০৩. ভীষ্ম ও দুর্য্যোধনের কথোপকথন

হেথায় প্রভাতকালে রাজা দুর্য্যোধন।
দ্রোণে অগ্রে করি রণে আইল তখন।।
রথ ছাড়ি গেল বীর ভীষ্মের সদন।
ভীষ্মেরে প্রণাম করে রাজা দুর্য্যোধন।।
শরশয্যা শয়নে আছেন মহাবীরে।
দুর্য্যোধন কহিতে লাগিল ধীরে ধীরে।।
আজ্ঞা কর পিতামহ প্রসন্নবদনে।
সমর করিতে যাই পাণ্ডুপুত্র সনে।।
সেনাপতি সমরেতে করিলাম গুরু।
কি ভয় আশ্রয় যার হেন কল্পতরু।।

শুনি দুর্য্যোধন বাক্য কুরুবংশপতি।
দুর্য্যোধনে ‍বুঝাইল মধুর ভারতী।।
আমি যাহা কহি তাহা শুন দুর্য্যোধন।
কদাচিত না লঙ্ঘিবে আমার বচন।।
সকল মঙ্গল হবে পৌরুষ অপার।
পৃথিবীর মধ্যে যশ রহিবে তোমার।।
তোমা সবাকার ভদ্র চিন্তি অনুক্ষণ।
এই হেতু তোমারে যে বলি দুর্য্যোধন।।
আমার বচন তুমি না করিও আন।
কি কারণে ক্ষয় কর কৌরব সন্তান।।
সৈন্য অপচয় মাত্র হবে ধন শেষ।
প্রজার পরম পীড়া নষ্ট হবে দেশ।।
যুধিষ্ঠির রাজা দেখ ধর্ম্ম অবতার।
তার সহ প্রীতিতে করহ ব্যবহার।।
রাজ্য ধন কিছু তারে দেহ গিয়া তুমি।
যুধিষ্ঠিরে সম্মত করিয়া দিব আমি।।
আমার বচন কভু না কর অন্যথা।
বংশ রক্ষা হেতু তোমা কহি হেন কথা।।
নিরর্থক জ্ঞাতিগণে করিবে সংহার।
আপনি না বুঝ কেন করিয়া বিচার।।
বুদ্ধির সাগর তুমি বলে মহাবল।
সসাগরা পৃথিবী তোমার করতল।।
কহ আমি যুধিষ্ঠিরে আনি এই ক্ষণ।
মম বাক্য না লঙ্ঘিবে ধর্ম্মের নন্দন।।
ভীম ধনঞ্জয় দেখ মহাধনুর্দ্ধর।
তার সহ কোন্ জন করিবে সমর।।
পাণ্ডবের দলে কৃষ্ণ আছেন আপনে।
তাঁর সহ বিরোধে জিনিবে কোন্ জনে।।
অতএব তাঁর সহ কে করিবে রণ।
বংশরক্ষা হেতু কহি শুন দুর্য্যোধন।।
প্রত্যয় না হয় যদি আমার বচনে।
আপনি জিজ্ঞাসা কর দ্রোণাচার্য্য স্থানে।।
দ্রোণাচার্য্য বলে তুমি যে আজ্ঞা করিলে।
এমন করিলে, থাকে সকলে কুশলে।।
বেদতুল্য জানি আমি তোমার বচন।
যতেক কহিলা তুমি সবার কারণ।।
দুর্য্যোধনে অনুক্ষণ বুঝাই বিস্তর।
নাহি শুনে দুর্য্যোধন করি অনাদর।।
মৃত্যুকালে রোগী যেন ঐষধ না খায়।
সেইমত দুর্য্যোধন অজ্ঞানের প্রায়।।
কি হইবে তস্করে কহিলে ধর্ম্মবাণী।
কভু নাহি হয় সতী, অসতী রমণী।।

এত শুনি দুর্য্যোধন বলিল বচন।
অনুক্ষণ নিন্দা মোরে কর সর্ব্বজন।।
কোন্ দোষ আমার দেখিলে তোমা সবে।
সবে মাত্র দেখিয়াছ নির্দ্দোষ পাণ্ডবে।।
অবিরত কটু কথা প্রাণে নাহি সহে।
গুরুজন গঞ্জনা অনলে তনু দহে।।
বলে পারি ছলে পারি প্রকার বিশেষে।
নাশিব আপন শত্রু ভয় মোর কিসে।।
মৃত্যু হৈতে কষ্ট ভাবি পাণ্ডবের বশ।
মরি যদি সমরে, রহিবে তবু যশ।।
ক্ষোভ না করিয়া ক্ষিতি করিলাম ভোগ।
এখন যে হয় কর্ম্ম দৈবের সংযোগ।।
পণ করিয়াছি আমি, আপনি বিচারি।
কদাচিত অন্যথা করিতে নাহি পারি।।
এত বলি দুর্য্যোধন হয়ে দুঃখমতি।
কর্ণ দুঃশাসনে লয়ে চলে শীঘ্রগতি।।
দেখিয়া গঙ্গার পুত্র হইল দুঃখিত।
দ্রোণেরে চাহিয়া তবে বলিল বিহিত।।
কালপ্রাপ্ত হইলেক বুঝিয়া দুর্য্যোধন।
অতএব নাহি শুনে কাহার বচন।।
নিশ্চয় জানিনু হৈল কুরুকুল অস্ত।
দিন দুই তিন মধ্যে মজিবে সমস্ত।।
এত বলি ভীষ্মবীর নিঃশব্দে রহিল।
সৈন্য লয়ে দুর্য্যোধন রণস্থলে গেল।।