৩৯. ব্যাধের প্রতি উতঙ্ক মুনির উপদেশ ও শ্রীকৃষ্ণের স্তব

এতেক শুনিয়া কথা ধর্ম্ম নরমণি।
পুনরপি জিজ্ঞাসিল করি যোড়পাণি।।
উতঙ্ক কিরূপে কৃষ্ণে করিল স্তবন।
কোন্ মুর্ত্তি ধরি কৃষ্ণ দেন দরশন।।
কি বর দিলেন কৃষ্ণ তুষ্ট হয়ে তায়।
কহিবে সকল কথা বিশেষে আমায়।।

ভীষ্ম কন অবধান করহ রাজন।
মহামুনি উতঙ্ক বিখ্যাত তপোধন।।
শিশুকাল হৈতে কৃষ্ণ পরিচর্য্যা করে।
বেদশাস্ত্র নিষ্ঠাশীল সর্ব্বগুণ ধরে।।
পাইল পরম গতি শ্রীকৃষ্ণে দেখিয়া।
করিল গোবিন্দে স্তুতি প্রণত হইয়া।।
জয় জয় নারায়ণ জগৎ কারণ।
জয় জগন্নাথ প্রভু ব্রহ্ম সনাতন।।
নমো কূর্ম্ম অবতার মন্দারধারক।
নমো ভৃগুপতি রাম ক্ষন্ত্র কুলান্তক।।
নমো রাম অবতার রাবণনাশন।
বলিমদহর নমো নমস্তে বামন।।
নমো ধন্বন্তরীকায় অমৃতধারক।
নমো যজ্ঞকায় হিরণ্যাক্ষ বিদারক।।
নমস্তে মোহিনীরূপ অসুরমোহন।
নমস্তে নৃসিংহ মাহদৈত্যবিনাশন।।
নমো রামকৃষ্ণরূপ গোকুল বিহার।
নমো নমো জয় জয় বুদ্ধ অবতার।।
ভবিষ্যৎ অবতার নমঃ কল্কিরূপ।
নমো হরি অবতার নমো বিশ্বরূপ।।
নমো শ্রীসচ্চিদানন্দ বিশ্বপরায়ণ।
নমো নমো জগৎপতি ব্রহ্ম সনাতন।।
তুমি ইন্দ্র তুমি যম তুমি পশুপতি।
ত্রিজগৎ নাথ তুমি ত্রিজগৎপতি।।
তুমি সূর্য্য বরুণ স্বরূপ কলেবর।
কুবের শমন তুমি জগৎ ঈশ্বর।।
তোমার মায়ার বদ্ধ সব চরাচর।
ত্রিগুণ ঈশ্বর তুমি প্রকৃতির পর।।
অনন্ত তোমার রূপ গুণ জাতিহীন।
গুণেতে বর্জ্জিত তুমি গুণেতে প্রবীণ।।
জ্ঞানের স্বরূপ তুমি তুমি মায়াধর।
নির্ম্মায়া নির্ম্মোহ তুমি মায়ার ঈশ্বর।।
তোমা বিনা আর কিছু নাহিক সংসার।
আত্মারূপে সর্ব্বভূতে করহ বিহার।।
অন্তরীক্ষ নাভি তব, পাতাল চরণ।
মস্তক আকাশ তব অরুণ লোচন।।
দশদিক স্তোত্র তব, শশী বামেক্ষণ।
তোমার শরীরে ব্যপ্ত চরাচরগণ।।
শঙ্খ চক্র গদা পদ্ম শার্ঙ্গ আদি ধারী।
নানা অলঙ্কারে তনু ভূষিত মুরারী।।
পীতবাস পরিধান রাজীবলোচন।
বনমালা বিভূষিত গরুড়বাহন।।
ত্রিভঙ্গ ললিতরূপ বেশ মনোহর।
নব দল বিকসিত শ্যম কলেবর।।

