০৫. গান্ধারী প্রভৃতি স্ত্রীগণের যুদ্ধস্থলে গমন ও স্ব স্ব পতি পুত্রের মৃতদেহ দর্শনে খেদ

মহাভয় উপজিল দেখি রণস্থল।
শকুনি গৃধিনী শিবা করে কোলাহল।।
হাতে মুন্ড করিয়া নাচয়ে ভূতগণ।
কুক্কুর করিছে মাংস শোণিত ভক্ষণ।।
রক্তের কর্দ্দমে শীঘ্র চলিতে না পারে।
শোকাকুলা নারীগণ যায় ধীরে ধীরে।।
কেহ কেহ না পাইয়া পতি দরশন।
ভূমিতে পড়িয়া তারা করয়ে ক্রন্দন।।
ভ্রময়ে সমরস্থলে যত করুনারী।
শিবা শ্বান পক্ষিগণে ভয় নাহি করি।।
অনেক যতনে কেহ নিজ পতি পায়।
স্কন্ধে মুন্ড যোড়া দিতে মহাব্যগ্র হয়।।
দুই হস্তে ধরে কেহ পতির চরণ।
বিলাপয়ে মুখে মুখ করিয়া মিলন।।
পাসরিলে পূর্ব্বকার প্রেমরস যত।
হাস্য পরিহাস তাহা স্মরাইব কত।।
সমর করিতে গেলে কেমন কুক্ষণে।
পুনঃ না হইল দেখা অভাগিনী সনে।।
হেনমতে পতি লয়ে অনেক সুন্দরী।
বিলাপ করয়ে সবে নানামত করি।।
তা দেখি গান্ধারী প্রাণ ধরিতে না পারে।
পতিশোকে বধূগণ প্রাণ ধরিতে না পারে।
পতিশোকে বধূগণ কান্দে উচ্চৈঃস্বরে।।
রণভূমি দেখি দেবী অতি ভয়ঙ্কর।
কপালে কঙ্কণ মারি কান্দিল বিস্তর।।
হেন কেহ নাহি তথা প্রবোধ করিতে।
সবে শোকে অচেতন পড়িয়া ভূমিতে।।
কেবা কোথা পড়িয়াছে নাহিক উদ্দেশ।
রণভূমি দেখি দেবী লাগে ভরাবেশ।।
মড়ার উপরে মড়া লেখা নাহি তার।
গান্ধারী দেখিয়া চিত্তে লাগে চমৎকার।।
গজবাজী পড়িয়াছে রথ বহুতর।
নানা অলঙ্কার বস্ত্র শস্ত্র মনোহর।।
মাথার মুকুট পড়িয়াছে রণভূমে।
মকর কুন্ডল পড়িয়াছে নানাক্রমে।।
ধ্বজছত্র চামর পড়েছে রণস্থলে।
ডাকিনী যোগিনীগণ করে নানা কেলী।।
স্বামী পুত্র পৌত্র আর বন্ধু সহোদর।
পড়িয়া আছয়ে যত মৃত কলেবর।।
দুর্য্যোধন অন্বেষণে বুলয়ে গান্ধারী।
কতদূরে দেখে হত কুরু অধিকারী।।
ধূলায় পড়িয়া আছে রাজা দুর্য্যোধন।
গান্ধারী দেখিল সঙ্গে লৈয়া বধূগণ।।
পুনঃ দরশনে দেবী অজ্ঞান হইল।
গান্ধারী মরিল বলি সকলে ভাবিল।।
পঞ্চ পান্ডবেতে তাঁরে তুলিয়া ধরিল।
শ্রীকৃষ্ণ সাত্যকি আদি বহু প্রবোধিল।।
সন্বিত পাইয়া তবে গান্ধার তনয়া।
চাহিয়া কৃষ্ণেরে বলে শোকাকুল হৈয়া।।
দেখ কৃষ্ণ পড়িয়াছে রাজা দুর্য্যোধন।
