০৪. মেঘবর্ণ পর্ব্বতে পাণ্ডবগণের গমণ ও ভীমের হস্তে ভীষণা রাক্ষসীর মৃত্যু।

মুনি বলে শুনহ নৃপতি জন্মেজয়।
গেলেন উত্তরমুখে পাণ্ডুর তনয়।।
মেঘবর্ণ নামে গিরি অতি ভয়ঙ্কর।
অরোহেণ পাণ্ডুপুত্র তাহার উপর।।
ছত্রিশ যোজন সেই পর্ব্বত প্রসর।
অতি অনুপম যেন সুমেরু শিখর।।
তথায় থাকিয়া মেঘ বর্যে চারি মাস।
নানা শব্দে কোলাহল দেখিলা তরাস।।
সেইত পর্ব্বত রক্ষা করে দেবগণ।
পূর্ণচন্দ্র সদা তথা করে সুশোভন।।
মেঘগণ আছে তথা অতি ভয়ঙ্কর।
দিবা রাত্র নাহি জানি পর্ব্বত উপর।।
পঞ্চনারী বৈসে সুখে সুবর্ণের পুরে।
কিন্নরী জিনিয়া শোভা করে অলঙ্কারে।।

যুধিষ্ঠিরে দেখি বলে নারী পঞ্চজন।
কোথা হৈতে আসিয়াছ তুমি বিচক্ষণ।।
মনুষ্যের শ্রেষ্ঠ তুমি বুঝিনু কারণে।
বহু দুঃখ পাইয়াছ হেন লয় মনে।।
নয় কোষী অন্তঃ লৈয়া থাক এই ভূমি।
আপন ইচ্ছায় স্বামী করিলাম আমি।।
আমার নগর দেখ অতি রম্য পুরী।
তুমি স্বামী হইলে সেবিব কোটি নারী।।
দ্বিতীয় স্বর্গের সুখ পাইবে হেথায়।
রাজ্য কর যত দিন চন্দ্র সূর্য্য রয়।।

কন্যার বচন শুনি ধর্ম্মের তনয়।
যোড়হাতে কহিছেন অতি সবিনয়।।
সঙ্কল্প করিনু আমি সবার সাক্ষাতে।
স্বর্গপুরী যাইব দেখিব জগন্নাথে।।
কলি আগমন হয় ইহার কারণ।
স্বর্গে যাই অনুজ্ঞা দিলেন নারায়ণ।।
দয়া করি মোরে বর দেহ কন্যাগণ।
স্বর্গে গিয়া দেখি যেন বিষ্ণুর চরণ।।

এত বলি তথা হৈতে করিয়া গমন।
উত্তরমুখেতে যান পাণ্ডুর নন্দন।।
হেনকালে সেই পথে ভাষণী রাক্ষসী।
মুখ মেলি পর্ব্বত শিখরে আছে বসি।।
স্বর্গ মর্ত্ত্য যুড়ি কায় অতি ভয়ঙ্কর।
বদন দেখিয়া ভয় করে দিবাকর।।
বিশাল রাক্ষসী পথ আগুলিয়া রহে।
বিপুল মনুষ্য দেখি খাইবারে চাহে।।

ধর্ম্ম বলিলেন, দেখ ভাই বৃকোদর।
মুখ মেলি খেতে চায় দুষ্ট নিশাচর।।
ভয় হয় মনে, দেখি মূর্ত্তি ভয়ঙ্কর।
চারি ক্রোশ পথ যুড়ি দীর্ঘ কলেবর।।
কিরূপে যাইব পথে করিল আটক।
দীপ্তমান তেজ যেন জলন্ত পাবক।।
দ্রৌপদীর ভয় হৈল রাক্ষসী দেখিয়া।
ভয়েতে অর্জ্জুন বীরে ধরিল চাপিয়া।।
শঙ্খপাণি নামে মুনি বৈসে সেই বনে।
যুধিষ্ঠির জিজ্ঞাসা করেন তাঁর স্থানে।।
কি হেতু রাক্ষসী বাস করে স্বর্গপথে।
সর্ব্বকালে আছে, কিম্বা এল কোথা হতে।।

