৩৭. পঞ্চ পাণ্ডবকে সভাস্থ করণ

হাসিয়া বলিল তবে সূর্য্যের নন্দন।
দেখহ ইহারে হৈল দৈবের ঘটন।।
আমা সবা মধ্যেতে তোমারে দিল লাজ।
উপহাস কৈল পেয়ে আপন সমাজ।।
এই ভীমার্জ্জুন দেখ মাদ্রীর নন্দন।
পুনঃ পুনঃ তোমা দেখি হাসে সর্ব্বজন।।
বাতুল দেখিয়া যথা হাসে সভাজনে।
সেই মত কৈল তোমা আপন ভবনে।।
সেই অধর্ম্মের ফলে দেখ নৃপমণি।
দাস করি বান্ধিয়া দিলেক দৈবে আনি।।
দাস হৈল যুধিষ্ঠির ভ্রাতৃ সমুদায়।
সমযোগ্য নহে দাস বসিতে সভায়।।
দুর্য্যোধন বলে, সখা উত্তম কহিলে।
আজ্ঞা দিল, যুধিষ্ঠিরে লহ সভাতলে।।
দাস হৈল, দাস-স্থানে থাক্ পঞ্চ জন।
সবাকার কাড়ি লহ বস্ত্র আভরণ।।
বুঝিয়া আপনি সখা করহ বিধান।
পঞ্চ জনে নিযুক্ত করহ স্থানে স্থান।।
যে কর্ম্মে যে যোগ্য, তারে কর সমর্পণ।
এতেক শুনিয়া বলে দুষ্ট বৈকর্ত্তন।।
দৈব হৈতে বহুজন ভৃত্য-কর্ম্ম করে।
বিনা কর্ম্মে কেবা আছে সংসার ভিতরে।।
নিজবৃত্তি মত কর্ম্ম করয়ে আজন্ম।
রাজা রাজকর্ম্ম করে, ভৃত্য ভৃত্যকর্ম্ম।।
ভৃত্য হৈল পঞ্চ জন করুক স্বকাজ।
যে কর্ম্মে যে যোগ্য তারে দেহ মহারাজ।।
অনুভব আমার যে কর অবধান।
পঞ্জ জনে নিয়োজিত কর স্থানে স্থান।।
সুকোমল অঙ্গ রাজা ধর্ম্মের তনয়।
অন্য কর্ম্মে ইহার ক্ষমতা নাহি হয়।।
তাম্বূলের সেবাতে করহ নিয়োজন।
পান লৈয়ে সন্নিধানে রবে অনুক্ষণ।।
হৃষ্টপুষ্ট বৃকোদর হয় বলবান।
সে কারণে মম মনে লয় এই জ্ঞান।।
বৃকোদরে সমর্পণ কর চতুর্দ্দোল।
অনায়াসে ভার সবে, নহেক দুর্ব্বল।।
স্কন্ধে করি তোমা লৈবে সহ ভ্রাতৃগণ।
স্বচ্ছন্দে যাইবে, যথা করিবা গমন।।
অর্জ্জুনেরে এই সেবা দেহ মহাশয়।
আমি অনুমানি যদি তব মনে লয়।।
বস্ত্র-অলঙ্কার যদি সমর্প অর্জ্জুনে।
লয়ে তব পুরোভাগে রবে অনুক্ষণে।।
তব হিত-প্রিয় দুই মাদ্রীর তনয়।
এ দোঁহারে দুই সেবা দেহ মহাশয়।।
দুইভিতে তোমার থাকিবে দুই জন।
চামর লইয়া সদা করিবে ব্যজন।।
এ পঞ্চ সেবায় পাঁচে কর নিয়োজন।
আসিয়া করুক কৃষ্ণা গৃহে দাসীপণ।।
এতেক বলিল যদি কর্ণ দুরাচার।
হাসিয়া বলয়ে তবে গান্ধারী-কুমার।।
