১১. সোমেশ্বর পর্ব্বতে ভীমের তনুত্যাগ ও যুধিষ্ঠিরের বিলাপ

বলেন বৈশম্পায়ন শুন কুরুবীর।
অর্জ্জুনের শোকেতে কান্দেন ‍যুধিষ্ঠির।।
বৃকোদর বলিলেন ধর্ম্ম অধিপতি।
কোন্ পাপে পড়িল অর্জ্জুন মহামতি।।
ভূপতি বলেন শুন পবন তনয়।
আমা হৈতে দ্রৌপদীর বশ ধনঞ্জয়।।
সবে হেয় জ্ঞান তার ছিল মনোগতে।
এই হেতু পার্থবীর পড়িল পর্ব্বতে।।

এত বলি দুইজনে বিষণ্ণ বদনে।
চলেন উত্তরমুখে চিন্তি নারায়ণে।।
বৃকোদর বলে তবে হইয়া আকুল।
চল রাজা দুইজনে যাই সুরকুল।।
চারি ক্রোশ হৈতে শুনি স্বর্গের বাজন।
উঠেন পর্ব্বতে দুই পাণ্ডুর নন্দন।।
ছয় জন মধ্যেতে আছেন দুইজন।
শতেক যোজন সেই প্রমাণে উন্থিত।।
বিবিধ বৃক্ষের মুল রতনে মণ্ডিত।
হিমাগম সুশীতল অতি অনুপম।।
তার তলে দুই ‍ভাই করেন বিশ্রাম।
কতক্ষণ বসি পুনঃ করেন গমন।।
যাইতে দেখেন রাজা নদী সুশোভন।
রেবানামে নদী সেই পাপ বিনাশিনী।।
স্বর্গ হৈতে নামে তাহে ত্রিপথগামিনী।
নানা রত্নে বিরচিত দুই কূল তার।।
দেখিতে সুন্দর নদী মহিমা অপার।
নানারত্ন গিরিবর দেখিতে সুন্দর।
সুবর্ণের শৃঙ্গ মণি মাণিক্য পাথর।।
অতিশয় অপূর্ব্ব পর্ব্বত সুশোভন।
চন্দ্র সূর্য্য সমাগম গ্রহ তারাগণ।।
সঙ্কল্প করিয়া রাজা যান একচিত্তে।
না জানেন ভূমণ্ডল আছে কোন্ ভিতে।।
তার জলে নরপতি করেন তর্পণ।
তুষ্ট হয়ে পঞ্চাননে করেন পূজন।।
পুণ্য হেতু চলিলেন স্বর্গের উপর।
দর্শন করেন রাজা শিব সোমেশ্বর।।
কীট পক্ষী কৃমি আদি তথা যদি মরে।
রুদ্ররূপ হৈয়া তারা যায় স্বর্গপুরে।।
কিন্নর গন্ধর্ব্ব তথা গান করে নিত্য।
সহস্রেক সোমকন্যা করে বাদ্য নৃত্য।।
সোমেশ্বর পূজিয়া করিল নমস্কার।
বর চান মর্ত্ত্যে জন্ম না হোক আমার।।
এত বলি স্তুতি করি আর প্রণিপাত।
শিবের প্রসাদে পুষ্প পান পারিজাত।।
পুষ্পমালা অঙ্গে শোভা পাইল রাজার।
হরষিত নারীগণ জয় জয়কার।।
প্রশংসা করিয়া কহে সোমকন্যাগণ।
সুললিত স্বরে কহে মধুর বচন।।
পুণ্য হেতু ভূপতি আইলা এত দূরে।
এত বোল বলি রাজা শিবের মন্দিরে।।
সোমেশ্বর রাজ্যে তুমি হও দণ্ডধর।
যাবৎ থাকিবে পৃথ্বী চন্দ্র দিবাকর।।
আমাদের স্বামী হৈয়া থাকহ আনন্দে।
স্বর্গ সুখ পাবে অন্তে দেখিবে গোবিন্দে।।
একক যাইবে স্বর্গে কোন্ সুখ হেতু।
যে বিচারে আসে আজ্ঞা কর ধর্ম্মসেতু।।

কন্যাগণ বচনে বিস্মিত যুধিষ্ঠির।
আশ্বাসিয়া বলিলেন বচন গভীর।।
অনুচিত কন্যাগণ বল কি কারণে।
আশীর্ব্বাদ কর, যেন দেখি নারায়ণে।।
শুনিয়া রাজার মুখে নিষ্ঠুর ভারতী।
কন্যাগণ গেল তবে যে যার বসতি।।

