১০. কীচকের ঊনশত ভ্রাতা কর্ত্তৃক দ্রৌপদীর লাঞ্ছন ও ভীমহস্তে তাহাদের নিধন

কীচক মরণে কৃষ্ণা আনন্দিত হয়ে।
সভাপাল প্রতি তবে বলিল ডাকিয়ে।।
মোরে যত দুঃখ দিল কীচক দুর্ম্মতি।
দণ্ড দিল গন্ধর্ব্বেরা, যারা মোর পতি।।
অহঙ্কার করি দুষ্ট গন্ধর্ব্বেরা না মানে।
গন্ধর্ব্বে পারিবে কোথা মানুষ পরাণে।।
এত শুনি ধেয়ে আসে যতেক রক্ষক।
মাংসপিণ্ড প্রায় তথা দেখিল কীচক।।
অপূর্ব্ব দেখিয়া লোক মানিল বিস্ময়।
কেহ বলে কীচক এ, কেহ বলে নয়।।
কোথা গেল হস্ত পদ, কোথা গেল শির।
কুষ্মাণ্ডের প্রায় দেখি কাহার শরীর।।
কেহ বলে, গন্ধর্ব্বেরা মারে এইমত।
বার্ত্তা পেয়ে ধেয়ে আসে ভ্রাতা ঊনশত।।
কীচকে বেড়িয়া সবে করয়ে ক্রন্দন।
ভ্রাতা মিত্র বন্ধু যত স্ত্রী পুরুষগণ।।
এইমতে বন্ধুগণ কান্দিয়া অপার।
অগ্নিসংস্কার হেতু করিল বিচার।।
হেনকালে দ্রৌপদীরে দেখি সেইখানে।
দম্ভ করি দাণ্ডাইয়া আছে বিদ্যমানে।।
ক্রোধে সূতপুত্রগণ বলিল বচন।
এই দুষ্টা হৈতে হৈল কীচক নিধন।।
কেহ বলে, না চাহিও এ দুষ্টার পানে।
কেহ বলে, অসতীরে মারহ পরাণে।।
অগ্নিতে পোড়াও এরে কীচক সংহতি।
পরলোকে কীচকের হইবেক প্রীতি।।
বান্ধিয়া ইহারে শীঘ্র শব সহ লহ।
একবারে গিয়া নৃপতিরে জিজ্ঞাসহ।।
বিরাট নৃপতি শুনি কীচক নিধন।
শোকে দুঃখে ক্ষোভে উচ্চে বিলাপে রাজন।।
কোথায় কীচক বীর মোর সেনাপতি।
তোমার বিহনে মোর হবে কোন্ গতি।।
সৈরন্ধ্রী দুষ্টার হেতু কীচক নিধন।
ক্রোধে নরপতি আজ্ঞা দিল সেইক্ষণ।।
তার মুখ আর নাহি দেখিব কখন।
শীঘ্র করি লহ তারে করিয়া বন্ধন।।
পোড়াহ কীচক সহ জ্বালিয়া অনল।
তবে সে আমার অঙ্গ হইবে শীতল।।
আজ্ঞা পেয়ে দ্রৌপদীর বান্ধিল তখন।
শব সহ লইলেক করিয়া বন্ধন।।
তবে ত দ্রৌপদী দেবী না দেখি উপায়।
আকুল হইয়া অতি কান্দে উভরায়।।
জয় বিজয় জয়ন্ত আর জয়ৎসেন।
জয়দ্বল নাম লয়ে উচ্চেতে ডাকেন।।
দুন্দুভির শব্দ যাঁর ধনুক টঙ্কার।
তিনলোকে শক্তিমান, নাহি শত্রু যার।।
তাঁর প্রিয়া বড় আমি, করিল বন্ধন।
শীঘ্রগতি আসি মোরে করহ মোচন।।
এইমত পুনঃ পুনঃ ডাকে যাজ্ঞসেনী।