দুর্য্যোধন বলে, সখা বলিলা উত্তম।
যে বিধান করিলা সে মম মনোরম।।
ইঙ্গিত করিয়া জানাইল ভ্রাতৃগণে।
ভৃত্যস্থলে লইয়া বসাও সর্ব্বজনে।।
আজ্ঞামাত্র ততক্ষণে যত ভ্রাতৃগণ।
উঠ উঠ বলি কহে কর্কশ বচন।।
কোন্ লাজে রাজা সনে আছহ বসিয়া।
আপনার যোগ্য স্থানে সবে বৈস গিয়া।।
দুঃশাসন উঠাইল ধর্ম্ম-করে ধরি।
চল চল বলি ডাকে পৃষ্ঠে ঢেকা মারি।।
ক্রোধেতে ধর্ম্মের পুত্র কাঁপে কলেবর।
চক্ষু রক্তবর্ণ, লোহ বহে ঝরঝর।।
বিপরীত মানহীন দেখি যুধিষ্ঠির।
ক্রোধে থর থর কম্পমান ভীমবীর।।
ভৈরব-গর্জ্জনে গর্জ্জে দন্ত কড়মড়ি।
যেমন প্রলয়-কালে হয় মড়মড়ি।।
যুগান্তের যম যেন সংহারিতে সৃষ্টি।
অরুণ আকার চক্ষু, চাহে এক দৃষ্টি।।
নাকে ঝড় বহে যেন প্রলয় সমান।
মহাবীর ভীমসেন কর্ণ পানে চান।।
দেখিয়া কৌরবগণ পায় বড় শঙ্কা।
হাতে গদা করি ভীম উঠে রণরঙ্কা।।
মাথায় ফিরায় গদা চক্রের আকার।
চরণের ভরে ক্ষিতি হয় ত বিদার।।
ক্রোধমুখ করি দুঃশাসন পানে ধায়।
অনুমতি লইবারে ধর্ম্ম পানে চায়।।
হেঁটমাথা যুধিষ্ঠির দেখিয়া ভীমেরে।
বুঝিয়া অর্জ্জুন গিয়া ধরিলেন তাঁরে।।
অর্জ্জুন বলেন, ভাই না কর অনীতি।
কি হেতু হেলন কর ধর্ম্ম-নরপতি।।
দিকপাল সহ যদি আইসে দেবরাজ।
আর যত বীর বৈসে ত্রৈলোক্যের মাঝ।।
ধর্ম্মেরে করিবে হেয় আমরা থাকিতে।
মুহূর্ত্তেকে পাঠাইব যমের ঘরেতে।।
কোন্ ছার এরা সব, তৃণ হেন গণি।
এখনি দহিতে পারি, কারে নাহি মানি।।
বিনা ধর্ম্ম-আজ্ঞায় নাহিক ভাই শক্তি।
কোন্ কাজ ভদ্র যাহে ধর্ম্মেতে অভক্তি।।
অস্বীকার ধর্ম্মের এ কর্ম্মে অভিপ্রায়।
সে কারণে এ কর্ম্ম করিতে না যুরায়।।
অর্জ্জুনের বচনে, হইল শান্তক্রোধ।
ফেলিলেন গদা ভীম মানি উপরোধ।।
আভরণ পরিধান যতেক আছিল।
পঞ্চ ভাই আপনা আপনি সব দিল।।
সভাত্যাগ করিয়া নিকৃষ্ট ধূল্যাসনে।
অধোমুখে বসিলেন ভাই পঞ্চজনে।।
হেনকালে দুষ্ট কর্ণ কহিল বচন।
দ্রৌপদী আনিতে দূত করহ প্রেরণ।।
শুনি দুর্য্যোধন তবে বিদুরে ডাকিল।
হাস্য উপহাসে তবে কহিতে লাগিল।।
তবে ধৃতরাষ্ট্র রাজা বুঝিয়া বিচার।
সভা হৈতে গৃহে তবে গেল আপনার।।