৪০. ভীষ্ম কর্ত্তৃক ভক্ত-মাহাত্ম্য কীর্ত্তন

ধৃতরাষ্ট্রে সান্ত্বাইয়া বলে ভীষ্ম বীর।
হরি ভজ হরি চিন্ত মন কর স্থির।।
অসার সংসার এই কেহ কারো নয়।
দিন কথো রহি যেন পথ পরিচয়।।
তোমারে কহিনু আমি যত হিতবাণী।
না শুনিল তব পুত্র না শুন আপনি।।
এখন আমার বাক্য শুন একমনে।
যোগকথা কহি শুন বেদের বচনে।।
পরলোক চিন্তা কর ভব তরিবার।
ভাবহ গোবন্দ-পদ সংসারের সার।।
বিদুরে চাহিয়া বলে শান্তনু-নন্দনে।
সর্ব্ব ধর্ম্ম জান তুমি ধর্ম্মে বিচক্ষণ।।
মোর বংশ উদ্ধারিতে তব জন্ম হৈল।
তুমি সে পরম সাধু শ্রীকৃষ্ণ জানিল।।
আপনি করিলা তুমি সর্ব্ব সমাধান।
বুঝাইলে সর্ব্বজনে দিয়া দিব্যজ্ঞান।।
যতেক পূর্ব্বের কথা তুমি সব জান।
ব্যাস আদি কহিলেন তাহা কৈল আন।।
জগতজীবন কৃষ্ণ তাঁর সেবা করি।
সফল জীবন ক্ষত্তা তব বশ হরি।।
প্রীত হয়ে কৃষ্ণচন্দ্র তব খুদ খায়।
পূর্ব্বে যে কহিনু আমি সেই অভিপ্রায়।।
এক বিপ্র ভক্ত ছিল পরম দুঃখিত।
শুনহ তাহার কথা হয়ে একাচিত।।
যেই মতে তার বশ ছিলা নারায়ণ।
একদিন বৈকুণ্ঠেতে দেব ভগবান।।
সভাতে বসিয়া প্রভু সঙ্গে পঞ্চজন।
ব্রহ্মা বিষ্ণু শিব শুক নারদ তপোধন।।
সবে মেলি বসিয়াছে আনন্দিত মনে।
কুতূহলে চাহি নানা কথা আলাপনে।।
হেনকালে মায়া তারে কৈল ভগবান।
বুঝিয়া প্রভুর মন কৈল অনুমান।।
বুঝিয়া বলেন তবে দেব মহেশ্বরে।
করয়ে অনেক স্তুতি দেব বিশ্বেশ্বরে।।
তোমার যতেক ভক্ত নিজ নিজ ক্রমে।
ত্রৈলোক্যে বসতি করে তোমার নিয়মে।।
তোমার একান্ত যত আছয়ে সংসারে।
ভক্তের মহিমা কিছু দেখাও আমারে।।
এতেক বচন যদি কৈলা মহেশ্বর।
হাসিয়া বলেন তবে দেব গদাধর।।
ভক্তের মহিমা কিছু দেখাব তোমারে।
দীনহীন মোর ভক্ত আছয়ে সংসারে।।
অন্ন-বস্ত্রহীন যত মোর ভক্তগণ।
সংযোগ কেমন তার নাহি কদাচন।।
এ সুখ সম্পদ আমি নাহি দিব তারে।
লইয়া তিলক মালা ভ্রময়ে সংসারে।।
সংসারে বিষম দুঃখ হয় যে বন্ধন।
ইহাতে করয়ে যেই আমার ভবন।।
আমারে না ছাড়ে যেবা মহাদুঃখ পেয়ে।
উদ্ধারিয়া লই তারে মুক্তিপদ দিয়ে।।
আমার যতেক ভক্ত আছয়ে সংসারে।
ভক্তের মহিমা এই কহিনু তোমারে।।
করযোড় করি পুনঃ কহে মহেশ্বরে।
ভক্তের মহিমা কিছু দেখাবে আমারে।।
গোবিন্দ বলেন, শুন দেব মহাশয়।
ভক্তের মহিমা কিছু দেখাব তোমায়।।
ব্রাহ্মণের মূর্ত্তি তবে ধরি পঞ্চজন।
বৈকুণ্ঠ ছাড়িয়া তবে যান বৃন্দাবন।।
মায়াধারী হৈলা তাঁরা পাঁচটী ব্রাহ্মণ।
বিপ্রমূর্ত্তি ধরিয়া চলিলা পঞ্চজন।।
