৩৬. ভ্রাতৃবর্গ ও দ্রৌপদীকে পণ করণ ও যুধিষ্ঠিরের পরাজয়

শকুনি বলিল চাহি ধর্ম্মের নন্দন।
সর্ব্বস্ব হারিলে আর কি করিবে পণ।।
যুধিষ্ঠির বলে, মম অসংখ্য রতন।
চারি সিন্ধু মধ্যে আছে মোর যত ধন।।
অযুত নিযুত কোটি খর্ব্ব মহাখর্ব্ব।
পদ্ম শঙ্খ করি অন্ত আছে যত সর্ব্ব।।
সকল করিনু পণ এবার সারিতে।
জিনি লইলাম, বলে গান্ধারের সুতে।।
যুধিষ্ঠির বলেন, যে আছে পশুগণ।
গাভী উষ্ট্র খর আর মেষ অগণন।।
সব করিলাম পণ এবার দ্যূতেতে।
জিনিলাম, বলি বলে সুবলের সুতে।।
যুধিষ্ঠির বলিলেন, পণ করি আমি।
আমার শাসিত আছে যত রাজ্যভূমি।।
ব্রাহ্মণের ভূমি গৃহ ছাড়িয়া রতন।
এবার দেবনে আমি করিলাম পণ।।
শকুনি বলিল, আমি জিনিনু সকল।
আর কি আছয়ে পণ কর মহাবল।।
ধর্ম্ম দেখিলেন, ধন কিছু নাহি আর।
কুমারগণের অঙ্গে যত অলঙ্কার।।
সকল করিলা পণ, জিনিল শকুনি।
দেখিয়া চিন্তিত বড় ধর্ম্ম-নৃপমণি।।
শকুনি বলিল, কহ কি আর বিচার।
বিচারি করেন পণ ধর্ম্মের কুমার।।
ক্ষিতি মধ্যে সুবিখ্যাত নকুল সুধীর।
কামদেব জিনি রূপ সুন্দর শরীর।।
সিংহগ্রীব পদ্মপত্র যুগল নয়ন।
এবার সারিতে নকুলেরে করি পণ।।
কপটে শকুনি বলে, বলি সারোদ্ধার।
তব প্রিয় ভাই এই পাণ্ডুর কুমার।।
কেমনে ইহারে পণ করিবা দেবনে।
এত বলি ফেলি পাশা লইলেক জিনে।।
ধর্ম্ম বলে, সহদেব ধর্ম্মজ্ঞ পণ্ডিত।
আমার পরম প্রিয় জগতে বিদিত।।
এবার সারিতে সহদেবে করি পণ।
জিনিলাম বলি বলে গান্ধার-নন্দন।।
কপট চাতুরী বাক্যে বলিল শকুনি।
আর কি আছয়ে পণ কর নৃপমণি।।
বৈমাত্রেয় দুই ভাই হারিলা সারিতে।
ভীমার্জ্জুন হারিবে না, লয় মম চিতে।।
ধর্ম্মরাজ বলে, তব দেখি দুষ্প্রকৃতি।
ভ্রাতৃভেদ ভাষা কেন কেহ মন্দমতি।।
আমি আর পঞ্চ ভাই একই পরাণ।
কি বুঝিয়া হেন বাক্য কহিলা অজ্ঞান।।
ভীত হৈয়ে শকুনি বলিছে সবিনয়।
সহজে পাশায় মত্ত সুজনেও হয়।।
মত্ত হৈলে অবক্তব্য বাক্য আসে মুখে।
তুমি শ্রেষ্ঠ গরিষ্ঠ, ক্ষমহ দোষ মোকে।।
পুনঃ যুধিষ্ঠির করিলেন এ উত্তর।
তিন লোকে খ্যাত যে আমার সহোদর।।
হেলে তরি পরসৈন্য সাগরের প্রায়।
যেই দুই বীর কর্ণধারের কৃপায়।।
