১৫. যুধিষ্ঠিরের নরক দর্শনের হেতু ও শ্বেতদ্বীপে গিয়া স্বজনাদি দর্শন

জন্মেজয় জিজ্ঞাসিল, কহ মুনিবর।
কোন পাপ করিলেন ধর্ম্ম-নৃপবর।।
আজন্ম তপস্বী জিতেন্দ্রিয় সত্যবাদী।
দান ধর্ম্মে মতি সদা, পাতক-বিবাদী।।
তাঁহার হইল পাপ কেমন প্রকারে।
বিস্তারিয়া মুনিবর কহিবে আমারে।।

মুনি কহে শুনি জন্মেজয় সাবধানে।
যুধিষ্ঠিরে পাপ হৈল যাহার কারণে।।
ভারত সমরে যবে হৈল মহামার।
সারথি হলেন নারায়ণ অর্জ্জুনের।।
মারিলেন বহু সৈন্য উপায় করিয়া।
ভীষ্ম বীরে বধিলেন শিখণ্ডী রাখিয়া।।
তবে সেনাপতি হৈল দ্রোণ মহাশয়।
অশ্বথামা তাঁর পুত্র সমরে দুর্জ্জয়।।
অনেক প্রকারে দ্রোণ না হয় বিনাশ।
দেখিয়া উপায় করিলেন শ্রীনিবাস।।
কপটে মারেন হস্তী অশ্বথামা নামে।
‘অশ্বথামা হত’ শব্দ হইল সংগ্রামে।।
শুনি চমৎকার লাগে দ্রোণের অন্তরে।
‘অশ্বথামা হত’ হরি কহেন সমরে।।
প্রত্যয় না যান দ্রোণ কৃষ্ণের উত্তরে।
সত্য মিথ্যা জিজ্ঞাসিল রাজা যুধিষ্ঠিরে।।
দ্রোণবাক্য শুনিয়া চিন্তিত নৃপমণি।
কিরূপে কহিব আমি অসত্য এ বাণী।।
কৃষ্ণ বলিলেন রাজা না কহিলে নয়।
মিথ্যা না কহিলে, দ্রোণ নাহি পরাজয়।।
পুনঃ পুনঃ নিন্দিয়া বলিল বৃকোদর।
‘অশ্বথামা হত’ দ্রোণ কহ নৃপবর।।
মিথ্যা বাক্য ভয় যদি কর নৃপবর।
‘ইতি গজ’ তার পরে বল লঘুস্বর।।
সঙ্কটে পড়িয়া রাজা না কহিলে নয়।
ডাকিয়া দ্রোণেরে বলিলেন মহাশয়।।
অশ্বথামা হত হৈল ইহা আমি জানি।
লঘুশব্দে ‘ইতি গজ’ বলেন আপনি।।
‘অশ্বথামা হত’ শুনি ধর্ম্মের বদনে।
দ্রোণাচার্য্য পুত্রশোকে প্রাণ দিল রণে।।
এই পাপ করিলেন ধর্ম্মের নন্দন।
তোমারে জানাই আমি পূর্ব্বের কথন।।
জন্মেজয় বলে তবে কহ মুনিবর।
পিতামহে লৈয়া কি করিলেন শ্রীধর।।

মুনি বলে শুন পরীক্ষিতের কুমার।
এইরূপে যুধিষ্ঠির দেখি অন্ধকার।।
গোবিন্দেরে জিজ্ঞাসেন পাপের কারণ।
কপট করিয়া কহিলেন নারায়ণ।।
কৌরব সহিত যবে হইল সমর।
চক্রব্যূহ করি যুঝে দ্রোণ ধনুর্দ্ধর।।
তীক্ষ্ম অস্ত্রে জর্জ্জরিত করিল তোমারে।
অভিমুন্যে ডাকি তুমি কহিলে তাহারে।।
পিতার সমান তুমি মহাযোদ্ধাপতি।
ব্যূহ ভেদি মার পুত্র দ্রোণ মহারথী।।
গুরুবধে আজ্ঞা দিলে হয়ে ক্রোধমন।
দ্বিতীয় অবধ্য জাতি হয়ত ব্রাহ্মণ।।
গুরুবধ মহাপাপ শুন নরপতি।
সেই মহাপাপ তব হৈল মহামতি।।
পাপেতে নরক রাজা দেখ অন্ধকার।
রাজা বলিলেন কর সঙ্কটে উদ্ধার।।