সোমেশ্বর বন্দি রাজা চলেন উত্তর।
মহাহিম ভেদিল ভীমের কলেবর।।
সোমেশ্বর পার হৈতে নারে প্রাণপণে।
ভেদিল শরীর বীর পড়িল অজ্ঞানে।।
পর্ব্বত পড়িল যেন পর্ব্বত অজ্ঞানে।
ভীমসেন পতনে কম্পিত ধরাধর।।
সমুদ্রে সুমেরু গিরি যেন নিল ঝম্প।
কূর্ম্মপৃষ্ঠে থাকিয়া বাসুকী হৈল কম্প।।
পড়িলেক বৃকোদর পর্ব্বত বিশালে।
চলাচল কম্পমান সাগর উথলে।।
বাসুকী এড়িল বিষ যোদ্ধা এড়ে বাণ।
চমকিত পশু পক্ষী ছাড়িল যে প্রাণ।।
স্বর্গ মর্ত্ত্য পাতালে হইল চমৎকার।
চারিদিকে সাট ‍লাগে লঙ্কার দুয়ার।।
ইন্দ্র শঙ্কা পান স্বর্গে বিষম আস্ফালে।
ভূমিকম্প উল্কাপাত গগনমণ্ডলে।।
প্রচণ্ড পবন বহে নির্ঘাত দুর্ব্বার।
শব্দে সেতুবন্ধে হৈল তরঙ্গ গঙ্গার।।
ঋষি মুনি তপস্বীর ভাঙ্গিল যে ধ্যান।
বন এড়ি পশু ধায় লইয়া পরাণ।।
স্বর্গ মর্ত্ত্য পাতালে লাগিল চমৎকার।
বৃকোদর পড়ে খণ্ডাইয়া ক্ষিতিভার।।
যুধিষ্ঠির দেখেন পড়িল ভীম ভাই।
মুর্চ্ছিত হইয়া শোকে পড়েন তথাই।।
কতক্ষণে চেতন পাইয়া নৃপবর।
হাহাকার করিয়া ডাকেন বৃকোদর।।
মরিবারে কৈলা ভাই স্বর্গ অরোহণ।
প্রাণের অধিক ভাই অতুল বিক্রম।।
সংসার হইল শূণ্য তোমার বিহনে।
শুনিয়া পাইল ভয় গিরিবাসীগণে।।
যার পরাক্রমে তিন লক্ষ হাতী মরে।
হেন ভাই পড়ে মম পর্ব্বত উপরে।।
কারে লয়ে যাব স্বর্গে দেখিতে মুরারী।
কেবা জিজ্ঞাসিবে পথে বচন চাতুরী।।
কে আর তারিবে বনে দুষ্ট দৈত্য হাতে।
কে আর করিবে গর্বব কৌরব মারিতে।।
কিবা লয়ে যাব স্বর্গে দেখিবারে হরি।
ভাই সব মরে মম বৃথা প্রাণ ধরি।।
যবে জতুগৃহ কৈল দুষ্ট দুর্য্যোধন।
পাপ পুরোচন পুরী করিল দাহন।।
চলিতে না পারি সুড়ঙ্গের পথ ঘোর।
পঞ্চজনে লয়ে ভাই গেলে একেশ্বর।।
হিড়িন্বেরে মারিয়া হিড়েম্বা কৈলে বিভা।
কত দৈত্য পলাইল দেখি তব প্রভা।।
ব্রাহ্মণেরে রক্ষা কৈলে বিনাশিয়া বকে।
লক্ষ রাজা জিনিয়া লভিলে দ্রৌপদীকে।।
ইন্দ্রপ্রস্থে রাজা হৈনু তোমার প্রতাপে।
মরিল কীচক বীর তব বীর দাপে।।
বিরাটেরে মুক্ত কৈলা সুশর্ম্মার ঠাঁই।
মম বাক্য বিনা কিছু না জানিতে ভাই।।
জরাসন্ধ বধ কৈলা মগধপ্রধান।
জটাসুর মারি বলে কৈলে পরিত্রাণ।।
নিঃক্ষত্রা করিলে ক্ষিতি ভারত সমরে।
মম সঙ্গে আইলে যাইতে সুরপুরে।।
তবে কেন এড়ি মোরে পড়িলে পর্ব্বতে।
উত্তর না দেহ কেন ডাকি স্নেহমতে।।
পর্ব্বতে পড়িলে ভাই ছাড়িয়া আমারে।
কে পথ বৃত্তান্ত জিজ্ঞাসিবে বারে বারে।।
বনবাসে বঞ্চিলাম তোমার সাহসে।
অষ্টাশী সহস্র দ্বিজ ভুঞ্জে মৃগমাংসে।।
আমরা নিদ্রিত হৈলে থাকিতে জাগিয়া।
আমারে ত্যজিয়া কেন রহিলে শুইয়া।।
বড় দুঃখ দিয়া গেলে আমার অন্তরে।
উঠহ প্রাণের ভাই উঠ ধরি করে।।
মম বাক্যবশ ভাই মম বাক্যে স্থিত।
তোমা সবা বিনা ভাই জীতে মৃত্যুবৎ।।
যে ‍কালে আইনু ধৃতরাষ্ট্র ভেটিবারে।
অন্ধের আছিল ক্রোধ তোমা মারিবারে।।
গোবিন্দ রাখেন তোমা লৌহভীম দিয়া।
হেন ভাই নিদ্রা যায় পর্ব্বতে পড়িয়া।।

