০৪. ধৃতরাষ্ট্র কর্ত্তৃক লৌহ-ভীম চূর্ণ করণ

সঞ্জয় রাজারে ধরি বসায় আসনে।
বসিলেন পঞ্চভাই রাজ বিদ্যমানে।।
সাত্যকি সহিত কৃষ্ণ বসেন আপনি।
হেনকালে বলে ধৃতরাষ্ট্র নৃপমণি।।
কোথা ভীম আইসহ দিব আলিঙ্গন।
তুমি মম ঘুচাইলে পিন্ড প্রয়োজন।।
ঊরু ভাঙ্গি মারিলেক নৃপতি দুর্য্যোধনে।
এ‌কে একে সংহারিলে শতেক নন্দনে।।
শুনিয়া আমার হৈল হরিষ বিষাদ।
এস আলিঙ্গন দিয়া করিব প্রসাদ।।
এতেক বলিয়া রাজা বাড়াইল হাত।
নৃপতির অভিপ্রায় জানি রমানাথ।।
আছিল লোহার ভীম দিলেন গোচরে।
ধৃতরাষ্ট্র নৃপতির আনন্দ অন্তরে।।
ধরিয়া লোহার ভীম চাপিল কোলেতে।
অযুত হস্তীর বল রাজার দেহেতে।।
ভাঙ্গিল লোহার ভীম মহাশব্দ শুনি।
চুর্ণ হয়ে পৃথিবীতে পড়িল তখনি।।
কপটে কান্দয়ে রাজা হৃদয়ে উল্লাস।
মনেতে জানিল ভীম হইল বিনাশ।।
পুত্রশোকে নরপতি না শুনয়ে কাণে।
ভীম মরিলেক বলি হরষিত মনে।।
নৃপতির দশা তবে দেখ নারায়ণ।
হাসিয়া বলেন সুধা মধুর বচন।।
শুন বৃদ্ধ নরপতি না কান্দহ আর।
কুশলে আছেন ভীম পান্ডুর কুমার।।
তোমার জন্মিবে ক্রোধ ইহা অনুমাণি।
গঠিত লোহার ভীম দিনু নৃপমণি।।
বিষাদ না কর তুমি শান্ত কর মন।
ভীমেরে মারিলে নাহি পাবে দুর্য্যোধন।।
আর কেন অপযশ রাখিবা ঘুষিতে।
শুদ্ধচিত্ত হও রাজা জানাই তোমাতে।।
আপনি কহিলা পূর্ব্বে শুনহ রাজন।
আপন তনয় যেন পান্ডুর তেমন।।
তবে কেন হেন কর্ম্ম করিলা ‍রাজন।
বুঝিলাম খল কভু নহে শুদ্ধ মন।।
কোন অংশে পান্ডবের নাহি অপরাধ।
আপনি করিলা তুমি নিজ কর্ম্ম বাদ।।
ভীমে বিষ খাওয়াল রাজা দুর্য্যোধন।
জতুগৃহে রাখিলেন পান্ডুর নন্দন।।
তবে শকুনিরে আজ্ঞা দিল নরপতি।
পাশা খেলাইল যুধিষ্ঠিরে সংহতি।।
প্রতিজ্ঞা করিয়া ধর্ম্ম সর্ব্বস্ব হারিল।
দুঃশাসন দ্রৌপদীর চুলেতে ধরিল।।
আপনি অনীতি করিলেক দুর্য্যোধন।
জয়দ্রথে দিয়া করে দ্রৌপদী হরণ।।
তথাপিও পান্ডবের ক্রোধ না জন্মিল।
তবে দুর্য্যোধন দুর্ব্বাসারে পাঠাইল।।
আপনি সকল জান তুমি মহাশয়।
কিছু দোষ নাহি করে পান্ডুর তনয়।।
অন্যায় করিল যুদ্ধ তোমার নন্দন।
অভিমন্যু বেড়িয়া মারিল সপ্তজন।।
পশ্চাতে পান্ডব পরাক্রম প্রকাশিল।
প্রতিজ্ঞা কারণে সর্ব্ব কৌরবে মারিল।।
বেদশাস্ত্র জান তুমি আগম পুরাণ।
সজ্ঞান নাহিক কেহ তোমার সমান।।
আপনি জানহ পান্ডবের যত দোষ।
তবে কি লাগিয়া কর এ সব আক্রোশ।।
ভীষ্ম দ্রোণ বিদ্যুর যতেক বুঝাইল।
দুষ্টমতি দুর্য্যোধন বাক্য না শুনিল।।
অধিক সকল গুণে হয় পঞ্চ ভাই।
আপনি সকল জান কি হেতু বুঝাই।।
জানিয়া না জান তুমি সকল উহার।
কি কারণে নাহি বুঝ উচিত বিচার।।
কেবল পুত্রেরে চাহি কর অপকর্ম্ম।
ভীমেরে মারিয়া কেন বিনাশিবে ধর্ম্ম ।।
কি দোষ করিল ভীম বলহ রাজন।
না বুঝিয়া কেন কর হেন আচরণ।।
কদাচিত পান্ডবেরে ক্রোধ না করিহ।
অধর্ম্ম হইবে মম বচন পালহ।।
কৃষ্ণের বচন শুনি অন্ধ নরপতি।
পান্ডবে আলিঙ্গিল হইয়া হৃষ্টমতি।।
গান্ধারীর মন আছে শাপিব পান্ডবে।
হেনকালে বলিলেন বাসুদেব তবে।।
শুন দেবী পাসরিলে তুমি পূর্ব্বকথা।
সতীর বচন কভু না হয় অন্যথা।।
যাত্রাকালে তোমা জিজ্ঞাসিল দুর্য্যোধন।
কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধেতে জিনিবে কোনজন।।
পান্ডবের সঙ্গে যাই যুদ্ধ করিবারে।
জয় পরাজয় কার বলহ আমারে।।
তবে সত্য কথা তুমি কহিলে তখন।
যথা ধর্ম্ম তথা জয় শুন দুর্য্যোধন।।
তোমার বচন যদি অন্যথা হইবে।
তবে কেন চন্দ্র সূর্য্য আকাশে রহিবে।।
সে সব বচন সত্য মম মনে লয়।
অতএব যুদ্ধ জিনে পান্ডুর তনয়।।
ত্যজহ সকল ক্রোধ আমার বচনে।
পুত্র ভাব কর পঞ্চ পান্ডুর নন্দনে।।
এত যদি বাসুদেব কহিলেন বাণী।
যোড়হাতে বলিলেন অন্ধ রাজরানী।।
যত কিছু মহাশয় বলিলে বচন।
বেদের সমান তাহা করিনু গ্রহন।।
কিন্তু হৃদয়ের তাপ সহিতে না পারি।
একশত পুত্র মোর গেল যমপুরী।।
ত্যাজিলাম সব ক্রোধ তোমার বচনে।
পুত্র সম স্নেহ হৈল পান্ডুর নন্দনে।।