট জেলা।
জন্ম আমার হাওরমাতৃক ভাটি এলাকায় ॥
মাতার নাম নাইওরজান বিবি লই পদধূলি ।
পিতার নাম মোহাম্মদ ইব্রাহীম আলী ॥
তেরোশো বাইশ বাংলায় জন্ম আমার ।
মা বলেছেন ফায়ুন মাসের প্রথম মঙ্গলবার ॥
গরিব কৃষক পরিবারে জন্ম নিলাম ।
পিতা-মাতার প্রথম সন্তান আমি ছিলাম ॥
পিতা-মাতা রেখেছিলেন আবদুল করিম নাম ।
জানি না কেন যে বিধি হলো বাম ॥
এই দুঃখ কার কাছে কী বলি বলো না ।
স্কুলে লেখাপড়া করা মোর হলো না ॥
সমাজ ব্যবস্থা আমার পক্ষে ছিল না ।
তাই তো আমার খবর কেউ যে নিল না ॥
এই ভাবে লক্ষ লক্ষ করিম জন্ম নিল ।
এই ব্যবস্থা তাদেরও নিঃস্ব করে দিল ॥
জন্ম নিয়ে একজনের সান্নিধ্য পাইলাম ।
পিতামহের ছোটো ভাই নসিব উল্লা নাম ॥
ফকির ছিলেন করতেন সদা আল্লার জিকির ।
ফকিরি বিনে ছিল না অন্য ফিকির ॥
সংসারে ছিল না কোনো মায়ার বাঁধন ।
জীবনে উদ্দেশ্য ছিল আত্মসাধন ॥
শান্তমতি ঊর্ধ্বগতি জ্ঞানী স্থির ধীর ।
অবিবাহিত ছিলেন ত্যাগী ফকির ॥
যৌবন শেষে বার্ধক্য আসিলে পরে ।
মুসাফিরি ছেড়ে তখন বসে পড়েন ঘরে ॥

এই সময় আমি জন্ম নিলাম ।
জন্ম নিয়ে দাদার কোলে স্থান পেয়েছিলাম ॥
সংসারের কাজে মা ব্যস্ত থাকতেন ।
দাদা আমায় আদর করে কোলে রাখতেন ॥
আসতেন তখন ফকির সাধু হিন্দু-মুসলমান ।
লাউ বাজিয়ে গাইতেন তারা ভক্তিমূলক গান ॥
তখন যে গানটি আমার মন আকৃষ্ট করে ।
ভুলি না সে গানটির কথা আজো মনে পড়ে ॥
গানের প্রথম কলি ছিল–’ভাবিয়া দেখ মনে ।
মাটির সারিন্দারে বাজায় কোন জনে’॥

আমার ছোটো বোন তারা হলো পাঁচজন।
সংসারে আসিল তখন অভাব অনটন ॥
সম্পদ বলতে অল্প কিছু বোরো জমি ছিল।
ঋণের দায়ে তাহা মহাজনে নিল ॥
গরিব হলে আপনজনে বাসে তখন ভিন।
ভরণ-পোষণে দুঃখ বাড়ে দিন দিন ॥
ভরণ-পোষণে তখন অক্ষম ছিলেন।
পিতা-মাতা আমাকে চাকরিতে দিলেন ॥
শিক্ষা নয় চাকরি করি পেটে নাই ভাত।
কী করে বেঁচে থাকা যায় ভাবি দিনরাত ॥
বাঁচার তাগিদে যখন চাকরিতে ছিলাম।
গরু মহিষ রাখালির দায়িত্ব নিলাম ॥
মালিকের চাকরি করি কাজে ব্যস্ত থাকি।
সারাদিন বন জঙ্গলে গরু মহিষ রাখি ॥
সতত পালন করি মালিকের কথা।
খেলাধুলার সময় নাই, নাই স্বাধীনতা ॥
রাখালির দায়িত্বভার সহজ বিষয় নয়।
ভোরবেলা গরু নিয়ে মাঠে যেতে হয় ॥
গরু নিয়ে বাড়ি ফিরি সূর্য অস্তের পরে।
যত্ন করে বেঁধে রাখি নিয়ে গোয়ালঘরে ॥
সকাল-বিকাল গাভি দোহনে সাহায্য তখন করি ।
একজনে গাভি দোহায় আমি বাছুর ধরি ॥
গরু নিয়ে প্রতিদিন হাওরে যাই।
ঈদের শুভদিনে ও আমার ছুটি নাই ॥

চাকরি করি গলে মোর দায়িত্বের ফাঁসি ।
রাত্র হলে পির দাদাকে দেখিতে আসি ॥
বার্ধক্যজনিত রোগে হলেন দুর্বল।
দাদার অবস্থা দেখে চোখে এল জল ॥
নিয়তির বিধানে তিনি ইন্তেকাল করলেন।
যাবার পূর্বে কাছে এনে মাকে বললেন ॥
ছেলে মেয়ে আপনজন কেউ ছিল না আর।
তুমি অনেক সেবা মাগো করেছো আমার ॥
মাত্র একটি ছেলে তোমার আর তো কিছু নাই।
যাবার কালে তার জন্য দোয়া করে যাই।
আল্লার রহমতে সে ভালো পথে যাবে।
সময়ে সৎ মানুষের ভালোবাসা পাবে ॥
আমি তখন গরু নিয়ে হাওরে ছিলাম।
মা যাহা বলিলেন তাহা শুনিয়া নিলাম ॥
দাদার সঙ্গে শেষ দেখার সময় ছিল না।
মনে ভাবি কী করিব বিধি তা দিল না ॥
জন্ম নিয়ে নিরাশার আঁধারে পড়েছি।
অর্ধাহার আনাহার কত করেছি ॥
দেখেছি এই বিপন্ন অবস্থায় পড়ে।
মানুষ মানুষকে কত অবহেলা করে ॥
বঞ্চিত লাঞ্চিত অবহেলিত যারা।
কী ভাবে যে জীবন ধারণ করিতেছে তারা ॥
আজো ভাবি এমন দিন কবে আসিবে?
মানুষ যে-দিন মানুষকে ভালোবাসিবে ॥

.

