৩৯. মণিভদ্র রাজার দেশে অর্জ্জুনাদির গমন

বলেন বৈশম্পায়ন শুন জন্মেজয়।
উত্তর মুখেতে গেল পাণ্ডবের হয়।।
দুই গোটা অশ্ব গেল উত্তর সাগরে।
প্রবেশিল দুই অশ্ব সলিল ভিতরে।।
তাহা দেখি ভয় পায় যত সৈন্যগণ।
অর্জ্জুন বলেন কি হইবে নারায়ণ।।
সলিলেতে দুই অশ্ব করিল প্রবেশ।
কেমনে পাইব অশ্ব বল হৃষীকেশ।।
গোবিন্দ বলেন তুমি চিন্তা কর কেনে।
আপনি যাইব জলে অশ্ব অন্বেষণে।।
এত বলি অর্জ্জুনে লইয়া জগৎপতি।
বভ্রুবাহ রাজা গেল দোঁহার সংহতি।।
ভীম আদি সৈন্য সব রহিলেন কূলে।
বভ্রুবাহ কৃষ্ণার্জ্জুন প্রবেশিল জলে।।
বাগদালভ্য মুনি নিকটে গেল চলি।
জানেন সকল তত্ত্ব দেব বনমালী।।
দ্বীপেতে আছেন মুনি বটপত্র শিরে।
উপনীত তিনজন তাঁহার গোচরে।।
প্রণমিয়া মুনিরে বলিল তিনজন।
নারায়ণ দেখি মুনি আনন্দিত মন।।
ঈষৎ হাসিয়া তবে জিজ্ঞাসেন হরি।
দ্বীপ মধ্যে আছ বটপত্র শিরে ধরি।।
আশ্রম না কর তুমি কিসের কারণে।
কতদিন মুনিবর আছ এইখানে।।
বাগদালভ্য মুনি তবে বলয়ে বাসিয়া।
কি কারণে দুঃখ পাব আশ্রম করিয়া।।
অল্পকাল পরমায়ু দিল নারায়ণ।
আজি কালি মরি, গৃহে কোন্ প্রয়োজন।।
মুনির বচনে জিজ্ঞাসেন ধনঞ্জয়।
কতদিন এখানে আছেন মহাশয়।।
মুনি বলে এক কল্প আমার জীবন।
শত মন্বন্তর বটপত্র আচ্ছাদন।।
পার্থ বলে মনন্তর কত দিনে হয়।
এক কল্প কারে বলে কহ মহাশয়।।
বাগদালভ্য বলে শুন ইন্দ্র নন্দন।
একাত্তর যুগে মন্বন্তরের গণন।।
চতুর্দ্দশ মন্বন্তরে যত কল্প হয়।
এই পরমায়ু মম পাণ্ডুর তনয়।।
এত অল্পদিনে কিবা কার্য্য আশ্রমেতে।
অতএব আছি আমি বটপত্র মাথে।।
কোথা যাও তিনজন বলহ আমার।
কি কারণে আসিয়াছ আমার গোচরে।।
অর্জ্জুন বলেন যজ্ঞ করে যুধিষ্ঠির।
অশ্ব রাখি আমি যে সঙ্গেতে যদুবীর।।
না জানি যজ্ঞের ঘোড়া গেল কোনস্থানে।
অশ্ব তত্ত্বে আইলাম তোমা বিদ্যমানে।।
অর্জ্জুনের বচন শুনিয়া মুনিবর।
ঈষৎ হাসিয়া তারে দিলেন উত্তর।।
মিথ্যা অশ্বমেধ কর ভক্তি নাহি মনে।
অনুক্ষণ কৃষ্ণচন্দ্র দেখিছ নয়নে।।
তথাপি করহ যজ্ঞ কি বলিব আর।
সত্য বলি অর্জ্জুন জানহ চক্রধর।।
কে বুঝিবে কৃষ্ণলীলা পাণ্ডবনন্দন।
শিব ব্রহ্মা নারিল করিতে নিরূপণ।।
এত বলি মুনিবর যোড়হস্ত হৈয়া।
কৃষ্ণেরে করিল স্তুতি বিনয় করিয়া।।
তোমার মায়ায় স্থির নহে সুরগণ।
কিসের গণনা করি পাণ্ডুর নন্দন।।
পূর্ব্ব তপফলে দেখিলাম তব পদ।