বৈকুণ্ঠ হইতে সবে আইল বৃন্দাবন।
মায়াধারী হইয়া আইল পঞ্চজন।।
হেনকালে বেলা হৈল তৃতীয় প্রহর।
ক্ষুধায় তৃষ্ণায় শ্রান্ত হৈল কলেবর।।
মহাদেব বলেন, শুনহ নরহরি।
শ্রান্ত বড় হইলাম, চলিতে না পারি।।
শ্রীকৃষ্ণ বলেন, এবে শুনহ বচন।
শীঘ্রগতি চলহ নিকট বৃন্দাবন।।
তবে সে চলিলা সবে হৈয়া মহাসুখ।
কতদূরে বৃক্ষ এক দেখিল সম্মুখ।।
শ্রান্ত হৈয়া বৃক্ষতলে বসে পঞ্চজন।
আসিয়া মিলিল এক গ্রামের ব্রাহ্মণ।।
শ্রান্তযুক্ত পঞ্চজন ব্রাহ্মণ দেখিয়া।
স্তুতি করি বলে দ্বিজ অঞ্জলি করিয়া।।
বৈষ্ণব তোমরা বট হও পঞ্চজন।
শ্রান্ত হৈয়া দেখি কোথা করিছ গমন।।
কৃপায় অতিথি যদি হও মোর ঘরে।
সবংশে রাখিব মোরা মস্তক উপরে।।
ঠাকুর বলেন, বিপ্র শুনহ বচন।
শান্ত নামে মুনি এই বৈসে বৃন্দাবন।।
শান্ত মুনি মোসবারে কৈল নিমন্ত্রণ।
তার ঘরে অতিথি হইব পঞ্চজন।।
দ্বিজ বলে, শুন শুন ব্রাহ্মণ ঠাকুর।
হেন বুঝি উপবাস হবে তার ঘর।।
শান্তমুনি আছে বৃন্দাবনের বাহিরে।
ঘর দ্বার নাহি তার থাকে কুঁড়ে ঘরে।।
কুঁড়ে বান্ধি পিতাপুত্রে দুইজনে রহে।
কোন দিন ভিক্ষা মিলে, কোন দিনে নহে।।
অদ্য ভক্ষ্য নাহি তার বৃক্ষতলে রয়।
আজি উপবাস তথা থাকিবে নিশ্চয়।।
এত শুনি ব্রাহ্মণে বলিলা নারায়ণ।
অবশ্য যাইব আজি তাহার সদন।।
তবে যদি লঙ্ঘন করিব তথাকারে।
যে হউক সে হউক মোরা যাব তার ঘরে।।
এত বলি বিদায় করিল সে ব্রাহ্মণ।
তবে প্রভু শিবে চাহি বলেন বচন।।
তোমার সেবক হয় ব্রজপুর-রাজা।
নানামত প্রকারে তোমারে করে পূজা।।
আজি চল অতিথি হইব তার ঘরে।
পশ্চাতে মিলিব শান্তপন মুনিবরে।।
ব্রাহ্মণ মূরতি ধরি হয়ে পঞ্চজন।
রাজার দুয়ারে উত্তরিলা ততক্ষণ।।
বারে বারে দ্বারী বহু কহিল রাজারে।
কদাচিত ব্রজরাজ না পুছে দ্বিজেরে।।
সমস্ত দিবস গেল সন্ধ্যাকাল হৈল।
মহাক্রোধে শঙ্কর জটায় হাত দিল।।
শান্ত করাইয়া কৃষ্ণ লইয়া চলিলা।
তবে সেই মুনি গৃহে আসি উত্তরিলা।।
বৃক্ষতলে কুঁড়েতে বসিয়া মুনিবর।
একা বসি হরিনাম জপে নিরন্তর।।
হেনকালে উপনীত হৈলা পঞ্চজন।
ব্রাহ্মণ দেখিয়া কৈল চরণ বন্দন।।
শ্রান্তযুক্ত পঞ্চজন দেখিয়া ব্রাহ্মণ।
তাহা দেখি সচিন্তিত হৈলা তপোধন।।
কহিতে লাগিল পঞ্চজন বিদ্যমান।
শ্রান্তযুক্ত দেখি কোথা করিছ গমন।।
শ্রীকৃষ্ণ বলেন, মুনি শুনহ বচন।
তোমার অতিথি মোরা হই পঞ্চজন।।
আজি যে তোমার এথা বিশ্রাম করিব।
প্রভাতে উঠিয়া মোরা চলিলা যাইব।।
এত শুনি শান্তপন অতি ব্যস্ত হৈয়া।
