৩০. ভীষ্মের পতন

সঞ্জয় বলেন, শুন অন্ধ নরবর।
ভীষ্ম পার্থ দুইজনে করেন সমর।।
শেষ রণ জানি ভীষ্ম যুঝে প্রাণপণ।
পাশাক্রীড়া কাল স্মরি পার্থ করে রণ।।
দুই দলে মিশামিশি যুদ্ধ পরস্পরে।
লাখে লাখে বীর পড়ে সমর ভিতরে।।
যোদ্ধা দশ সহস্র মারিল ভীষ্ম বীর।
দিনের প্রতিজ্ঞা রাখে নির্ভয় শরীর।।
অর্জ্জুনের প্রতি হরি বলেন বচন।
শিখণ্ডীকে আগে রাখি মার অস্ত্রগণ।।
অর্জ্জুন বলেন, শুন দেবকী-তনয়।
এমত কপট যুদ্ধ উচিত না হয়।।
শ্রীহরি বলেন, পার্থ শুনহ উত্তর।
ভীষ্মে মারি পরাজয় কর কুরুবর।।
এত বলি শিখণ্ডীকে রথে বসাইল।
দেখিয়া ত ভীষ্মবীর অস্ত্র ত্যাগ কৈল।।
অস্ত্র ত্যাগ করি ভীষ্ম হেঁটমুণ্ড হয়ে।
কহিতে লাগিল বীর কৃষ্ণেরে চাহিয়ে।।
ওহে প্রভু নারায়ণ যাদব-ঈশ্বর।
আমারে মারিবে করি কপট সমর।।
এতেক বলিয়া বীর নানা স্তুতি করে।
পুলকে বলিয়া নাম বলে উচ্চৈঃস্বরে।।
তবে ত শিখণ্ডী ক্রোধে নিল ধনুর্ব্বাণ।
ভীষ্মের উপরে মারে পূরিয়া সন্ধান।।
শত শত বাণ মারে বাছিয়া বাছিয়া।
অর্জ্জুন শিখান তারে বহু বুঝাইয়া।।
শিখণ্ডী এড়য়ে বাণ হইয়া নির্ভয়।
সহস্রেক বাণে বিন্ধে ভীষ্মের হৃদয়।।
নাহিক সম্ভ্রম তার, না জানে বেদন।
মৃগীর প্রহারে যেন মৃগেন্দ্রের মন।।
হাসিয়া অর্জ্জুন হাতে লইলেন ধনু।
পঞ্চবিংশ বাণে তাঁর বিন্ধিলেন তনু।।
শত লক্ষ বাণ মারিলেনে একবারে।
ভীষ্মের কবচ ভেদি রক্ত পড়ে ধারে।।
অর্জ্জুনের বাণ সব অগ্নিসম ছুটে।
ভীষ্মের শরীরে যেন বজ্রসম ফুটে।।
গঙ্গার নন্দন বিচারেন মনে মন।
এই অস্ত্র শিখণ্ডীর না হয় কখন।।
শিখণ্ডী-পশ্চাতে থাকি পার্থ ধনুর্দ্ধর।
আমারে মারিছে বীর তীক্ষ্ণ তীক্ষ্ণ শর।।
এত চিন্তি হরিপদ হৃদে ধ্যান করি।
মুখেতে কহেন উচ্চে শ্যীহরি শ্রীহরি।।
বাণাঘাতে দেহ কাঁপে অতি ঘনে ঘন।
শিশির কালেতে যেন কাঁপয়ে গো-ধন।।
ধনঞ্জয় আপনার অস্ত্র বরিষণে।
রোমে রোমে বিন্ধিলেন গঙ্গার নন্দনে।।
সর্ব্বাঙ্গ ভেদিল অস্ত্রে, স্থান নাহি আর।
সর্ব্বাঙ্গ বহিয়া পড়ে শোনিতের ধার।।
তবে পার্থ দিব্য অস্ত্র নিলেন তখন।
পিতামহ-বক্ষঃস্থলে করেন ঘাতন।।
কবচ ভেদিয়া বাণ মর্ম্মেতে পশিল।
রথ হৈতে ভীষ্ম বীর ভূমিতে পড়িল।।
সমরে পড়িল বীর পূর্ব্ব শির হৈয়া।
আকাশের চন্দ্র যেন পড়িল খসিয়া।।
অল্পমাত্র শেষ কিছু আছে দিবাকর।
ভীষ্ম বীর পড়িল অস্থির কুরুবর।।
আকাশেতে দেবগণ করে হাহাকার।
পাণ্ডবে বেড়িয়া কৈল ভীষ্মেরে সংহার।।
সহস্রেক বাণ আছে ভীষ্মের শরীরে।
ভূমিতে না পড়ে ভীর রহে শূন্যোপরে।।
পূর্ব্বকথা স্মরিয়া হইলা সংজ্ঞাহীন।
শয়নেতে স্বপ্ন দেখে অয়ন দক্ষিণ।।
দক্ষিণ অয়নে মৃত্যু না হয় উচিত।
উত্তর অয়নে চিন্তে যাইব নিশ্চিত।।
সেইকালে বৃষ্টি কৈল কাঁপিল মেদিনী।
অন্তরীক্ষে দেবগণ বলিলেন বাণী।।
গঙ্গার তনয় তুমি সর্ব্বশাস্ত্রে জ্ঞানী।
দক্ষিণ অয়নে তুমি কেন ছাড় প্রাণী।।
শুনিয়া বলেন ভীষ্ম প্রাণ আছি ধরি।
উত্তরায়ণের সূর্য্য অপেক্ষা যে করি।।
বুঝিবারে ভীষ্ম-মন গঙ্গা ততক্ষণ।
হংসগণ পাঠাইল আপন বাহন।।
ভীষ্মের নিকটে বলে প্রদক্ষিণ করি।
গঙ্গা পাঠাইল মোরে চল ত্বরা করি।।
ভীষ্ম বলে যাব আমি উত্তরায়ণ কালে।
শুনি হংস কহে গিয়া গঙ্গার গোচরে।।
কৌরব-ঈশ্বর বীর রণেতে পড়িল।
পাণ্ডবে কহয়ে মহা মেরু উপাড়িল।।
অস্ত্র সম্বরিল সব কুরু পাণ্ডুবল।
সবাকার মনে তবে বিপাক পড়িল।।
পিতামহ পড়ে রণে শুনি কুরুকুল।
মূর্চ্ছিত হইল কেহ কান্দিয়া আকুল।।
শীঘ্র গিয়া দুঃশাসন দ্রোণকে কহিল।
ভীষ্মের পতনে দ্রোণ বড় দুঃখী হৈল।।
কর্ণ দুর্য্যোধন তবে নিঃশ্বাস ছাড়িয়া।
বহু বিলাপয়ে সবে শোকাকুলে হৈয়া।।
ক্ষত্রিয় জন্মেরি নিন্দা করে জনে জন।
ভীষ্মের প্রশংসা করে যত দেবগণ।।
ভীষ্মপর্ব্বে দশম দীনে ভীষ্মের পতন।
দশম অধ্যায় কথা শুনহ রাজন।।
মহাভারতের কথা অমৃত লহরী।
কাশী কহে ভক্তগণ পিয় কর্ণ ভরি।।