২১. কৃষ্ণার্জ্জুনের ছলে দুর্য্যোধনের মুকুট আনয়ন

কৌরবের যোদ্ধাগণ চলিল শিবির।
ভীষ্মের নিকটে গেল দুর্য্যোধন বীর।।
পিতামহ পদে বীর প্রণাম করিয়া।
সবিনয়ে কহে রাজা কৃতাঞ্জলি হৈয়া।।
তোমার সমান বীর নাহিক সংসারে।
দেবতা দানবগণ সবে তোমা ডরে।।
নিঃক্ষত্র পৃথিবীকারী ‍রাম মহাশয়।
তোমার নিকটে হৈল তাঁর পরাজয়।।
হেন মহাবীর তুমি দুর্জ্জয় সংসারে।
মুহূর্ত্তেকে তিন লোক পার জিনিবারে।।
সাত দিন পাণ্ডব সহিত কর রণ।
নির্ব্বিঘ্নে গৃহেতে যায় ভাই পঞ্চজন।।
যদ্যপি রণেতে কালি না মার পাণ্ডবে।
অপযশ তোমার যে ঘুষিবেক সবে।।
রুষিয়া উঠিল শুনি ভীষ্ম মহাবীর।
তূণ হৈতে পঞ্চশর করিল বাহির।।
মহাকাল নাম তার জানে সর্ব্বজন।
সুরপতি বজ্র সম নহে নিবারণ।।
বাণ হস্তে করি কহে জাহ্নবী নন্দন।
কোন চিন্তা নাহি তব শুনদুর্য্যোধন।।
কল্য রণে পাণ্ডবে নাশিব এই শরে।
দেব দামোদর যদি ছল নাহি করে।।
কৃষ্ণের কারণ বাঁচে ভাই পঞ্চজন।
নহিলে কি শক্তি তার সহে মম রণ।।
কালি পাণ্ডুপুত্রেরে মারিব এই শরে।
তবে সে যাইব আমি আপনার ঘরে।।
দুর্য্যোধন শুনি মহা আনন্দ হইল।
দিব্য রত্নগৃহ তথা নির্ম্মাইয়া দিল।।
সেই গৃহে রহিলেন গঙ্গার নন্দন।
দুর্য্যোধন মনে ভাবে জিনিলাম রণ।।
যুধিষ্ঠির মহারাজ সহ ভ্রাতৃগণ।
যত যোদ্ধাগণ আর দেব ‍নারায়ণ।।
সভা করি বসিলেন আপন আলয়।
সহদেবে জিজ্ঞাসেন দেবকী তনয়।।
কিমতে হইবে কালি যুদ্ধের করণি।
প্রকাশ করিয়া তাহা কহ মন্ত্রিমণি।।
সহদেব বলে শুন সংসারের সার।
সকল জানহ তুমি কি বলিব আর।।
দুর্য্যোধন আদেশেতে পিতামহ বীর।
তূণ হৈতে পঞ্চশর করিল বাহির।।
পাণ্ডব বধিব বলি প্রতিজ্ঞা করিল।
দ্বারেতে রহিল অন্তঃপুরে নাহি গেল।।
পাণ্ডবের হর্ত্তা কর্ত্তা তুমি মহাশয়।
বুঝিয়া করহ কার্য্য উচিত যে হয়।।
শুনি যুধিষ্ঠির পাইলেন মহাভয়।
ভীষ্মের প্রতিজ্ঞা কভু লঙ্ঘন না হয়।।
সবান্ধবে কালি সবে হইবে নিধন।
কি উপায় ইহার হইবে নারায়ণ।।
শ্রীহরি বলেন রাজা চিন্তা না করিহ।
ধনঞ্জয় বীরের আমার সঙ্গে দেহ।।
ছল করি ভীষ্মস্থানে আনি পঞ্চবাণ।
অরিষ্ট ঘুচিবে হবে সবার কল্যাণ।।
যুধিষ্ঠির বলিলেন হইয়া বিস্ময়।
ছল করি কিরূপে আনিবা মহাশয়।।
কৃষ্ণ কহিলেন শুন ধর্ম্মের নন্দন।
কাম্যবনে যখন আছিলা পঞ্চজন।।
দূতমুখে দুর্য্যোধন শুনি সমাচার।
দুষ্ট মন্ত্রিগণ সহ করিল বিচার।।
দেখাইতে ঐশ্বর্য্য করিল আগমন।
সর্ব্ব সৈন্য সাজিলেক বিনা ভীষ্ম দ্রোণ।।