তবে হরি অনুজ্ঞা দিলেন খগেশ্বরে।
শ্বেতদ্বীপ সরোবরে লহ নৃপবরে।।
পূর্ব্বের প্রতিজ্ঞা পূর্ণ করিব আপনি।
দেখাব ধর্ম্মেরে অষ্টাদশ অক্ষৌহিণী।।

বিষ্ণুর বচন শুনি খগ মহাবীর।
যুধিষ্ঠিরে নিয়া গেল সরোবর তীর।।
পাখসাটে পর্ব্বত উড়িয়া যায় দূরে।
মুহূর্ত্তেকে সেই দ্বীপে গেল খগেশ্বরে।।
সরোবরে দেখিলেন ধর্ম্মের নন্দন।
দেবতা গন্ধর্ব্ব যক্ষ বিদ্যাধরগণ।।
জলে জলচরগণ নানা ক্রীড়া করে।
ঋষি মুনি মুনীন্দ্র যোগীন্দ্র চারি তীরে।।
বিচিত্র নগর বন সাগর চত্বর।
বৈকুণ্ঠ সমান পুরী অতি মনোহর।।
অনেক ঈশ্বর মুর্ত্তি সর্ব্বদের স্থান।
ভ্রমর ঝঙ্কারে মত্ত কোকিলের গান।।
মনুষ্য হইয়া যদি তাহে স্নান করে।
দেবদেহ পেয়ে যায় বৈকুণ্ঠ নগরে।।
হেন সরোবর দেখি ধর্ম্মের নন্দন।
মহাজলে স্নান করি করেন তর্পণ।।
মানব শরীর ছাড়ি দেবদেহ পান।
দুঃখ শোক পাসরিয়া সর্ব্বসিদ্ধ হন।।
নরদেহ ত্যজি রাজা দেবদেহ ধরে।
পৃষ্ঠে করি গরুড় উড়িল বায়ুভরে।।
মুহূর্ত্তেকে গেল যথা দেব নারায়ণ।
চতুর্ভূজে ধর্ম্মরাজ কৈল সমর্পন ।।
রাজারে দেখিয়া হরি কহেন হাসিয়া।
নিমেষ ‍নাহিক আর নাহি অঙ্গছায়া।।
কিরূপ আছিলে রাজা হইলে কিরূপ।
বিচারিয়া মনে বুঝ আপন স্বরূপ।।
ভূপতি বলেন শুন অনাদি গোঁসাই।
তোমার প্রসাদে মম পূর্ব্বরূপ নাই।।
দেবত্ব পাইনু মনে হেন হয় জ্ঞান।
তোমার অসাধ্য কিছু নাহি ভগবান।।
মর্ত্ত্যেতে রাখিলে হরি অশেষ সঙ্কটে।
নিজ পুরী এড়ি সদী ভক্তের নিকটে।।
রাজসূয় করালেন দিয়া বন্ধুবল।
শিশুপাল দন্তবক্রে দিলে প্রতিফল।।
রাখিলে দ্রৌপদী লজ্জা কৌরব সমাজে।
দ্বাদশ বৎসর রক্ষা কৈলে বনমাঝে।।
দুর্ব্বাসারে দুর্য্যোধন পাঠাইল যবে।
সেই দিন সমাধান করিত পাণ্ডবে।।
নিশাকালে রক্ষা কৈলে কাননেতে গিয়া।
মোহিলা মুনির মন বিষ্ণুমায়া দিয়া।।
তদন্তরে সান্দীপন মুনির আশ্রমে।
আম্র হেতু সঙ্কটে তারিলে পথশ্রমে।।
অজ্ঞাত বৎসর এক বিরাট ভুবনে।
শত্রু হৈতে রক্ষা কৈলা চক্র আচ্ছাদনে।।
তাহার অন্তরে মম রাজ্যের লাগিয়া।
আপনি হস্তিনাপুরে গেলা দূত হৈয়া।।
আমারে বিভাগ নাহি দিল দুর্য্যোধনে।
বান্ধিয়া রাখিতে তোমা বিচারিল মনে।।
আপনি বিরাটমূর্ত্তি দেখাইলে তারে।
সমূলে করিলা ক্ষয় ভারত সমরে।।
জ্ঞাতিবধ পাপে মম শরীর বিকল।
অশ্বমেধ করাইলা হইয়া সবল।।
পুত্রহস্তে অর্জ্জুন মরিল মণিপুরে।
প্রাণ দিয়া যজ্ঞপূর্ণ কৈলা গদাধরে।।
মৎস্য কূর্ম্ম বরাহ হইয়া খর্ব্বরূপে।
পাতালে রাখিলা ছলি বলিরাজ ভূপে।।
ভূগৃরাম রামচন্দ্র কামপাল রাম।
বৌদ্ধ কল্কি নারায়ণ নরসিংহ শ্যাম।।
বারে বারে জন্ম লও দুষ্ট বিনাশিতে।
যুগে যুগে অবতার দেবতার হিতে।।
তোমার চরিত্র চারি বেদে না নিরখি।
জ্ঞাতিগোত্র দেখাইয়া কর মোরে সুখী।।

