৩৬. দ্রোণাচার্য্যের যুদ্ধ ও পরাভব

কৃপাচার্য্য ভঙ্গ যদি হইল সমরে।
অর্জ্জুন বলেন তবে বিরাট কুমারে।।
রক্তবর্ণ চারি ঘোড়া যোড়া যেই রথে।
শীঘ্র রথ লহ মোর তাঁহার অগ্রেতে।।
শুনিয়া বিরাট পুত্র বায়ুসম বেগে।
চালাইয়া দিল রথ দ্রোণাচার্য্য আগে।।
নিকটে দেখিয়া দ্রোণ অর্জ্জুনের রথ।
আগুবাড়ি নিজে গুরু আসে কত পথ।।
গুরু দেখি পার্থ অস্ত্র যুড়েন যুগল।
দুই অস্ত্র পড়ে গিয়া দুই পদতল।।
আচার্য্য যুগল অস্ত্র এড়িল তখন।
দুই ভুজে ধরি পার্থে কৈল আলিঙ্গন।।
কর যুড়ি গুরুদেবে বলে ধনঞ্জয়।
যুদ্ধসজ্জা কি কারণে দেখি মহাশয়।।
কাহার সহিত যুদ্ধ করিবে আপনে।
আমারে মারিবে অস্ত্র হেন লয় মনে।।
অশ্বত্থামাধিক আমি তোমার পালিত।
কোন্ দোষে দোষী পায় নহি যে দোষিত।।
পাশাকালে কথা তুমি জানহ আপনে।
কপটে যতেক দুঃখ দিল দুষ্টগণে।।
দ্বাদশ বৎসর বনে বঞ্চিলাম ক্লেশে।
অজ্ঞাত বঞ্চিনু এক বর্ষ ক্লীববেশে।।
এ কষ্টের হেতু যেই বৈরী দুষ্টগণ।
এত দিনে পাইলাম তার দরশন।।
যথোচিত ফল আজি দিব আমি তারে।
দুঃখ নিবেদন এই করিনু তোমারে।।
ইহাতে আপনি প্রভু না করিবে ক্রোধ।
তব ক্রোধ করিলে না করি উপরোধ।।
আজ্ঞা কর, একভিতে লহ নিজ রথ।
দুর্য্যোধনে ভেটি গিয়ে, ছাড়ি দেহ পথ।।
হাসিয়া বলেন দ্রোণ, এ কোন্ উচিত।
কৌরবের সেনাগণ আমার রক্ষিত।।
মম অগ্রে কৌরবেরে করিবে ঘাতন।
কিমতে দাঁড়ায়ে আমি করিব দর্শন।।
পার্থ বলে, পাছে দোষ না দিও আমায়।
তোমারি শিক্ষিত বিদ্যা দেখাব তোমায়।।
ইহা শুনি গুরু ক্রোধে হয়ে হুতাশন।
আকর্ণ পূরিয়া এড়ে দিব্য অস্ত্রগণ।।
তিন শত অস্ত্র ‍ামরে অর্জ্জুন উপর।
কাটিয়া অর্জ্জুন বীর ফেলিলেন শর।।
ব্যর্থ বাণ দেখি গুরু ক্রোধে গুরুতর।
অর্জ্জুনে মারিল পুনঃ সহস্র তোমর।।
অন্ধকার করি যায় গগন মণ্ডলে।
শরতের কালে যেন হংসপংক্তি চলে।।
দিব্য অস্ত্র ধনঞ্জয় পূরিয়া সন্ধান।
কাটিয়া ফেলেন যত আচার্য্যের বাণ।।
পুনঃ দিব্য অস্ত্র গুরু মন্ত্রে অভিষেকি।
সম্বর সম্বর বলে অর্জ্জুনেরে ডাকি।।
আকাশে উঠিল অস্ত্র যেন দিবাকর।
মুখ হতে বৃষ্টি হয় মুষল মুদগর।।
পরশু তোমর জাঠি, নাহি লেখাজোখা।
চতুর্দ্দিকে পড়ে যেন জ্বলন্ত উল্কা।।
অস্ত্র এড়ি দ্রোণাচার্য্য ব্যথিত হৃদয়।
ডাকিয়া বলিল, সম্বরহ ধনঞ্জয়।।
দেখিয়া অর্জ্জুন, বাণ এড়েন গন্ধর্ব্ব।
নিমিষেতে নিবারেন গুরু অস্ত্র সর্ব্ব।।
দোঁহে দিব্য শিক্ষা, রণে না করে বিশ্রাম।
গুরু শিষ্যে এই মত হইল সংগ্রাম।।
ক্রোধে গুরু, পঞ্চ বাণ মারে কপিধ্বজে।
বাণাঘাতে কপিধ্বজ অধিক গরজে।।
পুনঃ দিব্য বাণ পূরে গুরুদেব দ্রোণ।
গগন ছাইয়া কৈল অস্ত্র বরিষণ।।
না দেখি বানরধ্বজ সারথি অর্জ্জুন।
মেঘে যেন আচ্ছাদিল না দেখি অরুণ।।
দ্রোণের বিক্রমে উল্লসিত দুর্য্যোধন।
নিমিষেকে অস্ত্র তার কাটেন অর্জ্জুন।।
তবে পার্থ দিব্য অস্ত্র করিয়া সন্ধান।
আচার্য্যেরে মারিলেন সহস্রেক বাণ।।
সহস্র সহস্র বাণ আচার্য্য মারিল।
দুই অস্ত্রে গগণেতে মহাশব্দ হৈল।।
ঢাকিল সূর্য্যের তেজ, ছাইল আকাশ।
অন্ধকার হৈল সূর্য্য, রুধিল বাতাস।।
অস্ত্র অস্ত্র ঘরিষণে হৈল উল্কা বৃষ্টি।
অমর ভুজঙ্গ নর চাহে একদৃষ্টি।।
আকাশে প্রশংসা করে যত দেবগণ।
সাধু দ্রোণাচার্য্য ভরদ্বাজের নন্দন।।
যাহার শিক্ষিত বিদ্যা অদ্ভুত দর্শন।
যার শিষ্য ধনঞ্জয় জয়ী ত্রিভুবন।।
তবে পার্থ ইন্দ্র-অস্ত্র যোড়েন গাণ্ডীবে।
সহস্র সহস্র বাণ যাহাতে প্রসবে।।
মন্ত্রে অভিষেকি বাণ মারেন তখন।
চক্ষুর নিমিষে সব ছাইল গগন।।
যেন মহা-দাবানলে বেড়িল পর্ব্বত।
অস্ত্র-অগ্নি আচ্ছাদিল, নাহি দেখি পথ।।
অগ্নিতে বেড়িল দ্রোণে, নাহি দেখি আর।
যতেক কৌরবদল করে হাহাকার।।
সাধু ধনঞ্জয় বলি ডাকে দেবগণ।
সুগন্ধি কুসুম কত করে বরিষণ।।
বাপের সঙ্কট দেখি অশ্বত্থামা বেগে।
জনকে করিয়া পাছে হৈল পার্থ আগে।।