সঙ্গেতে নাহিক কেন কর্ণ দুঃশাসন।।
শকুনি সঙ্গেতে কেন না দেখি রাজার।
কোথা ভীষ্ম মহাশয় শান্তনুকুমার।।
কোথঅ দ্রোণাচার্য্য কোথা কৃপ মহাশয়।
একেলা পড়িয়া কেন আমার তনয়।।
কোথা সে কুন্ডল কোথা মণি মুক্তাস্রজ।
কোথা গেল হস্তী ঘোড়া কোথা বথধ্বজ।।
একাদশ অক্ষৌহিণী যার সঙ্গে যায়।
হেন রাজা দুয্যোর্ধন ধূলাতে লুটায়।।
সুবর্ণের খাটে যার সতত শয়ন।
হেন তনু ধূলার উপরে নারায়ন।।
জাতি যূতী পুষ্প আর চাঁপা নাগেশ্বর।
বকুল মালতী আর মল্লিকা সুন্দর।।
এ সকল পুষ্পে পুত্র থাকিতে শুইয়া।
হেন তনু লোটে ভুমে দেখহ চাহিয়া।।
অগুরু চন্দন গন্ধ কুঙ্কুম কস্তরী।
লেপন করিতে সদা অঙ্গের উপরি।।
শোণিতে সে তনু আজি হইল শোভন।
আহা মরি কোথা গেল রাজা দুর্য্যোধন।
ত্যজহ আলস্য কেন না দেহ উত্তর।
যুদ্ধ হেতু তোমারে ডাকিছে বৃকোদর।।
উঠ পুত্র ত্যজ নিদ্রা অস্ত্র লহ হাতে।
গদাযুদ্ধ কর গিয়া ভীমের সহিতে।।
কৃষ্ণার্জ্জুন ডাকিছেন যুদ্ধের কারণ।
প্রত্যুত্তর নাহি কেন দেহ দুর্য্যোধন।।
এত বলি গান্ধারী হইল অচেতন।
প্রিয়ভাষে কৃষ্ণচন্দ্র করেন সান্ত্বন।।
শোক না করিও দেবি শুন হিতবানী।
সকল দৈবের খেলা জানহ আপনি।।
দেব দ্বিজ গুরু নিন্দা এ সব কুকর্ম্ম।
বেদে বুঝাইল ইহা না করিলে ধর্ম্ম্‌।।
দুষ্কর্ম্ম দুঃসহ ত্যজি থাকিলে সুপথে।
ইহা সুখভোগী অন্তে যায় যে স্বর্গেতে।।
না জানিয়া কুকর্ম্ম করয়ে যেই জন।
পরিনামে দুঃখ পায় বেদের বচন।।
অহঙ্কারে অধর্ম্ম করয়ে নিরন্তর।
অবশেষে কর্ম্ম তার হয়ত দুষ্কর।।
না শুনে সুজন বাক্য মত্ত অহঙ্কারে।
অবশেষে সেইজন যায় ছারেখারে।।
কিন্তু এ সকল ঘটে নিজ কর্ম্মগুণে।
শোক দূর কর দেবি কান্দ কি কারণে।।
শুভাশুভ কর্ম্ম যত বিধির ঘটন।
ভোগ বিনা ক্ষয় নহে শাস্ত্রের লিখন।।
কালে আসি জন্মে পাপী কালেতেই মরে।
কালবশ এই সব জানাই তোমারে।।
না কর দেবনা তুমি শুন নৃপজায়া।
বুঝিতে না পারে কেহ বিধাতার মায়া।।
বিজয় পান্ডব কথা অমৃত লহরী।
শুনিলে অধর্ম্ম খন্ডে পরলোকে তরি।।
কিছুমাত্র বলি আমি রচিয়া পয়ার।
অবহেলে শুনে সেই তরয়ে সংসার।।
কাশীরাম দাসের সদাই এই মন।
নিরবধি রচে মহাভারত কথন।।