বসিতে আসন দিলা ত্বরিত করিয়া।।
কমণ্ডলু-জলে পদ প্রাক্ষলন কৈল।
পাদোদক লৈয়া কিছু ভক্ষণ করিল।।
মনে মনে মুনিবর চিন্তিলা শ্রীহরি।
ঘরে কিছু নাহি যে অতিথিসেবা করি।।
ভিক্ষা লৈয়া পুত্র যদি আইসে তৎকাল।
তবে সে অতিথিসেবা হইবে সফল।।
যাবত পুত্রের নাহি হৈবে আগমন।
এই সঙ্গে থাকি গিয়া কৃষ্ণ আলাপন।।
ক্ষুধা তুষ্ণা করি যেন নাহি হয় মন।
সদাই ভাবয়ে দ্বিজ পুত্রের কারণ।।
এত ভাবি বসিলেন অতিথির সঙ্গে।
কৃষ্ণাবেশে আমোদিত হইলা তরঙ্গে।।
আমোদিত হৈয়া দিবানিশি নাহি জানি।
আইল মুনির পুত্র হইল রজনী।।
আসিয়া দ্বারেতে সেই অতিথি দেখিয়া।
মুনিরে ডাকিল পুত্র ইঙ্গিত করিয়া।।
পুত্রকে দেখিয়া মুনি উঠিল সত্বর।
পুত্রের নিকটে মুনি কহেন উত্তর।।
মুনি বলে, কি আনিলে কহত আমারে।
ব্রাহ্মণ অতিথি পঞ্চজন মোর ঘরে।।
এত শুনি মুনি-পুত্র সচিন্তিত হই।
আছুক ভিক্ষার কাজ জল নাহি পাই।।
না জানি আমারে আজি বিধি বিড়ম্বিল।
বৃন্দাবন বেড়াইয়া ভিক্ষা না মিলিল।।
এত শুনি শান্তপন নিশ্বাস ছাড়িল।
এত দিনে মোর বুঝি সর্ব্বনাশ হৈল।।
হেন কিছু নাহি দ্রব্য হাতে করি লৈবা।
বাঞ্ছা হৈল আজি করি অতিথির সেবা।।
ব্রাহ্মণ অতিথি যদি লঙ্ঘন-থাকিবে।
যত ধর্ম্ম পুণ্য মোর সব নষ্ট হৈবে।।
ব্রাহ্মণ বৈষ্ণব যদি থাকে উপবাসী।
জন্মে জন্মে বাড়ে পাপ বড় ভয় বাসি।।
কি করিব কোথা যাব কি হবে উপায়।
কিমতে আমার ধর্ম্ম আজি রক্ষা পায়।।
শুনিয়া মুনির পুত্র বলে, শুন মুনি।
অল্প পাপে বহু পুণ্য হয় হেন জানি।।
এমত যুকতি মোরে করিতে যুয়ায়।
কি কর্ম্ম করিব এবে কহ মহাশয়।।
পুনঃ বলে, বৈষ্ণব যদি থাকয়ে লঙ্ঘনে।
হইবে অধিক পাপ না যায় খণ্ডনে।।
অল্প পাপ করিয়া বিস্তর পাপে তরি।
অতিথি লাগিয়া চল করি গিয়া চুরি।।
মুনি বলে, চুরি করি আনিব যাহার।
ব্রাহ্মণ বৈষ্ণবে খাবে এ ধর্ম্ম তাহার।।
পুত্র বলে, অতিথি লঙ্ঘনে রবে ঘরে।
অল্প পাপে বহু পাপ হইবে তোমারে।।
মুনি বলে, শুন পুত্র আমি শান্ত মুনি।
বৃন্দাবনে থাকি আমি সর্ব্বলোকে জানি।।
অতিথি লাগিয়া যদি চুরি করি আনি।
সেই কথা লোকে যদি হয় জানাজানি।।
সত্য মিথ্যা না জানিবে ঘুষিবে সংসার।
সকল মহিমা নষ্ট হইবে আমার।।
এত শুনি মুনিপুত্র বলে বুঝাইয়া।
আনি দিব বহু দ্রব্য হাতেতে করিয়া।।
সিন্দ কাটি প্রবেশ করিব আমি ঘরে।
খড়্গ লৈয়া থাক তুমি সিন্দের দুয়ারে।।
মুনি ত পুত্রের কথা ভাবে মনে মনে।
পুত্র নষ্ট হইবেক অতিথি কারণে।।