হেলায় জিনিল দেবরাজে ভুজবলে।
অগণিত গুণ যার খ্যাত ক্ষিতিতলে।।
এ কর্ম্মেতে পণযোগ্য নহে হেন নিধি।
তথাপিহ করি পণ অক্ষক্রীড়া বিধি।।
শকুনি ফেলিয়া পাশা জিনিলাম বলে।
ধনঞ্জয়ে জিনি হৃষ্ট হয় কুরুদলে।।
ধর্ম্ম বলিলেন, পণ করি এইবার।
বলেতে মনুষ্য-লোকে সম নাহি যার।।
ইন্দ্র যেন দৈত্য দলি পালে সুরগণে।
সেই মত পালে ভীম পাণ্ডুর নন্দনে।।
পাশায় এ পণযোগ্য নহে হেন ধন।
তথাপিহ করি পণ দৈব নির্ব্বন্ধন।।
জিনিলাম বলি, তবে বলিল শকুনি।
আর কি আছয়ে পণ কর নৃপমণি।।
এত শুনি বলিলেন ধর্ম্মের নন্দন।
এত আছি মাত্র এবে, মোরে করি পণ।।
জিনিয়া শকুনি বলে কপট আচার।
পাপকর্ম্ম করিলা হে কুন্তীর কুমার।।
দ্রুপদ-কুমারী পণ করহ এবার।
জিনিয়া করহ রাজা আপন উদ্ধার।।
এ সকল থাকিতে আপনা নাহি হারি।
আপনি থাকিলে হয় বহু ধন নারী।।
রাজা বলে, মামা না সম্ভবে এই কথা।
কি মতে করিব পণ দ্রুপদ-দুহিতা।।
রূপেতে লক্ষ্মীর সম যাহার বর্ণনা।
অসংখ্য যাহার গুণ না হয় গণনা।।
মম সৈন্যসিন্ধু সম না হয় বর্ণন।
প্রত্যক্ষ সবার শুভচেষ্টা অনুক্ষণ।।
দ্বিজ ক্ষত্র দাস দাসী যত পশুগণ।
সবারে জননী-রূপে করয়ে পালন।।
হেন স্ত্রী করিব পণ, নাহি লয় মতি।
কপট করিয়া বলে শকুনি দুর্ম্মতি।।
লক্ষ্মী-অবতার রাজা তোমার গৃহিণী।
তাঁর ভাগ্যে কদাচিৎ পড়ে পাশা জানি।।
হারিলা আপনা রাজা করহ উদ্ধার।
আপনা হইতে বড় নাহি কেহ আর।।
বিপদে পড়িলে বুদ্ধি হারায় পণ্ডিত।
শকুনির বচন যে মানিলাম হিত।।
এতেক শুনিয়া কহিলেন যুধিষ্ঠির।
পাশা ফেল আরবার সেই পণ স্থির।।
এতেক শুনিয়া দুষ্ট পাশা ফেলাইল।
হাসিয়া শকুনি বলে জিনিল জিনিল।।
শুনি কর্ণ দুর্য্যোধর হাসে খল খল।
মহা আনন্দিত কুরু-সোদর সকল।।
বিপরীত কর্ম্ম দেখি ভাবে সভাজন।
ভীষ্ম দ্রোণ কৃপ হৈল সজল নয়ন।।
শির ধরি বিদুর বসিলা অধোমুখে।
জ্ঞানহত লোক যেন হয় মহাশোকে।।
হৃষ্ট হয়ে ধৃতরাষ্ট্র ডাকিয়া বলিল।
কে জিনিল, কে জিনিল বলি জিজ্ঞাসিল।।
বহুকালে প্রকাশিল কুটিল আচার।
না পারিল লুকাইতে ধৃতরাষ্ট্র আর।।
এইমতে সর্ব্বস্ব হারেন ধর্ম্মরায়।
সভাপর্ব্বে সুধারস কাশীদাস গায়।।