৩৭. বিষ্ণুর প্রদক্ষিণ প্রস্তাবে বৃহস্পতি ও ইন্দ্রের সংবাদ

এতেক শুনিয়া কথা ধর্ম্ম নৃপবর।
পুনরপি জিজ্ঞাসেন করি যোড়কর।।
প্রদক্ষিণ করে যেই দেব নারায়ণে।
প্রণিপাত আর স্তব করে দৃঢ়মনে।।
তাহার কি পুণ্যফল কহ মহাশয়।
চিত্তের সন্দেহ মম ঘুচাও নিশ্চয়।।

ভীষ্ম বলিলেন ভাল জিজ্ঞাসা তোমার।
গোবিন্দেরে প্রণাম যে করে অনিবার।।
তাহার পুণ্যের কথা কে কহিতে পারে।
পূর্ব্বের কাহিনী রাজা কহিব তোমারে।।

ব্রহ্মার প্রপৌত্র জীব অঙ্গিরাকুমার।
দেবের পরম গুরু বিখ্যাত সংসার।।
শক্রের নগরে তার আলয় নির্ম্মাণ।
কাঞ্চনে পূর্ণিত পুর নানা ভোগবান।।
লীলারূপে তাহাতে প্রকাশে দামোদর।
তার মধ্যে দিব্য এক মন্দির সুন্দর।।
প্রাতঃসন্ধ্যাকালে তবে গুরু বৃহস্পতি।
প্রদক্ষিণ করিয়া কৃষ্ণেরে করে স্তুতি।।
এইরূপে নিত্য নিত্য করয়ে বন্দন।
একদিন গেল ইন্দ্র গুরুর ভবন।।
প্রদক্ষিণ করি গুরুদেব জনার্দ্দনে।
দণ্ডবৎ প্রণিপাত করে হৃষ্টমনে।।
চক্রাবর্ত্তে সপ্তবার মন্দির ফিরিয়া।
প্রণাম করেন কৃষ্ণ প্রদক্ষিণ হৈয়া।।
হেনকালে আসি ইন্দ্র গুরুর সাক্ষাৎ।
বিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করে করি প্রণিপাত।।
নানাবিধ ভক্তি কৃষ্ণে কহে পুনিগণ।
স্তুতিপূজা ধ্যান আদি অর্চ্চন বন্দন।।
এ সব ছাড়িয়া তুমি প্রদক্ষিণ করি।
দণ্ডবৎ প্রণাম করিয়া পূজ হরি।।
ইহার কি ফল হয় কহিবা আমারে।
এত শুনি বৃহস্পতি কহিল তাহারে।।
সম্যক প্রকারে ফল কহিতে না জানি।
অবধান কহি শুন পূর্ব্বের কাহিনী।।
ধ্যান অবশেষে তবে প্রদক্ষিণ হৈয়া।
প্রণিপাত করিলেন শিরে হাত দিয়া।।
দেখিয়া বিস্ময় মম হইল অন্তরে।
ইহার বৃত্তান্ত জিজ্ঞাসিলাম তাঁহারে।।
কৃপা করি ব্রহ্মা কহিলেন যে আমারে।
সেই কথা শুন ইন্দ্র কহি যে তোমারে।।

পূর্ব্বে সত্যযুগে দ্বিজ সুদেব নামেতে।
দুষ্টাচার পাপবুদ্ধি আছিল জগতে।।
বেশ্যাপরায়ণ লুব্ধ পাপী দুরাচার।
নিরন্তর পরদ্রব্য করে অপহার।।
তার কর্ম্ম দেখি সবে ধিক্কার জন্মিল।
নগর হইতে তারে বাহির করিল।।
মহাবনে প্রবেশিল সেইত ব্রাহ্মণ।
নর্ম্মদার তীরে আসি দিল দরশন।।
তথায় দেখিল তপ করে এক মুনি।
তারে বিড়ম্বনা কৈল তত্ত্ব নাহি জানি।।
শকুনি পতগ পাখা করেতে আছিল।
সেই পাখা মুনির জটায় নিয়োজিল।।
হাস্য পরিহাস করি অনেক কহিল।
ময়ূরের পুচ্ছ তার শিরে আরোপিল।।
অতি সুশোভন দেখি জটার উপর।
দেখি তবে হৈল মুনি সক্রোধ অন্তর।।
না জানি আমারে দুষ্ট কর বিড়ম্বন।
ইহার উচিত শাপ দিব এইক্ষণ।।
শকুনি পতগ পাখা মম শিরে দিলে।
হইয়া গৃধিনী পক্ষী জন্মহ ভুতলে।।

এত শুনি তবে দ্বিজ বলিল বচন।
স্মৃতি ভঙ্গ মোর যেন না হয় কখন।।
এত শুনি দুঃখচিত্ত হৈল তপোধন।
সেইক্ষণে পঞ্চত্ব পাইল সে ব্রাহ্মণ।।
শরীর ত্যাজিয়া দ্বিজ গৃধ্ররূপ হৈল।
নিবাস করিয়া সেই বনেতে রহিল।।
এইরূপে কত দিনে আছয়ে বনেতে।
এক দিন ব্যাধ তারে দেখে আচম্বিতে।।
আকর্ণ পুরিয়া বাণ পক্ষীরে মারিল।
অত্যল্প সঘনে পক্ষী যায় পলাইয়া।।
পাছে পাছে ব্যাধপুত্র চলিল ধাইয়া।
কত দূরে গিয়া পক্ষী নির্জীব হইয়ে।।
উড়িয়া পড়িল পক্ষী দেবালয়ে গিয়ে।
ধেয়ে গিয়া ব্যাধ সেই পক্ষীরে ধরিল।।
প্রদক্ষিণ করি শীঘ্র শরীর ত্যাজিল।
সাতবার প্রদক্ষিণ দেবালয় করি।
পঞ্চত্ব পাইল পক্ষী দিব্যমূর্ত্তি ধরি।।
বিষ্ণুপুরে প্রবেশিল বিমানে চড়িয়ে।
নিজ গৃহে গেল ব্যাধ মরা পক্ষী লয়ে।।
পাইল নির্ম্মল মূর্ত্তি দেব নারায়ণে।
প্রদক্ষিণ মহিমা কে কহিবারে জানে।।
ব্রহ্মার বচনে আমি মানিনু সংশয়।
সেই হতে প্রদক্ষিণ করি দেবালয়।।
দণ্ডবৎ প্রণাম করিল বহু স্তুতি।
জানাই তোমারে ইন্দ্র পূর্ব্বের ভারতী।।

ভীষ্ম কন অবধান করহ রাজন।
এত শুনি সবিন্ময় সহস্রলোচন।।
সেই হৈতে হৈল ইন্দ্র প্রদক্ষিণে রত।
কহিনু তোমারে রাজা পূরাণের মত।।
মহাভারতের কথা অমৃতের ধার।
শুনিলে পবিত্র হয় জন্ম নাহি আর।।
ব্যাসের বচন, ইথে নাহিক সংশয়।
শান্তিপর্ব্ব-কথা কাশীদাস বিরচয়।।