ধল গ্রামে প্রথম যখন হলো ধলবাজার।
বিভিন্ন ব্যবসা নিয়ে এলেন দোকানদার ॥
যার যাহা ভালো হয় বুঝে তারা নিল।
ভুশিমালের দোকান এক মহাজনের ছিল ॥
বর্ষাতে একেবারে বেকার ছিলাম ।
মহাজনের দোকানে চাকরি নিলাম ॥
চাকরির বিনিময়ে যে বেতন নিতাম।
তা নিয়ে পিতামাতার কাছে দিতাম ॥
তখন ব্রিটিশ শাসন এই দেশে ছিল।
বড়দের শিক্ষার জন্য রাত্রে স্কুল দিল ॥
তৈমুর চৌধুরী তখন মাস্টারি নিলেন।
নিরক্ষর সবাইকে জানিয়ে দিলেন ॥
সুযোগ পেয়ে আমি সেই স্কুলে ভর্তি হই।
বিনা মূল্যে দিল একটি বড়দের বই ॥
পরে শুনি এই স্কুলে শিক্ষা যারা পাবে।
নাম দস্তখত শিক্ষার পরে যুদ্ধে নিয়ে যাবে ॥
এই মিথ্যা গুজব-বাণী গ্রামে যখন এল।
পড়িতে কেউ আসে না আর স্কুল বন্ধ হলো ॥
বড়দের বই আমার হয়ে গেল সাথি।
প্রয়োজন আছে তাই পড়ি দিবা রাতি ॥
অক্ষরজ্ঞান আমার হলো তাড়াতাড়ি।
পুথি পুস্তক তখন পড়তে আমি পারি ॥
জানার জন্য বিভিন্ন বইপুস্তক পড়ি।
গান গাই আর উপস্থিত রচনা করি ॥
একতারা নিয়ে আমার একা গান গাই।
এক মনে চেষ্টা করি বাউল হতে চাই ॥
রাত্রে খাওয়ার পরে সময় যখন পাই।
উস্তাদ করম উদ্দিনের কাছে তখন যাই ॥
সঙ্গীতপ্রিয় লোক ছিলেন জ্ঞানে মহান।
দোতারা বাজিয়ে গাইতেন ভক্তিমূলক গান ॥
প্রতিদিন উস্তাদের সঙ্গ করতে পারি।
উস্তাদের বাড়ির পাশে ছিল আমার বাড়ি ॥
আসদ্দর আলী হলেন উস্তাদের পুত্র।
তিনিও ধরলেন এই বাউল গানের সূত্র ॥
ঈদ এসেছে ঈদের দিন বাড়িতে ছিলাম ।
জামাতে যাইতে সবার সঙ্গ নিলাম ॥
গ্রামের দুই এক মুরব্বি মোল্লাগণ সাথে ।
ধর্মীয় আক্রমণ এল ঈদের জামাতে ॥
জামাত আরম্ভের পূর্বে মুরব্বি একজন।
ইমাম সাহেবকে জিজ্ঞাস করলেন তখন ॥
জানতে চাইলেন, গান গাওয়া পারে কি পারে না।
ইমাম বললেন, গান গাওয়া আল্লা-নবির মানা ॥
মুরব্বি বললেন, তবে জিজ্ঞাস করো তারে।
গান সে ছাড়বে কিনা বলুক সত্য করে ॥
ইমাম বললেন, কিতা জি বাঁচতে এখনো পার ।
তওবা করে বেশরা বেদাতি কাম ছাড়ো ॥
সবার কাছে প্রথম বলো আমি এসব করব না।
আমি বললাম, সত্য বলি গান আমি ছাড়ব না ॥
মুরব্বি বললেন, দেখ কী করা যায় তারে।
সবার সামনে এই কথা বলতে কি সে পারে?
যাই করুক এখন বলা উচিত ছিল তার।
এই সমস্ত কর্ম আমি করিব না আর ॥
আমি বললাম, এসেছি আজ জামাত পড়িতে।
ইচ্ছা নয় মিথ্যা কোনো কথা বলিতে ॥
ছাড়তে পারব না আমি নিজে যখন জানি।
উপদেশ দিলে বলেন কী করে তা মানি ॥
পরে করিব যাহা এখন বলি করবো না।
সভাতে এই মিথ্যা কথা বলতে পারব না ॥
এই সময় অন্য এক মুরব্বি বললেন।
আপনারা এখন কোন পথে চললেন ॥
এই আলাপ ঘরে বসে পারি করিতে।
এখন এসেছি ঈদের নামাজ পড়িতে ॥
এক গ্রামে বাস করি হিন্দু-মুসলমান।
কে না গেয়েছি বলেন জারি সারি গান ॥
একতারা দিয়ে গায় একা গান তার ।
ঈদের জামাতে কেন এই গানের বিচার?
এই আলোচনা এখন বন্ধ করেন।
নামাজ পড়তে এসেছি নামাজ পড়েন ॥
মুরব্বি হতে এই কথা যখন এলো।
এই বিষয় এখানেই শেষ হয়ে গেল ॥
জামাত শেষ হলে পরে আসিলাম বাড়িতে।
কী করিব গান যে আমি পারি না ছাড়িতে ॥
মনে ভাবি দয়াল যাহা করেন আমারে।
আমার নৌকা ছেড়ে দিলাম অকূল পাথারে ॥

.