করিতে প্রভাসে স্নান দিলেক ঘোষণা।
সবান্ধবে চলে আর যত পুরজনা।।
তোমার অমান্য করি প্রভাসেতে গেল।
চিত্ররথ পুষ্পোদ্যান তথায় ভাঙ্গিল।।
শুনি ক্রোধে আইল গন্ধর্ব্ব বীরবর।
দুর্য্যোধন সহ তার হইল সমর।।
কর্ণ আদি যত যোদ্ধা রণে ভঙ্গ দিল।
স্ত্রীগণ সহিত দুর্য্যোধনেরে বান্ধিল।।
প্রেষণীর মুখে বার্ত্তা করিয়া শ্রবণ।
অর্জ্জুনেরে পাঠাইয়া করিলা মোচন।।
তুষ্ট হয়ে পার্থেরে বলিল দুর্য্যোধন।
মম স্থানে চাহি লহ যাহা তব মন।।
পার্থ বলিলেন এবে নাহি মম কাজ।
সময় হইলে লব শুন কুরুরাজ।।
সেই সত্য হেতু আজি তথাকারে যাব।
ছল করি নিজ কার্য্য উদ্ধার করিব।।
এতেক বলিয়া হরি পার্থ দুই জন।
শীঘ্রগতি চলিলেন যথা দুর্য্যোধন।।
শ্রীহরি বলেন আমি থাকিব বাহিবে।
তুমি গিয়া মুকুট আনহ মাগি বীরে।।
মুকুট মস্তকে দিয়া যাহ ভীষ্ম যথা।
শরমাগি আনহ ঘুচুক মনোব্যথা।।
শুনিয়া চলিল পার্থ অতি শীঘ্রতর।
গিয়া দ্বারী জানাইল ‍নৃপতি গোচর।।
শুনি রাজা দুর্য্যোধন ত্বরিত ডাকিল।
অন্তঃপুরে দিব্যাসনে পার্থে বসাইল।।
জিজ্ঞাসিল কি হেতু তোমার আগমন।
যে বাঞ্ছা তোমার তাহা করিব পূরণ।।
অর্জ্জুন বলেন রাজা পূর্ব্ব অঙ্গীকার।
মুকুট আমারে দিয়া সত্যে হও পার।।
শুনি দুর্য্যোধন নাহি বিলম্ব করিল।
মাথার মুকুট আনি ধনঞ্জয়ে দিল।।
মুকুট পাইয়া বীর হরষিত মন।
তথা হৈতে চলিলেন ভীষ্মের সদন।।
মুকুট শিরেতে বান্ধি উপনীত পার্থ।
দেখি ভীষ্ম সমাদর করিল যথার্থ।।
ভীষ্ম কহে কহ শুনি রাজ দুর্য্যোধন।
এত রাত্রে কি জন্য হেথায় আগমন।।
পার্থ বলিলেন দেহ মহাকাল শর।
স্বহস্তে পাণ্ডবে বধি জিনিব সমর।।
হাসি গঙ্গাপুত্র শর দিল সেইক্ষণে।
নিলেন অর্জ্জুন তাহা হরষিত মনে।।
হেনকালে শ্রীহরি দিলেন দরশন।
দেখি ভীষ্ম জানিলেন সকল কারণ।।
কৃষ্ণ প্রতি বলিছেন শান্তনু-কুমার।
কি হেতু প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করিলে আমার।।
শিব সনকাদি তব না জানে মহিমা।
দেবগণ মুনিগণ দিতে নারে সীমা।।
অখিল ব্রহ্মাণ্ডেশ্বর জগতের পতি।
আপনি হইলা তুমি পাণ্ডব সারথি।।
আমার প্রতিজ্ঞা ভাঙ্গি রাখিলে পাণ্ডবে।
তোমার প্রতিজ্ঞা কালি ভাঙ্গিব আহবে।।
সান্ত্বনা করিয়া ভীষ্মে দেবকী নন্দন।
অস্ত্র লয়ে দুইজন করেন গমন।।
পাণ্ডবগণের তাহে আনন্দ হইল।
মৃতদেহে যেন ‍আসি প্রাণ সঞ্চাবিল।।
মহাভারতের কথা অমৃত সমান।
কাশীরাম দাস কহে শুনে পুণ্যবান।।