শুনি মুনি বলিলেন বচন গভীর।
রাক্ষসীর বিবরণ শুন যুধিষ্ঠির।।
চিত্রা নামে স্বর্গপুরে আছিল অপ্সরী।
দুর্ব্বাসা মুনির শাপে হৈল নিশাচরী।।
ক্ষুধায় না থাকে এই মায়াবী রাক্ষসী।
যারে পায় তারে খায় কিবা যোগী ‍ঋষি।।
তপস্বী সন্ন্যাসী মুনি মৃগ পক্ষী নরে।
পাইলে আনন্দ মনে সবে গ্রাস করে।।
ক্ষণেকে অপ্সরী হয়ে সুরে মন মোহে।
নবরূপ পক্ষীরূপ ইচ্ছা হয় যাহে।।
বকাসুর নামে ছিল রাক্ষস দুরন্ত।
তাহার ভগিনী এই শুনহ তদন্ত।।
শক্তি যদি থাকে, দুষ্টে করহ সংহার।
নহে ধরি নিশাচরী করিবে আহার।।
এত শুনি বৃকোদর হৈল আগুয়ান।
দম্ভ করি কহিল রাক্ষসী বিদ্যমান।।
বকাসুর‍ নামে যেই তোর জ্যেষ্ঠ ভাই।
তারে ‍মারিয়াছি আমি তোরে না ডরাই।।

এত বলি মহাক্রোধে বীর বৃকোদর।
পর্ব্বতের শৃঙ্গ দৃই ভাঙ্গিল সত্বর।।
টান দিয়া একখান মারে রাক্ষসীরে।
মুখ মেলি রাক্ষসী গিলিল কোপভরে।।
দেখি কোপে আর শৃঙ্গ মারে বৃকোদর।
লুফিয়া ‍রাক্ষসী ধরে পর্ব্বত শিখর।।
রক্তাক্ষি রাক্ষসী কোপে চাহে চারিপাশে।
বড় বৃক্ষ ভাঙ্গে তার নাসার নিশ্বাসে।।
ভীমের সাক্ষাতে শব্দ করে ভয়ঙ্কর।
দেবাসুর কম্পমান সিন্ধু ধরাধর।।
রাক্ষসীর ঘোর শব্দ ঘন হুহুঙ্কার।
কোপে থর থর অঙ্গ পবনকুমার।।
উপাড়িল সেই বৃক্ষ দিয়া এক টান।
পদভরে পর্ব্বত হইল কম্পবান।।

ভীম বলে নিশাচরী দেখ এই বৃক্ষ।
বজ্রসম প্রহারে ভাঙ্গিব তোর বক্ষ।।
এত বলি হাতে গাছ আসে বায়ুবেগে।
রাক্ষসী কাটিয়া পাড়ে দশনের আগে।।
না মরে রাক্ষসী সেই নাহি ছাড়ে পথ।
দেখি ধর্ম্ম চিন্তিত হলেন মনোগত।।
বীর বৃকোদর পুনঃ গোবিন্দ ভাবিয়া।
সুররাজ পর্ব্বত আনিল টান দিয়া।।
ভীম বলে নিশাচরী শুন রে ভাষণা।
মনে না করিহ আর বাঁচিতে কামনা।।
মুনি ঋষি খেয়ে তোর বেড়েছে বাসনা।
আজ যুদ্ধে দেখাইব যমের যাতনা।।
এত বলি দুই হাতে পর্ব্বত ধরিয়া।
রাক্ষসীরে প্রহারিল হুঙ্কার ছাড়িয়া।।
আইসে পর্ব্বত দেখি গগনের পথে।
লাফ দিয়া রাক্ষসী ধরিল বাম হাতে।।
বলবতী নিশাচরী শঙ্করের বরে।
ফেলাইয়া দিল গিরি দক্ষিণ সাগরে।।
দেখিয়া বিস্ময়াপন্ন হৈল ভীমবীর।
কি হবে উপায় চিন্তিলেন যুধিষ্ঠির।।
তবে বৃকোদর বীর বিষন্ন বদনে।
ব্যাকুল হইল বীর রাক্ষসীর রণে।।
নাহি মরে নিশাচরী নাহি ছাড়ে পথ।
মুখ মেলি গ্রাসে যেন আদিত্যের রথ।।
মনে ভাবি ভীমসেন হইল বিস্ময়।
জনক পবনে চিন্তে সঙ্কট সময়।।
পুত্রে পার কর পথে পিতা প্রভঞ্জন।
তোমার প্রসাদে তবে দেখি নারায়ণ।।