মুর্শিদি ভক্তিমূলক বাউল জারি সারি ।
গান গাই রচনা করতে তখন পারি ॥
আমাদের গ্রামে আসলেন বাউল একজন।
গান শুনে আকৃষ্ট হলেন গ্রামবাসীগণ ॥
ভালোবেসে বাউলকে কেউ চায় না ছাড়িতে।
আসর হলো ধলআশ্রম চৌধুরী বাড়িতে ॥
প্রতিদ্বন্দ্বী বাউল ছিলেন মান উল্লা নাম।
ছাতক থানায় বাড়ি আছিনপুর গ্রাম ॥
প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বুঝে নিলাম ফল ।
ভাব দিয়ে গাইতে পারেন রচনায় দুর্বল ॥
পরে আরও দুই বাউলের হলো আগমন।
ভাটিপাড়ার কামাল উদ্দিন, সঙ্গে আরেকজন ॥
গ্রামের সবাই আমাকে খবর করে নিলেন।
গ্রামের মোড়ল-বাড়িতে আসর করে দিলেন ॥
দুইজনের সঙ্গে তখন দুই রাত্র গাইলাম।
আসরে মোটামুটি আনন্দ পাইলাম ॥
বাউল কামালের গান ভালো গেল শোনা।
দ্বিতীয়জনের বাড়ি ছিল নেত্রকোনা ॥
ভক্তিমূলক মনোভাব সেই লোকটির ছিল।
উস্তাদ তার রশিদ উদ্দিন পরিচয় দিল ॥
এই নাম পূর্ব থেকেই ছিল আমার জানা।
বাউল সাধক রশিদ উদ্দিন বাড়ি নেত্রকোনা ॥
রশিদ উদ্দিনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলাম।
দেখা করিতে মনে উদ্যোগ নিলাম ॥
নেত্রকোনার অন্তর্গত বাইশ চাপরা গ্রাম।
এই গ্রামে জন্ম সাধক রশিদ উদ্দিন নাম ॥
দেখা পেয়ে আনন্দে বিভোর হইলাম ।
 শ্রদ্ধাভরে উস্তাদের বাড়িতে রইলাম ॥
তিনিও ভালোবেসে আমাকে ছাড়েন না।
বার্ধক্য এসেছে গান গাইতে পারেন না ॥
বিভিন্ন আলোচনা করেন যখন বসে।
ভক্তগণ শান্তি পায় শান্ত মধুর রসে ॥
আশীর্বাদ পাইতে পদে আশ্রয় নিলাম।
উস্তাদের কাছে মাত্র পাঁচদিন ছিলাম ॥
উস্তাদ বললেন, চেষ্টা কর নিয়ে ভালোবাসা।
আশীর্বাদ করি তোমার পূর্ণ হবে আশা ॥
উস্তাদের কাছ থেকে বিদায় নিলাম।
ময়মনসিংহ ভ্রমণে চারমাস ছিলাম ॥
ময়মনসিংহে বাউল তখন ছিল বিস্তর।
রাত্রে নয় দিনের বেলা বসিত আসর ॥
এই পরিবেশে তখন মিশে পড়লাম।
বিভিন্ন গানের আসরে যোগদান করলাম ॥
তৈয়ব আলী, মিরাজ আলী, আবদুস সাত্তার।
খেলু মিয়া, দুলু মিয়া, মজিদ তালুকদার ॥
নীলগঞ্জের ফজলুর রহমান, আবেদ, আলাল।
উহাদের পূর্বসূরি রশিদ-জালাল ॥
বেশ কয়েকটা আসরে গান তখন গাইলাম।
ভাবের সাগর উকিল মুন্সির দেখা পাইলাম ॥
থানা জামালগঞ্জ লক্ষ্মীপুর গ্রামেতে।
আসর হলো উকিল মুন্সি সাহেবের সাথে ॥
ময়মনসিংহ জেলাতে বাউল যারা ছিল।
তারা আমায় ভালোবেসে কাছে টেনে নিল ॥
বাউলগণ বাউল গান গায় পঞ্চরসে।
গ্রাম গঞ্জে প্রচুর গানের আসর বসে ॥
আজমিরীগঞ্জে আসর গাওয়ার দায়িত্ব নিলাম ।
আমি এবং আবদুস সাত্তার প্রথম ছিলাম ॥
পরে আসলেন নীলগঞ্জের ফজলুর রহমান।
আসলেন উস্তাদ রশিদ উদ্দিন অতি গুণবান ॥
রশিদ উদ্দিন আজমিরীগজ্ঞে আসিলেন যখন।
নিজে কোনো গান বাদ্য করেন না তখন ॥
ফজলুর রহমানের উস্তাদ রশিদ উদ্দিন।
আমাকেও শিষ্য বললেন, জেনে দীনহীন ॥
তখন আজমিরীগঞ্জে সাত দিন ছিলেন।
আমাদেরে অনেক উপদেশ দিলেন ॥
উস্তাদ বলে মান্য করি আশীর্বাদ চাই।
রশিদ উদ্দিন আজ এই পৃথিবীতে নাই ॥
বাউলগণ বাউল গানে নূতন রূপ দিল।
এলাকার জনগণ তা গ্রহণ করে নিল ॥
যে কোনো এক বিষয়কে সামনে তুলে ধরে।
গাইতে হয় দুই জনে প্রশ্ন উত্তর করে ॥
বাউল প্রতিযোগিতা কবিগানের ধারা।
এলাকার জনগণ নাম দিল মালজোড়া ॥
 বাউলগণ রঙ্গ রসে গায় বাউল গান।
শুনতে আসে ধনী-গরিব হিন্দু-মুসলমান ॥
কথাপ্রধান বাউল গান বুঝতে সবাই পারে।
প্রাণ খুলে গায় যেজনে ভালোবাসে তারে ॥
দেখা গেল বাউল গান সবাই আদর করে।
আসর হয় গ্রাম-গঞ্জ শহর ও বন্দরে ॥
সময়ে যখন ঢাকা শহরে যাইতাম।
খালেক আর রজব দেওয়ানের দেখা পাইতাম ॥
এই সমস্ত বাউলদের সঙ্গে গান গেয়েছি।
মানুষের ভালোবাসা আনন্দ পেয়েছি ॥
ছিল না টাকা নিয়ে দর কষাকষি।
টাকা নয় ভালোবাসা পেয়েছি বেশি ॥

.