মুনিপুত্র বলে, পিতা কিছু না ভাবিবে।
ধর্ম্মরক্ষা হেতু লোক এমত করিবে।।
মুণ্ড কাটি লৈয়া তুমি করিবে গমন।
স্কন্ধ দেখি চিনিতে নারিবে কোন জনে।।
মুনি বলে, হেন কর্ম্ম করিব কেমনে।
শুন পিতা পুত্র জন্ম কিসের কারণে।।
পিতামাতার ধর্ম্ম রক্ষা করে যেই জন।
সংসারে এসব জনে সাধুর গণন।।
এখন তোমার যদি ধর্ম্ম নষ্ট হয়।
আমি পুত্র থাকি তবে কি করি উপায়।।
পুত্র হৈয়া মাতা-পিতার ধর্ম্ম রক্ষা করে।
পুত্রধর্ম্ম সুবিখ্যাত আছয়ে সংসারে।।
চল শীঘ্র তথাকারে দ্রব্য লয়ে আসি।
অতিথি সেবিব আজি থাকি উপবাসী।।
চুরি ত করিয়া যদি আপনারা খাই।
তবে সে অধর্ম্ম হয় জানি সর্ব্বদাই।।
নহে ত অতিথিসেবা করিব লঙ্ঘন।
সর্ব্ব ধর্ম্ম নষ্ট হবে নরকে গমন।।
এতেক শুনিয়া মুনি পুত্রের বচন।
চুরি করিবারে গেলেন শ্রীবৃন্দাবন।।
দ্বিতীয় প্রহর যবে অন্ধকার রাতি।
বৃন্দাবনবাসী যত হইল নিশুতি।।
সিন্দ কাটি মুনিপুত্র প্রবেশিল ঘরে।
খড়্গ হাতে মুনি রহে সিন্দের দুয়ারে।।
যে চাহি অতিথি হেতু সামগ্রী লইয়া।
শান্ত ‍মুনি তবে সব আনি দিল লৈয়া।।
মুনি-পুত্র বলে, তাত বলিয়ে তোমারে।
সামগ্রী লইয়া সব যাইতে সত্বরে।।
তবে শান্ত মুনি সেই সামগ্রী লইয়া।
শীঘ্র করি আইলেক কুঁড়েতে রাখিয়া।।
মুনি-পুত্র বলে, পিতা নিশি হৈল শেষ।
তাম্বূল লাগিয়া তবে করিব প্রবেশ।।
তাম্বূল চাহিয়া ফিরে ঘরের ভিতরে।
শীঘ্র যাইতে মুনি পুত্র আছাড়িয়া পড়ে।।
হুড় হুড় দুড় দুড় শব্দ করে ঘরে।
কি কি করি গৃহস্থেরা উঠিল সত্বরে।।
মুনি-পুত্র মুণ্ড দিল সিন্দের দুয়ারে।
শীঘ্রতর আসি মুনি খড়্গ নিল করে।।
মুণ্ডকাটিতে মুনি না হইল ব্যথা।
স্বহস্তে কাটিয়া নিল নিজ পুত্র মাথা।।
মুণ্ড লয়ে মুনিবর মুণ্ড রাখে লুকাইয়া।
কুঁড়ের ভিতরে মুণ্ড রাখে লুকাইয়া।।
স্কন্ধ আছে মুণ্ড নাহি ইহার কারণ।
ডাকাতি হইল বলি হইল ঘোষণ।।
রাজভয়ে স্কন্ধ লয়ে রাখে গিয়া জলে।
হেথায় সামগ্রী লৈয়া মুনি কুতূহলে।।
দিলেন হরির হাতে সামগ্রী লইয়া।
রন্ধন করিলা হরি আনন্দিত হৈয়া।।
রন্ধন করিয়া তবে দেব জগন্নাথ।
আপনি করিলা হরি তবে সাত পাত।।
ব্রাহ্মণের তরে তবে বলে নারায়ণ।
পুত্রসহ আইস বিপ্র করিতে ভোজন।।
পশ্চাতে খাইব, বিপ্র বলেন বচন।
অগ্রেতে তোমরা সবে করহ ভোজন।।
কৃষ্ণ বলে, দেখ শিব ব্রাক্ষণের তরে।
পুত্র কাটি বিপ্র অতিথিসেবা করে।।
রজনী প্রভাত হৈল অরুণ উদয়।
অতিথি উঠিয়া বসে পঞ্চ মহাশয়।।