এত বলি বৃকোদর ডাকিল পবনে।
ডাক দিয়া পবন বলিল ভীমসেনে।।
শুন পুত্র বৃকোদর না হও ভাবিত।
কি কার্য্য তোমার রণে করিব বিহিত।।
জোড়হাতে বলে ভীম বন্দিয়া চরণ।
রাক্ষসী মারিলে হয় স্বর্গ আরোহণ।।
এই কর্ম্ম কর পিতা হর তার বল।
ঘুষিবে তোমার যশ অবনীমণ্ডল।।
এত শুনি হাসিয়া বলিলেন পবন।
তব তেজঃ হৌক পুত্র আমার সমান।।
বাহুবলে রাক্ষসীরে করহ সংহার।
বহু সুখে সুরপরে কর আগুসার।।
বৃক্ষ লয়ে বৃকোদর মারে মালসাট।
চালাইয়া দিল বৃক্ষ নাসিকার বাট।।
রাক্ষসী নিস্তেজ হল ভীমের প্রহারে।
লোটাইয়া পড়ে ভূমে ছটফট করে।।
দেখিয়া হইল ভীম প্রফুল্ল অন্তর।
লম্ফ দিয়া উঠিলেন বুকের উপর।।
নাসাপথে উঠে বৃক্ষ ভেদি তার মুণ্ড।
হস্ত পদ চিরিয়া করিল খণ্ড খণ্ড।।
আকর্ষণ করি করে উপাড়িল স্তন।
বজ্র কিলে ভাঙ্গিলেন দুপাটি দশন।।
মস্তক ঢুকায় তার পেটের ভিতরে।
গলা চাপি ধরিয়া বধিল ‍রাক্ষসীরে।।
মাংসপিণ্ড সম কৈল কচ্ছপের হেন।
পূর্ব্বেতে কীচক বীর বিনাশিল যেন।।
কুষ্মাণ্ড সমান কৈল রাক্ষসীর কায়।
মহাক্রোধে পদাঘাত মরিলেক তায়।।
ঘোর শব্দ করিয়া মরিল নিশাচরী।
আনন্দিত বৃকোদর বিক্রমে কেশরী।।
অন্তরীক্ষে তুলে তারে বৃক্ষে জড়াইয়া।
ঘন পাক দিয়া ফেলে ভূমে আছাড়িয়া।।
দেবাসুর নাগ নর দেখি বিদ্যমান।
গন্ধমাদনেরে যেন লুফে হনুমান।।
অন্তরীক্ষে শত পাক দিয়া রাক্ষসীরে।
ফেলাইয়া দিল তারে দক্ষিণ সাগরে।।
ভীষণা রাক্ষসী মারি ভীম মহাবীর।
শীঘ্রগতি গেল যথা রাজা যুধিষ্ঠির।।
(মিসিং)

ভারত পঙ্কজরবি মহামুনি ব্যাস।
পাঁচালী প্রবন্ধে বিরচিল কাশীদাস।।