গানের আসরে যখন গান গাইতে যাই।
অনেক মহাজনের গান তখন গাই ॥
সকল মহাজনের গানে একই কথা বলে।
পির মুর্শিদ ভজিতে হয় আপন জানতে হলে ॥
কামেল মুর্শিদের সঙ্গ করা দরকার।
গুরু ব্যক্তি কেমন হবে ভেদ জানি না তার ॥
একদিন বসিলাম এক মহাজনের কাছে।
জিজ্ঞাস করলাম, আমার মুর্শিদ কোথায় আছে ॥
তিনি বললেন, পূর্বে নিজের মন ঠিক করে লও।
পরে এই মহান কাজে ব্রতী হও ॥
বলিলেন পাবে তারে সে নহে তো দূরে।
আশিক হয়ে খুঁজলে মিলে আছে মাশুকপুরে ॥
ঘুরিতে ঘুরিতে মন যথায় গিয়ে রয়।
তথায় তোমার প্রাপ্য বস্তু জানিও নিশ্চয় ॥
শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি তিনি সালাম করলাম ।
পরে আমি আমার রাস্তা ধরলাম ॥
মহাজনের কথা শুনে ভরসা নিলাম।
একদিন পাব বলে আশায় ছিলাম ॥
গ্রাম গঞ্জে ঘুরে সদা বাউল গান গাই।
পির ফকির আউলিয়াদের সমাবেশে যাই ॥
সৈয়দ শাহনুরের বালক কুরফান আলী ছিল।
শাহনুরের ছুরির নিচে গলা পেতে দিল ॥
শাহ কুরফান আলীর বালক ইমান আলী নাম।
সুনামগঞ্জের অন্তর্গত মুক্তাখাই গ্রাম ॥
এই গ্রামে ইমান আলী ফকিরের মাজার।
উরস হয় ফারুন মাসের প্রথম সোমবার ॥
মনে জেনে এই উরসে অংশ নিলাম।
বাউল আসকর আলী এবং আমি ছিলাম ॥
সারা রাত্র দুই জনে গান সেদিন গাইলাম।
এই উৎসবে একজনের দেখা পাইলাম ॥
উকারগাঁও জন্মস্থান মৌলা বক্স নাম।
দেখা পেয়ে পূর্ণ হইল মনস্কাম ॥
মৌলা বক্স মুন্সি একজন আলেম ছিলেন ।
সুফি মতবাদে পূর্ণ বিশ্বাস নিলেন ॥
মুন্সি সাহেবের মুর্শিদ আব্বাস কুারি নাম।
সুনামগঞ্জের নিকটে সাধকপুর গ্রাম ॥
সাধকপুর কৃারি সাহেবের মাজার হয়েছে।
এই গ্রামে কারি সাহেবের বংশধর রয়েছে ॥
ক্বারি সাহেবের কথা শুনতে যাহা পাই।
বর্তমান ইতিহাসে লিখা তাহা নাই ॥
ক্বারী সাহেবের যারা শিষ্যত্ব নিলেন।
এর মধ্যে অনেকেই আলেম ছিলেন ॥
উরস হয় নির্দিষ্ট তারিখ আছে তার।
ফাল্গুন মাসের প্রথম বৃহস্পতিবার ॥
ক্বারি সাহেব মহাসাধক ছিলেন।
মৌলা বক্স মুন্সি সাহেব শিষ্যত্ব নিলেন ॥
মুন্সি সাহেবকে দেখে ভাবনায় পড়লাম।
মুর্শিদ ভজিতে মনে সিদ্ধান্ত করলাম ॥
তখন আবার আপন মনে করি এই বিচার।
পিতা-মাতার হুকুম নেওয়া আমার দরকার ॥
মনের কথা কই না কারে মনে মনে আছে।
বাড়িতে আসিলাম আমার পিতামাতার কাছে ॥
পিতা মাতার আদেশ নিতে সমস্যায় পড়লাম।
রাত্রে নীরবে মাকে জিজ্ঞাসা করলাম ॥
বললাম, মাগো আমি মুর্শিদ ভজতে চাই।
ভালো কাজ এতে কোনো সন্দেহ যে নাই ॥
আলেম কামেল ব্যক্তি বৃত্তজ্ঞানী লোক।
সুফিবাদে বিশ্বাসী পরম ভাবুক ॥
মা বললেন, তুমি আমার একমাত্র ছেলে।
মুর্শিদ ভজিতে হয় বয়স প্রাপ্ত হলে ॥
এখন মুর্শিদ ভজিতে কে বললেন তোমায়।
মুর্শিদ ভজলে মানুষ নাকি পাগল হয়ে যায় ॥
আমি বললাম, একটি কথা আমার মনে পড়ে।
যে যার সঙ্গ করে সে তার বর্ণ ধরে ॥
এই মানুষের সঙ্গ করে হব না বেহুশ।
ভোগী নয় ত্যাগী এই মহাপুরুষ ॥
মা বললেন, তুমি যদি ভালো মনে কর ।
তোমার পিতার আদেশ নিয়ে এই রাস্তা ধর ॥
আমি বললাম, মাগো আমি পিতাকে ভয় পাই।
আদেশ নিয়ে দাও গো মা আমি যাহা চাই ॥
মনে ভাবনা ছিল কী হইবে পাছে।
মা আমার প্রস্তাব নিয়ে গেলেন পিতার কাছে ॥
এখানেই ভয় ছিল পিতা কি বলেন।
স্থির ধীর ভাবে মা উপস্থিত হলেন ॥
মা যাহা জিজ্ঞাসা করেন শুনে নিলাম।
আমি মায়ের কাছে আড়ালে ছিলাম ॥
মা বললেন, ছেলে আপনার আদেশ নিতে চায়।
সে আপনার কাছে বলতে ভয় পায় ॥
একজন কামেল লোক তার চোখে পড়েছে।
মুর্শিদ ভজিবে মনে আশা করেছে ॥
আলেম কামেল ব্যক্তি অতি প্রাচীন লোক।
শ্রদ্ধার পাত্র তিনি পরম ভাবুক ॥
পিতা বললেন, জানি আমি সে এসব বলিবে।
পির চাচা নসিব উল্লার মতে সে চলিবে ॥
ভালো কাজে চলে যদি ভালো বিবেচনায় ।
উদ্দেশ্য সৎ হলে আল্লাহ তার সহায় ॥
পিতা-মাতা অনুমতি দিলেন যখন।
আমার অন্তরে শান্তি আসিল তখন ॥
মনে ভাবি দয়াল আমার সহায় ছিলেন।
পিতা-মাতা ভালো মনে বিদায় দিলেন ॥
পিতা-মাতার চরণ ধুলি মস্তকে লইলাম।
পরের দিন ভোরবেলা রওয়ানা হইলাম ॥
পনেরো মাইল দূরে হইল মুর্শিদের বাড়ি।
মনে চায় যত শীঘ্র যাইতে আমি পারি ॥
মুর্শিদের বাড়িতে গিয়ে খোঁজ নিলাম।
মুক্তাখাই গ্রামে আছেন খবর পাইলাম ॥
সেখানে গেলাম আপন কর্ম সারিতে।
দেখা হলো মুবারক শাহ ফকিরের বাড়িতে ॥
মুর্শিদের সঙ্গে দেখা হইল যখন।
বাউল আসকর আলী ছিলেন তখন ॥
এই রাত্র মুবারক শাহর বাড়িতে রইলাম।
আমি এবং আসকর আলী মুরিদ হইলাম ॥
মুর্শিদ ভজিতে মনে বড় আশা ছিল।
মুর্শিদ আমায় দয়া করে কোলে তুলে নিল ॥
মুর্শিদের কাছে যখন মুরিদ হইলাম।
কয়েক দিন মুর্শিদের কাছে রইলাম ॥
মুর্শিদের ভক্তবৃন্দ অনেকেই ছিল।
সবাই আমায় ভালোবেসে কাছে স্থান দিল ॥

.