এত বলি ভূপতি কান্দেন উচ্চৈঃস্বরে।
চারি ভাই ভার্য্যা ভাবি আকুল অন্তরে।।
লক্ষণ পড়িল যবে রাবণের শেলে।
ক্রন্দন করেন রাম ভাই লয়ে কোলে।।
সেইমত কান্দিলেন ভীমে কোলে লৈয়া।
হিমে তনু কাঁপে তবু ব্যাকুল কান্দিয়া।।
প্রবোধ করিতে আর নাহি কোনজন।
ধর্ম্মরাজ করিলেন অরণ্যে রোদন।।
জননীরে স্মরিয়া কহেন শোক পাই।
এ হেন দুঃখীরে কেন গর্ভে দিলে ঠাঁই।।
শৈশবে মরিল পিতা না পড়ি সে শোকে।
পিতামহ ভীষ্মদেব পালিল সবাকে।।
হিংসা হেতু বিষলাড়ু ভীমে খাওয়াল।
পাপ দুর্য্যোধন যারে ভাসাইয়া দিল।।
উদ্দেশ না পেয়ে কান্দে জননী আমার।
সাত দিন মাতা মম কৈল অনাহার।।
অনন্ত করিয়া কৃপা দিল প্রাণদান।
তাহে না মরে ভাই পাইলে পরিত্রাণ।।
দেখিবারে গোবিন্দে আইল স্বর্গপুরী।
না পাইলে দেখিতে সে প্রসন্ন শ্রীহরি।।
হায় বীর পার্থ কৃষ্ণা সুন্দর নকুল।
হায় সহদেব বীর বিক্রমে অতুল।।
হায় বিধি মম ভাগ্যে কি আছে না জানি।
মম কর্ম্মে এত দুঃখ লিখিলা আপনি।।
কোন জন্মে আমার আছিল কোন পাপ।
সে কারণে দহে তনু শোকেতে সন্তাপ।।
কি করিণু কি হইল আর কিবা হয়।
এত বলি কান্দিলেন ধর্ম্মের তনয়।।
হায় কুন্তী পিতা পাণ্ডু কোথা গেলে ছাড়ি।
হায় দুর্য্যোধন অন্ধ বিদুর গান্ধারী।।
হায় ভীষ্ম কর্ণ দ্রোণ পাঞ্চাল কুমারী।
তোমা সবাকার শোক সহিতে না পারি।।
হায় ভীমার্জ্জুন হায় মাদ্রীপুত্র ভ্রাতা।
হায় কৃষ্ণা প্রাণপ্রিয়া তুমি গেলে কোথা।।
এক দণ্ড কোথা না যাইতে আজ্ঞা বিনে।
তবে আমা একা রাখি ছাড়ি গেলে কেনে।।
সব দুঃখ যায় যদি পাপ আত্মা ছাড়ি।
এত বলি কান্দিলেন ভূমিতলে পড়ি।।

কতক্ষণে স্থির হইয়া ধর্ম্মের তনয়।
ক্রন্দন সম্বরি রাজা ভাবেন হৃদয়।।
কোন পাপে বৃকোদর স্বর্গ নাহি গেল।
এই কথা ভূপতির মনেতে হইল।
মিথ্যা বলি দ্রোণ গুরু বিনাশিল রণে।।
স্বর্গে নাহি গেল ভাই ইহার কারণে।
এই চিন্তা করি রাজা ভাবিত অন্তরে।।
একান্তে গোবিন্দ চিন্তি চলেন উত্তরে।
ভারত পঙ্কজ রবি মহামুনি ব্যাস।
যাঁহার চরিত্র তিন ভুবনে প্রকাশ।।
ভীমের প্রয়াণ যেবা শুনে শুদ্ধভাবে।
পরম কৃষ্ণের পদ সেইজন পাবে।।
কাশীদাস দেব কহে গোবিন্দ ভাবিয়া।
তরিবে শমন দায় শুন মন দিয়া।।