হইল পবিত্র আজি আমার আস্পদ।।
এত বলি তুষিলেন দেব নারায়ণে।
সে দ্বীপ ভ্রমিয়া অশ্ব এল সেইখানে।।
সলিল ত্যজিয়া অশ্ব কূলেতে উঠিল।
তাহা দেখি অর্জ্জুনের আনন্দ হইল।।
মুনি প্রণমিয়া চলিলেন তিন জন।
অশ্বের গমনে সুখী যত রাজগণ।।
বলেন বৈশম্পায়ন শুন জন্মেজয়।
সিন্ধুপুরে গেল তবে পাণ্ডবের হয়।।
তার অধিকারী মণিভদ্র নরপতি।
দুঃশলার পুত্র জয়দ্রথের সন্তুতি।।
কুরুক্ষেত্রে পার্থ হস্তে জয়দ্রথ মৈল।
তার পুত্র মণিভদ্র রাজ্যে রাজা হৈল।।
দূতমুখে শুনি পুরে আইল অর্জ্জুন।
সসৈন্য সাজিয়া এল করিবারে রণ।।
পলাইয়া গেল তবে রাজ্য পরিহার।
অর্জ্জুন দেখেন তবে অরাজকপুরী।।
পাণ্ডবের সৈন্য যত পশিলেক পুরে।
তাহা দেখি প্রজাগণ কম্পিত অন্তরে।।
অর্জ্জুন বলেন এই কাহার নগর।
প্রজাগণ বলে শুন সে সব উত্তর।।
জয়দ্রথ রাজা ছিল ইহা অধিকারী।
কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে মরি গেল স্বর্গপুরী।।
তাহার তনয় মণিভদ্র নরবর।
শুনিয়া তোমার নাম পলায় সত্বর।।
পরিবার সহ রাজা যায় পলাইয়া।
কহিনু তোমার ঠাঁই বিনয় করিয়া।।
হাসিলেন ধনঞ্জয় এ কথা শ্রবণে।
সাত্যকিরে পাঠাইল আশ্বাস কারণে।।
সাত্যকি সন্ধান করি করিল গমন।
দুঃশলারে কহিলেন মধুর বচন।।
প্রবোধ করিয়া তারে সাত্যকি আনিল।
পুত্র সহ দুঃশলা অর্জ্জুন কাছে গেল।।
অর্জ্জুন বলেন ভগ্নি কিসের কারণ।
তুমি কেন ভয় পেয়ে করিলে গমন।।
পূর্ব্ব বিবরণ তুমি মনেতে করিয়া।
ভয়ে পলাইলে ধন রাজ্য তেয়াগিয়া।।
সে ভয় নাহিক আর কহিলাম আমি।
হস্তিনানগরে মম সঙ্গে চল তুমি।।
তবে মণিভদ্র আসি বন্দিল চরণে।
অনেক প্রণাম কৈল লোটাইয়া ভূমে।।
আলিঙ্গনে তাহাকে তোষেণ ধনঞ্জয়।
নির্ভয় হইল জয়দ্রথের তনয়।।
আমার বচন শুন দুঃশলা ভগিনী।
অশ্বমেধ যজ্ঞ করে ধর্ম্ম নৃপমণি।।
তুরগ রাখিতে তাই আইলাম হেথা।
শুন স্বদা পুত্র সঙ্গে তুমি চল তথা।।
যজ্ঞেতে যাইতে তোমা হয় যে উচিত।
আইস আমার সঙ্গে দূর কর ভীত।।
পিতৃ মাতৃ দোঁহাকার বান্দিয়া চরণ।
যজ্ঞ সাঙ্গ হৈলে তুমি আসিবে ভবন।।
এত যদি পার্থ বীর আশ্বাস করিল।
জননী সহিত মণিভদ্র যাত্রা কৈল।।
পাত্র মিত্র সবাকারে নিয়োজিয়া পুরে।
মণিভদ্র যাত্রা কৈল হস্তিনানগরে।।
কত অনুচর সঙ্গে লয়ে অশ্ব হাতী।
হস্তিনানগরে যান আনন্দিত মতি।।
মহাভারতের কথা অমৃত সমান।
কাশীরাম দাস কহে শুনে পুণ্যবান।।