তখন সুনামগঞ্জে বহু গান গেয়েছি।
মানুষের ভালোবাসা আনন্দ পেয়েছি ॥
সুনামগঞ্জবাসী গানকে ভালোবাসতেন।
নানা স্থানের বাউলগণ তখন আসতেন ॥
দুর্বিন শাহ-কামাল উদ্দিন-আবদুস সাত্তার।
বারেক মিয়া-অমিয় ঠাকুর-আসকর আলী মাস্টার ॥
আসর হলে নিমন্ত্রণ আমিও পাইতাম।
প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে গান তখন গাইতাম ॥
ছোটো একটি বই ছাপার উদ্যোগ নিলাম।
সুনামগঞ্জের রায় প্রেসে বই ছাপতে দিলাম ॥
‘আফতাব সঙ্গীত ছিল বইখানার নাম।
আবদুল করিমের গান বারো আনা দাম ॥
বই ছাপা করে গেলাম মুর্শিদের কাছে।
মুর্শিদ বললেন, তোমার সঙ্গে আলোচনা আছে ॥
মনে যে দুর্বলতা বিবাহ করবে না।
বিয়ে করে সংসারের ফাঁদে পড়বে না ॥
তুমি তোমার পিতামাতার একমাত্র ছেলে।
সর্বদা ভ্রমণে থাক তাহাদের ফেলে ॥
এই অবস্থায় বল তুমি কতদিন রবে।
পিতামাতার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করতে হবে ॥
এখন এক অন্য পরিবেশে পড়িবে।
কিছুদিনের মধ্যেই তুমি বিবাহ করিবে ॥
নিয়তির বিধানে তোমাকে যাহা দিবে।
মনানন্দে তুমি তাহা গ্রহণ করে নিবে ॥
মুর্শিদের কথা শুনে নীরব রইলাম।
পরের দিন বাড়ির পথে রওয়ানা হইলাম ॥
রাস্তার পাশে বাড়ি এক ধর্ম-মেয়ে ছিল।
দেখা পেয়ে প্রায় জোর করে তার বাড়িতে নিল ॥
কী করা যায় সেই দিন সেখানে রইলাম।
ধর্ম-মেয়ের বাড়িতে মুসাফির হইলাম ॥
ধর্ম-মেয়ের পড়শি এক গরিব কৃষক ছিল।
এই ভদ্রলোক আমাকে দাওয়াত করে নিল ॥
পরে জানিলাম তত্ত্ব বহুদিন ধরে।
আমার মুর্শিদকে তারা শ্রদ্ধা ভক্তি করে ॥
এদের ব্যবহারে মন আকৃষ্ট করিল।
তাদের এক মেয়ে আমার চোখে পড়িল ॥
দেখা মাত্র কী যেন এক অবস্থায় পড়লাম।
আপন মনে অনেক বিচার করলাম ॥
স্বামী স্ত্রী দুইজন তারা ছেলে মেয়ে আছে।
সম্পদ বলতে কিছুই নাই দুঃখে কষ্টে বাঁচে ॥
এক মেয়ে উপযুক্ত প্রায় বিবাহের সময়।
অর্থ সম্পদ না থাকাতে মনে বড় ভয় ॥
সুস্থির মতিগতি সরল শান্ত মন।
গরিবের কুঁড়েঘরে রয়েছে এই ধন ॥
মুর্শিদ আমায় হুকুম করলেন বিবাহ করিতে।
দায়িত্ব মোর অচেনা এক পাখি ধরিতে ॥
সিদ্ধান্ত নিলাম অনেক চিন্তা ভাবনার পরে।
এই মানুষকে নিব চিরসঙ্গিনী করে ॥
পরের দিন বাড়ির পথে যখন চললাম।
ধর্ম-মেয়েকে ডেকে তখন বললাম :
আমার মনের কথা গো মা তোমাকে জানাই।
এই গরিব কৃষকের মেয়েকে আমি চাই ॥
এই কথাটি গো মা তোমাকে যাই বলে।
আমি কিছু জানি না কী হইবে ফলে ॥
ধর্ম-মেয়ে আমার কথায় গুরুত্ব দিল ।
সূক্ষ্ম মনে এই বিষয়ে পদক্ষেপ নিল ॥
মেয়ের পিতার সঙ্গে আলোচনা করে।
একমত হইল যে বহু চেষ্টার পরে ॥
মেয়ের পিতামাতা কথা যখন দিল।
ধর্ম-মেয়ে পরে অন্য ব্যবস্থা নিল ॥
মুর্শিদ সাহেবকে মেয়ে দাওয়াত করিল।
শক্ত করে মুর্শিদের চরণে ধরিল ॥
মেয়ে বলল সেবা করার ক্ষমতা মোর নাই।
তবুও যে আপনার চরণধুলা চাই ॥
অদ্য না হয় বলেন কবে যাইতে পারেন।
কথা দেন নইলে আমাকে প্রাণে মারেন ॥
কবে আসিবেন মুর্শিদ এই কথা যখন পাইল।
তখন আমার পিতাকেও আনিতে চাইল ॥
পিতা এবং মুর্শিদ সাহেব কথা দিলেন।
তারিখ অনুযায়ী তারা উপস্থিত ছিলেন ॥
গ্রামের মুরব্বি খানাপিনার পরে।
মেয়ে তখন তার কথা তুলে ধরে ॥
শাহ আবদুল করিম ধর্ম-পিতা আমার ।
এই দেখেন এক গরিব লোক নাই খেতখামার ॥
ওনার এক মেয়ে আছে শান্ত-শিষ্ট অতি।
দেখিতে সুশ্রী এবং অতি বুদ্ধিমতী ॥
তখন মেয়েকে এনে সামনে ধরিল।
মেয়ে মুরুব্বিদের সালাম করিল ॥
ধর্ম-মেয়ে বলল, আমার আবেদন জানাই।
এই মেয়েকে আমার পিতার জন্য চাই ॥
এই হলো আমার আশা অন্য কিছু নয়।
পির সাহেব বলিলেই আমার আশা পূর্ণ হয় ॥
মুর্শিদ বললেন, সৎকর্ম উদ্দেশ্য যখন সৎ।
এই বিষয়ে তোমার সঙ্গে আমি একমত ॥
পিতা বললেন, পির সাহেব বলিলেন যাহা।
আমিও শ্রদ্ধাভরে মেনে নিলাম তাহা ॥
এখন সম্পূর্ণ কথা শেষ হয়ে রবে।
সময় সাপেক্ষে কাজ সম্পন্ন হবে ॥
ধর্ম-মেয়ে বলল, আমার অন্য কথা নাই।
আমি শুধু আপনাদের আশীর্বাদ চাই ॥
আমি আপনাদের কোনো দাযিত না দিয়া।
আমি আমার পিতাকে করাইব বিয়া ॥
পারি যদি দশ টাকায় কর্ম সারিব।
পারি যদি দশ হাজার খরচ করিব ॥
এরপরে বিবাহের দিন ধার্য হলো।
মুর্শিদ বললেন, সবে এখন আলহামদু বলো ॥
মনানন্দে সবাই তখন আলহামদু বললেন।
শুভ মিলনের জন্য মুনাজাত করলেন ॥
মুর্শিদ যে দিন ধার্য করেছিলেন।
সময়ে কাজ সম্পন্ন করে দিলেন ॥
গরিব কৃষকের মেয়ে কুঁড়েঘরে ছিল।
জীবন সঙ্গিনী রূপে এসে যোগ দিল ॥
সরল শান্ত শুদ্ধমতি সে হলো সুজন।
অশান্ত চঞ্চল আমি হলেম অভাজন ॥
সৎচরিত্র মন পবিত্র ছিল তার গুণ।
সরল বলেই নাম হলো তার সরলা খাতুন ॥
সরলা হতে যে সাহায্য পেয়েছি।
সরলার কাছে আমি ঋণী রয়েছি ॥
খাঁটি মা হবার গুণ সরলার ছিল।
মা বলে কত ছেলে চরণধুলা নিল ॥
সৎসঙ্গ স্বর্গবাস শুনি লোকে বলে।
মাতৃমঙ্গল পরশমণি ভাগ্যে যদি মিলে ॥
গরিব কৃষক হলেন আবদুর রহমান নাম ।
সুনামগঞ্জের অন্তর্গত আসামমুড়া গ্রাম ॥
পিতামাতা আছেন আর বিবাহ করলাম ।
তখন এক অসহায় অবস্থায় পড়লাম ॥
দায়িত্বভার পূর্ব থেকেই মাথায় নিয়েছি।
বোন ছিলেন পাঁচজন বিবাহ দিয়েছি ॥
সম্পদ বলতে কিছুই নাই আমি শুধু আছি ।
প্রধান ভাবনা হলো কী করে যে বাঁচি ॥
বেঁচে থাকতে হলে যে খাওয়ার দরকার।
রোগ হলে প্রয়োজন সুচিকিৎসার ॥
বাসস্থান প্রয়োজন থাকতে যখন হবে।
শিক্ষা বিনে মানুষ কি পশু হয়ে রবে? ॥
বাঁচতে হলে যে নিরাপত্তা দরকার।
মনে ভাবি আমি এখন কী করিব আর ॥
অন্য কোনো উপায় নাই গাই শুধু গান।
জীবন নদীতে নৌকা বাইতে হয় উজান ॥
ভ্রমণে থাকি সদা আমি নহি স্থির।
মনোকষ্টে সরলার চোখে ঝরে নীর ॥
সরলা বলেন একদিন, কী অবস্থায় চলি।
অন্তরে ব্যথা হয় কার কাছে কী বলি ॥
বৎসরে এগারো মাস তোমায় ছাড়া থাকি।
নিরাশার আঁধারে পড়ে কাঁদে প্রাণ পাখি ॥
অনাহারে থাকি যেদিন অন্য উপায় নাই।
তখন শুধু তোমার আশায় পন্থপানে চাই ॥
সরলা শান্তিতে ছিলেন পিতামাতার ধারে।
আশা দিয়ে এনে আমি দুঃখ দিলাম তারে ॥
পিতামাতা আমার আশায় চেয়ে থাকেন।
আমার মঙ্গল কামনায় খোদাকে ডাকেন ॥
কে সরলা কে করিম কেন যে কী করি।
অষ্টপাশে বাধা আছি কখন জানি মরি ॥
এই সমস্ত দুঃখের ছবি মনে যখন ভাসে।
অন্তরে অনুতাপ হয় চোখে জল আসে ॥