রাজার বিনয় বাক্য শুনি নারায়ণ।
আশ্বাসিয়া কহিলেন মধুর বচন।।
সর্ব্ব দুঃখ গেল রাজা না কর সন্তাপ।
সবন্ধু কুটুম্ব গোত্র দেখহ মা বাপ।।
এত বলি যান হরি রাজারে লইয়া।
কুরুপুরে প্রবেশেন দ্বার ঘুচাইয়া।।
রাজারে কহেন হরি শুন ধর্ম্মপুত্র।
অনুপম দেখহ দ্বিতীয় কুরুক্ষেত্র।।
পিতা পাণ্ডু দেখ রাজা জননী কুন্তীকে।
শ্বেতছত্র বিরাজিত রাজার মস্তকে।।
বামে মাদ্রী বসিয়াছে মদ্রের কুমারী।
অন্ধরাজ বসিয়াছে সহিত গান্ধারী।।
দেখহ বিকর্ণ কর্ণ কৌরবকুমার।
দুর্য্যোধন শত ভাই সঙ্গে সহোদর।।
ভগদত্ত শল্য মদ্ররাজ জয়দ্রথ।
অভিমন্যু ঘটোৎকচ সুরথ ভরত।।
বিকট দ্রুপদ দেখ স্বপুত্র সহিতে।
পাঞ্চালীর পঞ্চপুত্র দেখহ সাক্ষাতে।।
শিশুপাল সুশর্ম্মা মগধ নৃপমণি।
একে একে দেখ অষ্টাদশ অক্ষৌহিনী।।
শুকুনি উত্তর পুণ্ড দ্রোণাচার্য্য গুরু।
ভগদত্ত শল্য রাজা সিন্ধু ভীম ঊরু।।
পঞ্চজন পড়িলেন স্বর্গেতে আসিতে।
চারি ভাই দেখ বাজা দ্রৌপদী সহিতে।।
বিস্ময় মানিয়া রাজা কৃষ্ণের বচনে।
চিত্রের পুত্তলি প্রায় চান চারি পানে।।
পাসরিয়া সকল মর্ত্ত্যের শত্রুকার্য্য।
যথাযোগ্য মিলন করেন হৈয়া ধৈর্য্য।।
আনন্দ সাগরে মগ্ন হৈল তনু মন।
যুধিষ্ঠিরে দেখিয়া সানন্দ জ্ঞতিগণ।।
কেহ আশীর্ব্বাদ করে কেহ প্রণিপাত।
পিতা মাতা জ্যেষ্ঠতাত বন্দে নরনাথ।।
ভীষ্ম দ্রোণ কর্ণ বীরে করি দণ্ড নতি।
মহা আনন্দিত রাজা দেখি গোত্র জ্ঞাতি।।