রন্ধন গৃহেতে থাকি ভীমসেন শুনি।।
ক্রন্দনের শব্দ শুনি উঠিয়া বসিল।
দ্রৌপদীর রব বুঝি হৃদয় কাঁপিল।।
কেশ বেশ মুক্ত বীর বায়ুবেগে ধায়।
পথাপথ নাহি শব্দ অনুসোরে যায়।।
একলাফে ডিঙ্গাইয়া গড়ের প্রাচীর।
আম্বাসিয়া দ্রৌপদীরে কহে মহাবীর।।
না কান্দে সৈরন্ধ্রী দেবী, আসিল গন্ধর্ব্ব।
এখনি মারিবে দুষ্ট সূতপুত্র সর্ব্ব।।
এত বলি উপাড়িল দীর্ঘ তরুবর।
দণ্ডহস্তে যম যেন ইন্দ্র বজ্রকর।।
সবে বলে, হের ভাই গন্ধর্ব্ব আসিল।
পলাহ পলাহ বলি, সবে রড় দিল।।
নগরের মুখ ধরি ধায় বায়ুবেগে।
পাছে ধায় বৃকোদর সিংহ যেন মৃগে।।
আরে আরে দুষ্টাচার সূতপুত্রগণ।
মনুষ্য হইয়া কর গন্ধর্ব্বে হেলন।।
এত বলি মারে বীর দীর্ঘ তরুবর।
এক ঘায়ে ‍মারে ঊনশত সহোদর।।
অশ্রুপূর্ণমুখী কৃষ্ণা আছিল বন্ধনে।
মুক্ত করি বৃকোদর দিল সেইক্ষণে।।
ভীম বলে, দুঃখ নাহি ভাব গুণবতী।
তোমায় হিংসিয়া দুষ্ট লভিল দুর্গতি।।
আজ্ঞা কর, যাব আমি কেহ পাছে জানে।
করহ গমন তুমি আপনার স্থানে।।
এত বলি চলি গেল বীর বৃকোদর।
অন্তঃপুরে গেল কৃষ্ণা সুদেষ্ণার ঘর।।
রজনী প্রভাতে হৈল, আসে সর্ব্বজন।
রাজারে করিল জ্ঞাত রাজমন্ত্রিগণ।।
কীচকে দহিতে গেল যত ভ্রাতৃগণ।
গন্ধর্ব্বে হাতে সব হইল নিধন।।
সবে মারি সৈরন্ধ্রীরে মুক্ত করি দিল।
সৈরন্ধ্রী পুনশ্চ আসি পুরে প্রবেশিল।।
মৎস্যদেশের আর নাহিক প্রতিকার।
গন্ধর্ব্বের হাতে সবে হইবে সংহার।।
মনোরমা নারী হয় পরমা সুন্দরী।
হেরিলে গন্ধর্ব্ব তারে চলে যাবে মারি।।
শীঘ্র করব নরপতি ইথে প্রতিকার।
হেথা হৈতে দুষ্টা গেলে সবার নিস্তার।।
শুনিয়া বিরাট রাজা ভয়ে ত্রস্ত হৈল।
কীচকেরে দহিবারে লোকে আজ্ঞা দিল।।
অন্তঃপুরে গিয়া রাজা রাণীকে বলিল।
সৈরন্ধ্রী রাখিয়া গৃহে বিপত্তি ঘটিল।।
এখন যেথায় হৈতে যায় যেই মতে।
মোরে নাম নাহি লবে, কহিবে সম্প্রীতে।।
এতদিন ছিলে তুমি আমার সদন।
এখন যথায় ইচ্ছায় করহ গমন।।
তোমা হৈতে বড় ভয় হইল সবার।
বিলম্ব না কর, শীঘ্র হও আগুসার।।
মহাভারতের কথা সুধার সাগর।
যাহার শ্রবণে ত্রাণ পায় যত নর।।