জলতীরে গিয়া তবে প্রাতঃক্রিয়া কৈল।
শান্তপন মুনি ঘরে আসিয়া বসিল।।
মুনিকে কহিলা তবে দেব গদাধর।
কোথা গেল তব পুত্র ডাকহ সত্বর।।
মুনি বলে, তোমরা করহ আগমন।
ডাকিলে না পাব আমি তার অন্বেষণ।।
নারায়ণ বলে, মুনি শুনহ বচন।
তাহার অপেক্ষা করি আছি পঞ্চজন।।
সে যদি আসিয়া মোরে বিদায় করিব।
তবে অন্য স্থানে মোরা আজি সে যাইব।।
এতেক শুনিয়া মুনি করে নিবেদন।
না থাকিবা, কোন স্থানে করহ গমন।।
এতেক জঞ্জাল তবে কোন্ প্রয়োজন।
বিদায় হইয়া পঞ্চ করহ গমন।।
মহাদেব বলে, কৃষ্ণ করি নিবেদন।
মুনিকে লইয়া সঙ্গে চল নারায়ণ।।
তবে শান্ত মুনি সঙ্গে গেলা ততক্ষণ।
একত্র হইয়া যান ছয়টি ব্রাহ্মণ।।
কৃষ্ণ সঙ্গে যায় মুনি হরি হরি বলে।
ধীরে ধীরে যান বিপ্র যমুনার কূলে।।
শ্রীকৃষ্ণ বলেন, বিপ্র শুনহ বচন।
এই স্থানে কর সবে আহ্নিক তর্পণ।।
এত বলি নামিলেন সেই নদীজলে।
মৃতস্কন্ধ আসি লাগে মুনিবর-কোলে।।
শান্তমুনি ত্রাসযুক্ত স্কন্ধকে দেখিয়া।
পুনরপি স্নান করে স্থানান্তরে গিয়া।।
প্রভু বলে মুনিবর কি দেখিলে জলে।
মুনি বলে, মৃতস্কন্ধ লাগে মোর কোলে।।
প্রভু বলে, মুনিবর শুনহ বচন।
চিনিতে না পার তুমি মৃত কোন জন।।
মুনি বলে মৃতস্কন্ধ চিনিব কিমতে।
কত মৃতস্কন্ধ ভাসে নদীর জলেতে।।
এতেক শুনিয়া কৃষ্ণ মুনির উত্তর।
আপনি তুলিলা স্কন্ধ হাতের উপর।।
কৃষ্ণ বলে, শুন মুনি কহি যে তোমারে।
যেই মুণ্ড রাখিয়াছ কুঁড়ের ভিতরে।।
সেই মুণ্ড শীঘ্র তুমি আন মুনিবর।
স্কন্ধে মুণ্ড জীয়াইব তোমার কোঙর।।
এত শুনি মুনিবর বিস্ময় হইল।
শীঘ্রগতি মুনিবর কুঁড়ে ঘরে গেল ।।
পিপীলিকা কৃমি মাংস কৈল খানি খানি।
হাত দিয়া শীঘ্র চালাইল শান্তমুনি।।
ঢাকিয়া লইয়া মুণ্ড শান্ত মুনিবর।
শীঘ্রগতি লৈয়া দিল কৃষ্ণের গোচর।।
স্কন্ধে মুণ্ড একত্র করিয়া গদাধর।
পদ্মহস্ত দিলা হরি তাহার উপর।।
মুনিপুত্র বাঁচিয়া উঠিল ততক্ষণ।
তবে কৃপা কৈল প্রভু দেব নারায়ণ।।
শিব ব্রহ্মা শুকদেব নারদ মুনিবর।
বুঝিয়া প্রভুর কর্ম্ম করিলা উত্তর।।
উৎপত্তি প্রলয় স্থিতি তুমি সে কারণ।
জয় জয় শব্দ হৈল এ তিন ভুবন।।
মুনিপুত্র জিয়াইল দেখি বিদ্যমান।
ভক্তের মহিমা কৈলা দেব ভগবান।।
এইকালে হরি কিছু বলেন শিবেরে।
ভক্তের মহিমা এই দেখহ সংসারে।।
এতেক আমার নামে খায় ভিক্ষা করি।
পুত্রমুণ্ড কাটিয়া অতিথি সেবা করি।।
যে জন অতিথি সেবে একান্ত হইয়া।
উদ্ধারিয়া লই তারে মুক্তিপদ দিয়া।।
আমার নামেতে যুক্ত হয় যেই জন।