দেখিয়া উতঙ্ক মুনি হইল ব্যাকুল।
আনন্দ অশ্রুতে ভাসে অঙ্গের দুকূল।।
দণ্ডবৎ হইয়া পড়িল ভূমিতলে।
দেখিয়া উতঙ্কে কৃষ্ণ করিলেন কোলে।।
আলিঙ্গন দিয়া মিষ্ট কহেন বচন।
তব মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হৌক তপোধন।।
একান্ত ভকতি করি আমারে যে ভজে।
অনুক্ষণ থাকি তার হৃদয়ের মাঝে।।
মনোমত যেই মাগে দেই আমি তারে।
সে কারণে শুন দ্বিজ কহি যে তোমাকে।।
যেই বর তব ইচ্ছা মাগ মম স্থানে।
অদেয় হইলে তবু দিব এইক্ষণে।।

এত শুনি কহে দ্বিজ করি যোড়পাণি।
অবধান নিবেদন শুন চক্রপাণি।।
নষ্কাম ভকত আমি বরে নাহি কাজ।
যদি বর দিবে তবে দেহ দেবরাজ।।
কর্ম্মদোষে জন্ম মম যথা তথা হয়।
একান্ত ভকতি যেন তব পদে রয়।।
কীট জন্ম হব কিম্বা মনুষ্য কিন্নরে।
গন্ধর্ব্ব চারণ আদি যত চরাচরে।।
পর্ব্বত স্থাবর আদি ভূত প্রেতগণ।
যথাতথা জন্ম হয় অদৃষ্ট কারণ।।
অকারণে কর মোরে মায়াতে মোহিত।
নির্ম্মায়া হইয় আমি মায়া বিবর্জ্জিত।।
তোমার মায়াতে বদ্ধ যত চরাচর।
কেবল বর্জ্জিত মায়া তোমার কিঙ্কর।।
ঈশ্বরের মায়াতত্ত্ব কি বুঝিতে পারি।
মায়া বিবর্জ্জিত বর দেহ শ্রীমুরারী।।

এত বলি করে দণ্ডবৎ প্রণিপাত।
দলেন তাহারে জ্ঞান ভক্তি জগন্নাথ।।
পুনরপি উতঙ্কে বলেন শ্রীনিবাস।
সর্ব্বত্র মঙ্গল হবে পুরিবেক আশ।।
নরনারায়ণ স্থানে করহ গমন।
তপ যোগ সাধি কর মম আরাধন।।
নর নারায়ণ স্থানে লহ উপদেশ।
একান্ত আমারে ভক্তি করিলে বিশেষ।।
অন্তেরে আমারে তুমি পাইবে নিশ্চয়।
এত বলি স্বস্থানে গেলেন কৃপাময়।।
অতঃপর চলে মুনি করিয়া প্রণাম।
নর-নারায়ণ যথা বদরিকাশ্রম।।
তত্ত্ব উপদেশ লয়ে ভজিল শ্রীহরি।
অন্তকালে তনু ত্যজি গেল বিষ্ণুপুরী।।

কহিলাম তোমারে যে পুরাণ কথন।
ঈশ্বর নির্ণয় তত্ত্ব জানে কোন্ জন।।
পৃথিবীর রেণু যদি গণিবারে পারি।
কলসীতে ভরি যদি সমুদ্রের বারি।।
আকাশের তারা যদি পারি যে গণিতে।
ঈশ্বরের তত্ত্ব তবু না পারি কহিতে।।
করেন করান তিনি আপনি ঈশ্বর।
অন্য দিয়া অন্য বৃত্তি হরেন শ্রীধর।।
অন্য দিয়া অন্য জনে সংহারেন হরি।
তাঁহার প্রসঙ্গ মায়া বুঝিতে না পারি।।
পিতা মাতা পুত্র বন্ধু কেহ কার নয়।
মরিলে সন্বন্ধ নাহি বুঝ মহাশয়।।
একা হয়ে আসে জীব একা হয়ে চলে।
আমার আমার বলি মরয়ে বিফলে।।
সে কারণে কহি শুন ধর্ম্মের নন্দন।
চিত্তে কৃষ্ণ রাখি শোক কর নিবারণ।।
এত বলি গঙ্গাপুত্র নিঃশব্দ হইল।
ধ্যানযোগে কৃষ্ণ মনে ধরিয়া রহিল।।
মহাভারতের কথা অমৃত সমান।
কাশীদাস কহে সদা শুনে পুণ্যবান।।