.

জীবনে কত আশার স্বপ্ন দেখলাম।
আশায় নেশায় পড়ে কত গান লেখলাম ॥
গানের আসরে যখন গান গাইতে যাই।
মধ্যে মধ্যে গরিবের দুঃখের গান গাই ॥
কার কাছে কী বলিব মনে এল ভয়।
তখন ছিল মুসলিম লীগের লুটপাটের সময় ॥
মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে ভূমিকা নিলাম।
শোষক বিরোধী গানে সুর তখন দিলাম ॥
বিশ্বাস করে রাজনীতিতে মিশে পড়লাম ।
আওয়ামী লীগে তখন যোগদান করলাম ॥
সংগঠনে সাংস্কৃতিক সম্পাদক ছিলাম।
সুনামগঞ্জে কর্মীদের সঙ্গে নাম দিলাম ॥
স্বার্থ নিয়ে দ্বন্দ্ব করে বিশ্বের ঘরে ঘরে।
রোজই খবরে শুনি কত মানুষ মরে ॥
কেহ শোষক আর কেহ বা শোষিত।
এই নিয়ে পরিবেশ হয়েছে দূষিত ॥
মেহনতি সবাই তারা করে উৎপাদন।
শোষক চায় শোষণ করে উন্নতি সাধন ॥
শোষকের মনে কোনো দয়া মায়া নাই।
শোষিতগণ করে তাদের বাঁচার লড়াই ॥
ব্রিটিশ শাসনে দেশ ছিল যখন।
স্বদেশী আন্দোলন দেশে আসিল তখন ॥
কৃষক মজুর মেহনতি মানুষ ছিল যারা।
শান্তির আশায় আন্দোলনে যোগ দিল তারা ॥
দুঃখে গড়া জীবন আমার দুঃখে কষ্টে চলে ।
একদিন শুনি ছাত্রগণ বন্দে মাতরম বলে ॥
একজনকে জিজ্ঞাসা করলাম তখন।
কী বলে কী করতে চায় এই ছাত্রগণ ॥
বুঝাইয়া বললেন তিনি জিজ্ঞাস করার পরে।
আমাদের দেশে বিদেশীরা শাসন শোষণ করে ॥
পরাধীন হয়ে দেশে বেঁচে থাকা দায়।
দেশের জনগণ এখন স্বাধীনতা চায় ॥
স্বাধীন হলে অন্যায় অবিচার হবে না।
দুঃখী মানুষের কোনো দুঃখ রবে না ॥
দুঃখীর দুঃখ রবে না যখন শুনলাম ।
তখন মনে এক আশার জাল বুনলাম ॥
বিশ্বাস নিলাম স্বাধীন হলে দুঃখ রবে না।
আমরারও দুঃখ কষ্ট সইতে হবে না ॥
স্বাধীনতা পাব মনে আশা নিলাম।
পরে কী ঘটিল তাহা অজ্ঞাত ছিলাম ॥
অন্য কিছু নয় বুঝি আমি মুসলমান।
উঠিল এক অগ্নিবাণী লড়কে লেংগে পাকিস্তান ॥
কাটাকাটি লুটালুটির খবর পেয়েছি।
এই সমস্ত ভিত্তি করে কত গান গেয়েছি।
শোষকগণ মানুষকে কুমন্ত্রণা দিল ।
হিন্দু-মুসলমানে তখন দাঙ্গা বেঁধেছিল ॥
জানি না কে যে কার মন্ত্রণা লইল।
যার ফলে দেশ তখন বিভক্ত হইল ॥
মারা গেলেন অনেক হিন্দু-মুসলমান।
শোষিতের মুক্তি এল না এল পাকিস্তান ॥
সাধারণ মানুয়ের মনে কত আশা ছিল।
সুকৌশলে পাকিস্তান জন্ম তখন নিল ॥
পাকিস্তানে স্বৈরাচার লভিল আসন।
ইচ্ছা মতো চালাইল শোষণ শাসন ॥
সাধারণ মানুষের মনে ছিল কত আশা।
স্বাধীন হবে সুখে রবে বাধবে সুখের বাসা ॥
কৃষক মজুর মেহনতিদের আশায় ছাই দিল ।
পরে ভাবি শোষক তার শোষণের সুযোগ নিল ॥
নিরাশা দুরাশায় মানুষ অসহায় হলো।
স্বার্থপরগণ বলে শুধু জিন্দাবাদ বলো ॥

.