যমদণ্ড কখন না পায় সেই জন।।
অতিথি বৈষ্ণব গুরু কিছু ভেদ নাই।
ভজিলে সুস্থির হৈয়া দুর্গতি এড়ায়।।
এত বলি নিজ মূর্ত্তি হৈলা পঞ্চজন।
শঙ্খ চক্র গদা পদ্ম কিরীট ভূষণ।।
পিতা-পুত্রে শান্ত মুনি দরশন পাইয়া।
স্তবন করয়ে দুঁহে একান্ত হইয়া।।
শ্রীকৃষ্ণ বলেন, মুনি শীঘ্র যাহ ঘরে।
পুত্রভাবে কৃপা আমি করিব তোমারে।।
করহ অতিথিসেবা দিয়া নানা ধন।
বাড়িবে তোমার যশ থাক বৃন্দাবন।।
কতদিন কর গিয়া অতিথি-সেবন।
তবেত বৈকুণ্ঠপুরে করিবে গমন।।
একেত প্রভুর আজ্ঞা পাইয়া দুজনে।
কান্দিয়া পড়িল পঞ্চজনের চরণে।।
আলিঙ্গন দিয়া বহু আশিস্ করিলা।
আশ্বাস করিয়া সবে ঘরে পাঠাইলা।।
মুনিকে বিদায় করি প্রভু ভগবান।
ব্রহ্মা শিব গেলা তবে আপনার স্থান।।
লক্ষ্মীর সহিত হরি বসি সিংহাসনে।
শুকদেব নারদ রহিলা বিদ্যমানে।।
হেথা শান্তমুনি গেলা কুঁড়ের নিকটে।
কুঁড়ে না দেখিয়া মুনি ভাবিল সঙ্কটে।।
চৌদিকে বেড়ান মুনি কুঁড়ে নাহি পান।
কুঁড়ে ভাঙ্গি অট্টালিকা হয়েছে নির্ম্মাণ।।
মুনিপুত্র বলে, পিতা শুনহ বচন।
যেই কথা কহিলেন প্রভু জনার্দ্দন।।
নির্ম্মাণ করিলা গোঁসাই এই সব পুরে।
অতিথির সেবা তুমি করহ সত্বরে।।
পুত্রের বচনে মুনি পুরী প্রবেশিল।
নানারত্ন মণি মুক্তা নয়নে দেখিল।।
বস্ত্র অলঙ্কার সব আছে রাশি রাশি।
অতিথিসেবার দ্রব্য সব পায় বসি।।
নানা রত্ন পায় ঘরে নাহি তার সীমা।
এই ত জানহ ভক্তজনের মহিমা।।
আনন্দিত হৈল তবে ব্রাহ্মণ-ব্রাক্ষণী।
নানা পুষ্প তুলসীতে পূজে চক্রপাণি।।
হরিভক্ত হৈলে তার কত হয় লাভ।
হরিকথা শুন সবে কৃষ্ণে কর ভাব।।
হরির চরণ বিনে গতি নাহি আর।
হেন হরি বশ কর সংসারের সার।।
হেন হরি ক্ষত্তা-গৃহে খুদ-কণা খায়।
দুর্য্যোধন রাজা পানে ফিরিয়া না চায়।।
তোমারে বলি যে আমি শুনহ বিদুর।
তব বশ হৈল সেই ত্রিদশ-ঠাকুর।।
তোমার সমান আর ভাগ্য আছে কার।
পাইলে বিদুর তুমি সংসারের সার।।
যুধিষ্ঠিরে বিদুর তুমি করেছে আপনি।
মিথ্যা শোকে অসন্তোষ আছে নৃপমণি।।
কহ তুমি নৃপতিরে যোগের বচন।
বৃথা শোক করে যার সখা নারায়ণ।।
মহাভারতের কথা অমৃত-সমান।
কাহার শকতি ইহা করে পরিমাণ।।
ইহার বিস্তার কহে নাহি হেন জন।
করিলা সুধন্য সত্যবতীর নন্দন।।
বিস্তারিতে ক্ষম ইথে নাহি অন্য জন।
কহিতে না পারে কেহ বাহুল্য কারণ।।
মহাভারতের কথা কহিলেন ব্যাস।
অন্যের শকতি নাহি করিতে প্রকাশ।।
মস্তকে বন্দিয়া দ্বিজগণ-পদরজ।
কহে কাশীদাস গদাধর-দাসাগ্রজ।।