শান্তির পরিবর্তে দুর্নীতি বাড়িল ।
জনগণ মুসলিম লীগের সমর্থন ছাড়িল ॥
পরে নির্বাচনের ডাক যখন পড়িল।
বিরোধীগণ মিলে সবাই যুক্তফ্রন্ট গড়িল ॥
বিরোধী বলিতে তারা বহু দল ছিল।
আওয়ামী লীগ প্রধান ভূমিকা তখন নিল ॥
গানের আসরে যখন গান গাইতে যাই।
মধ্যে মধ্যে গরিবের দুঃখের গান গাই ॥
গান গাই-আসলে অর্থ সম্পদ নাই।
যেখানে লোকে চায় সেখানেই যাই ॥
জগন্নাথপুর আসর করার দায়িত্ব নিলাম।
আমি এবং কামাল উদ্দিন দুইজন ছিলাম ॥
বাজারে আসর করা হলো চমৎকার।
আসরে লোক ছিল হাজার হাজার ॥
সিলেটের কৃতী সন্তান আবদুস সামাদ।
জনসেবা করবেন বলে মনে নিয়ে সাধ ॥
পার্লামেন্টে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিলেন।
যুক্ত ফ্রন্টের নৌকাতে বাদাম দিলেন ॥
অশান্তির আঁধারে আসলেন শান্তির বাণী মুখে।
গ্রহণ করে নিল তাকে এই এলাকার লোকে ॥
এলকাবাসীর সঙ্গে পিরিত বাড়ালেন ।
দিরাই-জগন্নাথপুর থেকে তখন দাঁড়ালেন ॥
নির্বাচনের কাজে এই এলাকায় ছিলেন।
আসরে গান শোনার সুযোগ নিলেন ॥
সামাদ মিয়া গান শুনিলেন বসে এই আসরে।
গানের পরে আমাকে নিলেন খবর করে ॥
গণ্যমান্য লোক নিয়ে বসেছিলেন।
যাওয়ার পর হাত ধরে টেনে নিলেন ॥
আলোচনায় দিগ্বিদিক তুলে ধরলেন।
পরে আমাকে এক অনুরোধ করলেন ॥
দেখেন দেশে ন্যায়নীতি সমবণ্টন নাই।
আমরা শোষণমুক্ত সমাজ গড়তে চাই ॥
রচনা করে যখন গান গাইতে পারেন।
শোষিত মানুষের কথা তুলে ধরেন ॥
আপনার এই গানগুলোর এখন দরকার।
উৎখাত করিতে এই মুসলিম লীগ সরকার ॥
আপনি আমার সব নির্বাচনী সভায়।
গান গাইবেন আপনাকে জনগণ চায় ॥
সভাতে মাইক তখন প্রথম পেয়েছি।
মানুষের সুখ দুঃখের কত গান গেয়েছি ॥
বক্তব্যের আসল কথা সহজ ভাষায় গাই।
সাধু কি চলিত ভাষা সেই বিচার নাই ॥
জনসভাতে গান যখন গেয়েছি।
সভাতে উপযুক্ত সমর্থন পেয়েছি ॥
শোষিত শ্রেণীতে যখন জন্ম নিলাম ।
জন্মগত প্রতিবাদী আমি ছিলাম ॥
যুক্তফ্রন্ট জিন্দাবাদ ধ্বনি উঠিল ।
স্বৈরশাসক মুসলিম লীগের সমাপ্তি ঘঠিল ॥
যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে জয়লাভ করলেন।
আওয়ামী লীগ কোয়ালিশন সরকার গড়লেন ॥
সব সময় গনতন্ত্রের কথা বলেন।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী প্রধান মন্ত্রী হলেন ॥
রাজনীতি-সমাজনীতিতে ছিলেন সজীব।
দুর্নীতিদমনের মন্ত্রী হলেন শেখ মুজিব ॥
সুনামগঞ্জে সফরে আসলেন যখন।
সামাদ মিয়া সঙ্গে ছিলেন তখন ॥
এই দুইজনের প্রতি মানুষ আশাবাদী ছিল।
দূরের লোক কষ্ট করে দেখার সুযোগ নিল ॥
আমিও সমাবেশে অংশ নিলাম।
জনসভায় তখন গান গেয়েছিলাম :

পূর্ণচন্দ্রে উজ্জ্বল ধরা
চৌদিকে নক্ষত্রঘেরা
জনগণের নয়নতারা
শেখ মুজিবুর রহমান
জাগ রে জাগ রে মজুর-কৃষাণ ॥

গণসঙ্গীত পরিবেশন করলাম যখন।
একশত টাকা উপহার দিলেন তখন ॥
শেখ মুজিব বলেছিলেন সৎ-আনন্দমনে ॥
‘আমরা আছি করিম ভাই আছেন যেখানে’ ॥
শহীদ সোহরাওয়ার্দী দেশকে ভালোবাসলেন।
সরকারি সফরে তখন সিলেট আসলেন ॥
শহীদ সাহেবের প্রতি আস্থাশীল ছিল।
অসংখ্য মানুষ এই সভায় যোগ দিল ॥
প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য শেষ হলে পরে।
শুনি তখন মাইকে ঘোষণা করে ॥
বাউল কবি আবদুল করিম গান এখন ধরবেন।
তিনি একটি পল্লীর গান পরিবেশন করবেন ॥
জনসভায় গান গাওয়ার সুযোগ পাইলাম।
মানুষের সুখ-দুঃখের গান একটি গাইলাম ॥
জনগণ আরেকটা শুনতে চাইলে পরে।
গাইলাম একটি গ্রামগঞ্জের অবস্থা তুলে ধরে ॥
আমি যখন গান গাই জনতার আসরে।
তখন এই দেশে দুর্ভিক্ষ বিরাজ করে ॥
এই সময় আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ছিল।
গ্রাম গঞ্জে লঙ্গরখানা খুলে তখন দিল ॥
বর্তমান অবস্থা বলতে ইচ্ছা করলাম।
ক্ষুধার্ত মানুয়ের কথা তুলে ধরলাম ॥
এই দেশের দুর্দশার কথা কী বলব সভায়।
পেটের ক্ষুধায় কত লোক লতাপাতা খায় ॥
জনাব মৌলানা ভাসানী গরিবের বন্ধু তিনি।
চিন্তা করেন দিনরজনী গরিব দুঃখীর দায় ॥
মৌলানা ভাসানীর শুনি নামের ধ্বনি।
কৃষক মজুর মেহনতিদের জন্য পরশমনি ॥
লক্ষ করলাম মনোযোগে গান শুনে নিলেন।
জেব উজার করে আমাকে উপহার দিলেন ॥
বুঝিলাম আমার প্রতি সদয় হলেন।
আরেক আশ্বাস বাণী পরে বলেন ॥
বলব আতাউর রহমানের সাথে ।
তোমার জন্য স্বতন্ত্র ব্যবস্থা হয় যাতে ॥
একদিন ডিসি সাহেবের খবর পাইলাম।
দেখা করে বিষয় কী জানতে চাইলাম ॥
ডিসি বললেন, আপনাকে ডাকছেন সরকার।
কাগমারী সম্মেলনে যাওয়া দরকার ॥
আমি বললাম, আমি যে কাউন্সিলার নই।
আমি কেন যাব আর খরচ পাব কই ॥
ডিসি সাহেব বললেন, আমি ব্যবস্থা নিতেছি।
আপনার যা প্রয়োজন আমি দিতেছি ॥
একশন টাকা আর কম্বল একখান।
দিয়ে বললেন সবাই যাচ্ছে আপনিও যান ॥
সিলেট থেকে যাত্রী সেদিন অনেকেই ছিলেন।
আদর করে আমাকেও সঙ্গে নিলেন ॥
মহা এক আনন্দে কাগমারী গেলাম।
সর্বপ্রথম শেখ মুজিবের দেখা পাইলাম ॥
ক্যাম্পে আছেন বন্ধুবান্ধব, কাছে বসেছে।
দেখেই বললেন, হে আমার করিমভাই এসেছে ॥
সবাইকে পরিচয় দিলেন, আমার করিম ভাই।
গণসঙ্গীত শিল্পী সে আমি ভালো পাই ॥
প্রথমে বললেন, আপনার শরীর ভালো আছে?
পরে বললেন, ডিসি আপনার খরচ দিয়াছে ॥
স্নেহভরে কাছে নিয়ে হাত চেপে ধরলেন।
পরে একজনকে জিজ্ঞাসা করলেন ॥
বললেন, দেখি তোর কাছে টাকা আছে কত?
থাকে যদি তা হলে আমাকে দে তো ॥
সে বুকের পকেট থেকে বাহির করে দিল।
ভদ্রলোকের পকেটে দেড়শো টাকা ছিল ॥
টাকাগুলো তখন নিজ হাতে নিলেন।
পরে তাহা আমাকে দিয়ে দিলেন ॥
দিয়ে বললেন, এগিয়ে চল, নাই কোনো ভয়।
গণসঙ্গীতগুলো যেন জোরদার হয় ॥
একটি কথা আমায় অন্তরে গাঁথা।
আজো ভুলি নাই আমি রমেশ শীলের কথা ॥
শুনেছি রমেশ শীল জেলে ছিলেন।
মুক্ত হয়ে সম্মেলনে অংশ নিলেন ॥
গণসঙ্গীতের আসরে গান তখন গেয়েছি।
বিভিন্ন শিল্পীদের সাক্ষাৎ পেয়েছি ॥
নেতাকর্মী সবাই তখন উপস্থিত ছিলেন।
মৌলানা ভাসানী আমাকে আশীর্বাদ দিলেন ॥

.

আনোয়ার রাজা এক মহৎ লোক ছিলেন।
সাহিত্য সম্মেলন করার উদ্যোগ নিলেন ॥
গণ্যমান্য সবাই এতে মিশে পড়লেন।
হাসন স্মৃতি নামে এই আয়োজন করলেন ॥
হাসন স্মৃতি সম্মেলন হইল যখন।
আনন্দ পাইলেন এলাকার জনগণ ॥
সিলেটে বাউল শিল্পী যারা ছিলেন।
মনের আনন্দে সবাই অংশ নিলেন ॥
আধুনিক যারা গায় তারাও যোগ দিল।
রবীন্দ্রসঙ্গীত নজরুলগীতির শিল্পী সবাই ছিল ॥
শিল্পীগণ মন আনন্দে গান তখন গেয়েছে।
উপযুক্ত সম্মান সবাই পেয়েছে ॥
ঢাকা বেতারের লোক এসে হাজির হলো।
তারা বললেন, হাসন রাজার রচিত গান বলো ॥
উজির মিয়া হাসন রাজার গান গেয়েছিল।
বেতারের লোক তাহা রেকর্ড করে নিল ॥
গ্রামগঞ্জের লোক সবাই গান শুনতে পান।
বিশেষ আকর্ষণ ছিল মালজোড়া গান ॥
প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে গান তখন গেয়েছি।
প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রথম উপহার পেয়েছি ॥
জনগণের মনে বড় উৎসাহ ছিল ।
সম্মেলন সবার মনে আনন্দ দিল ॥
সাধারণ মানুষের মঙ্গল যারা চায় ॥
লোকসঙ্গীত গণসঙ্গীত তারা ভালো পায় ॥

উদীচী শিল্পী গোষ্ঠীর উদ্দেশ্য মহান।
প্রতিষ্ঠা করতে চায় লোকসঙ্গীতের মান ॥
১৩৯৭ বাংলায় উদ্যোগ তারা নিল।
জাতীয় শহীদ মিনারে আসর করেছিল ॥
তিনদিন ব্যাপী সম্মেলনের দায়িত্ব নিলেন।
শতাধিক শিল্পী তখন উপস্থিত ছিলেন ॥
প্রধান অতিথি করে আমাকে নিলেন।
উদ্বোধন করার দায়িত্বও দিলেন ॥
এই গান সরলপ্রাণ সবাই ভালোবাসে।
সমাজের ভেতরের ছবি বাহির হয়ে আসে ॥
লোকসঙ্গীত জনগণের সুখ দুঃখের গান।
পূর্বে ছিল আজো আছে বর্তমান ॥
শোষণের বিরুদ্ধে আমি শোষিতের গান গাই।
আপোসহীন সংগ্রাম করে বেঁচে থাকতে চাই ॥

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *