৩৪. তাম্রধ্বজের সহিত অর্জ্জুনাদির যুদ্ধ

শ্রীজনমেজয় বলে শুন তপোধন।
অশ্ব লয়ে কোথা গেল পাণ্ডুর নন্দন।।

বলেন বৈশম্পায়ন শুন জন্মেজয়।
রত্নাবতী পুরে গেল পাণ্ডবের হয়।।
রত্নাবতীপুরে রাজা ময়ুরধ্বজ নাম।
বড়ই ধার্ম্মিক রাজা সর্ব্ব গুণধাম।।
সংগ্রামে নাহিক কেহ তাহার সমান।
তার নামে বীরগণ কেহ তাহার সমান।।
তার নামে বীরগণ হয় কম্পমান।
অশ্বমেধ যজ্ঞ করিলেন নরপতি।।
অশ্বরক্ষা করে তাম্রধ্বজ মহামতি।
অশ্ব লয়ে আছে সেই নর্ম্মদার তীরে।।
দৈবে অর্জ্জুনের অশ্ব গেল সেই পুরে।
অশ্ব দেখি তাম্রধ্বজ আনন্দিত মন।।
অশ্বকে ধরিল বীর করিয়া যতন।
লিখন পড়িয়া তার হৈল অহঙ্কার।।
পাণ্ডব সমান বীর কেহ নাহি আর।
বীরবেশ অহঙ্কারে কাঁপে কলেবরে।।
ডাক দিয়া বলিল যতেক অনুচরে।
বান্ধিয়া রাখহ ঘোড়া করিয়া যতন।।
দেখি কি করিতে পারে পাণ্ডুর নন্দন।
অহঙ্কারে অশ্বভালে করেছে লিখন।।
ধরিতে আমার ঘোড়া পারে কোনজন।
শীঘ্র লহ সেনাগণ ধনুর্ব্বাণ হাতে।।
সকলে সুসজ্জ হও সংগ্রাম করিতে।
আপাদেশে অনুচর অশ্ব লয়ে গেল।।
তাম্রধ্বজ যুদ্ধ হেতু সুসজ্জ হইল।
শিখিধ্বজ সুত অশ্ব ধরিলেক বলে।।
কিরীটি শুনিয়া আজ্ঞা করেন সকলে।

আগে হৈল বৃষকেতু লয়ে ধনুর্ব্বাণ।।
তাম্রধ্বজ সহ তার বাজিল সংগ্রাম।
ডাক দিয়া বৃষকেতু বলে উচ্চৈঃস্বরে।।
কে ধরিল যজ্ঞ ঘোড়া মরিবার তরে।
যুধিষ্ঠির সহায় আপনি নারায়ণ।।
পাণ্ডবে জিনিতে নারে এ তিন ভুবন।
তাম্রধ্বজ বলে কৃষ্ণ সবাকার প্রতি।।
বুঝিয়া কহ কেন কুৎসিত ভারতী।
ভক্তের অধীন কৃষ্ণ ভজনেতে পাই।
এ তিন ভুবনে তাঁর শত্রু কেহ নাই।।
পাণ্ডবের কৃষ্ণ বলি কর অহঙ্কার।
শুন বৃষকেতু জ্ঞান নাহিক তোমার।।
দেখিব কেমনে আজি জিনিবে সংগ্রাম।
অশ্ব নিয়া নিজদেশে করহ প্রয়াণ।।
মম পিতা অশ্বমেধ যজ্ঞ আরম্ভিল।
অশ্ব রাখিবার তরে মোরে পাঠাইল।।
ভাল হৈল এই অশ্ব দৈবে দিল আনি।
লইতে যজ্ঞের ঘোড়া না পারিবা তুমি।।

বৃষকেতু বলে শুন নৃপতি নন্দন।
জিনিয়া আনিল সঙ্গে যত রাজগণ।।
যুবনাশ্ব নীলধ্বজ হংসধ্বজ আদি।
পরাভব পেয়ে সবে আইল সংহতি।।
বৃথা অহঙ্কার কর মরিবে এখন।
নহে অশ্ব কিরীটিরে করহ অর্পণ।।
বৃষকেতু বাক্যে বীর ক্রুদ্ধ হৈল মনে।
যুড়িল পঞ্চাশ বাণ ধনুকের গুণে।।
কর্ণের নন্দন নিবারিতে না পারিল।
তাম্রধ্বজ বাণে বীর জর্জ্জর হইল।।
তবে তাম্রধ্বজ বীর পাঁচ বাণ দিয়া।
বৃষকেতু রথধ্বজ ফেলিল কাটিয়া।।
তুণ গুণ কাটিলেন রথের সারথি।
বিরথ হইল বৃষকেতু মহামতি।।
দশ বাণে তাম্রধ্বজ তাহাকে বিন্ধিল।
কর্ণের নন্দন রণে মূর্চ্ছিত হইল।।

তবে যুবনাশ্ব রাজা সুবেগ সহিত।
করে বহু যুদ্ধ তাম্রধ্বজের সহিত।।
পিতা পুত্রে মুর্চ্ছিত হইল দুইজনে।
তবে অনুশাল্ব আসি প্রবেশিল রণে।।
তাম্রধ্বজ সহ কৈল অনেক সংগ্রাম।
ভূমিতে পড়িল দৈত্য হইয়া অজ্ঞান।।
তবে হংসধ্বজ আর সে বভ্রুবাহন।
প্রাণপণে দুই জনে কৈল মহায়ণ।।
মহাবীর তাম্রধ্বজ ভয় নাহি করে।
জনিতে নারিল কেহ তাম্রধ্বজ বারে।।
প্রাণপণে ‍যুঝে সবে অনেক প্রকার।
অচেতনে পড়ি গেল রথের উপর।।
কেহ ভূমি পড়ি গেল হয়ে অচেতন।
তবে রণে প্রেবিশিল কৃষ্ণের নন্দন।।
তাম্রধ্বজ সনে সেও অনেক যুঝিল।
বাহুল্য কারণ তাহা লেখা নাহি গেল।।
তাম্রধ্বজ বাণে তার শেষ হৈল তনু।
অচেতন হয়ে রণে পড়ে ফুলধনু।।
আইল সাত্যকি ভীম করিতে সমর।
ছাইল গগন তবে এড়ি নানা শর।।
মহাবীর তাম্রধ্বজ ভয় নাহি করে।
কাটিল ভীমের গদা দিব্য পাঁচ শরে।।
ধনুর্ব্বাণ হাতে লয়ে বীর বৃকাদর।
তাম্রধ্বজ সহ কৈল অনেক সমর।।
সাত্যকি সাহস করি এড়ে নানা বাণ।
নৃপতি তনয় তাহা করে খান খান।।
তবে তাম্রধ্বজ বীর আশী বাণ দিয়া।
বিন্ধিলেক ভীমসেনে জর্জ্জর করিয়া।।
সাত্যকি সহিত তবে বাধে মহারণ।
তারে পরাজিল শিখিধ্বজের নন্দন।।
এ সব ঈশ্বরলীলা কেহ নাহি জানে।
যতেক পাণ্ডবসৈন্য পরাজিল রণে।।
তাহা দেখি কিরীটির ক্রোধ হৈল মনে।
গাণ্ডীব লইয়া বীর প্রবেশের রণে।।
কিরীটী দেখিয়া তবে তাম্রধ্বজ বীর।
তীক্ষ্ণবাণ দিয়া তার বিন্ধিল শরীর।।
কিরীটী যতেক বাণ যুড়েন ধনুকে।
তাম্রধ্বজ নিবারিল বাণ দিয়া তাকে।।
নিবারিতে না পারিয়া তাম্রধ্বজ শরে।
পার্থের জর্জ্জর অঙ্গ রক্ত বহে ধারে।।
মহাকোপে উপজিল পাণ্ডুর নন্দনে।
ভয় পেয়ে জিজ্ঞাসেন তবে নারায়ণে।।
ওহে কৃষ্ণচন্দ্র আমি না পারি বুঝিতে।
সংগ্রামে সমর্থ নাহি তাম্রধ্বজ সাথে।।
ভীষ্ম দ্রোণ কর্ণবীরে পরাজিনু আমি।
নিবাতকবচে বিনাশিনু চক্রপাণি।।
খাণ্ডব দহিনু আমি তুষিনু অনলে।
কালকেতু নিপাত করিনু বাহুবলে।।
সংগ্রাম করিয়া আমি তুবিনু শঙ্করে।
জিনিনু কৌরবগণে বিরাট নগরে।।
চিত্ররথ গন্ধর্ব্বের কৈনু অপমান।
আপনি জানহ তুমি আমার সংগ্রাম।।
সুরথ সুধন্বা আমি নিপাতিনু রণে।
যুঝিতে না পারি আমি তাম্রধ্বজ সনে।।
বীর নাহি দেখি তাম্রধ্বজের সমান।
শুন কৃষ্ণ পাইলাম বড় অপমান।।

গোবিন্দ বলেন সখা ত্যজহ সমর।
মহাবলবান শিখিধ্বজের কোঙর।।
জিনিতে নারিবে তুমি তাম্রধ্বজ বীরে।
বৈষ্ণব উহার পিতা বিদিত সংসারে।।
গোবিন্দ বলেন সখা কর অবধান।
তুমি কিন্বা আমি ‍হারি একই সমান।।
তোমাতে আমাতে সখা কিছু ভেদ নাই।
ভক্তের মর্য্যাদা আমি রাখিবারে চাই।।
রাজার সাহস আজি দেখাব তোমারে।
চল দুইজন যাই পুরীর ভিতরে।।
শিখিধ্বজ সম দাতা নাহি ত্রিভুবনে।
সংগ্রাম ত্যজহ তুমি আমার বচনে।।
দ্বিজবেশ ধরিয়া রাজার ঠাই যাব।
নৃপতি সাহস আমি তোমারে দেখাব।।
পাইবে যজ্ঞের ঘোড়া ভয় নাহি মনে।
সংগ্রাম ত্যজিয়া তুমি এস মোর সনে।।

এত শুনি ধনঞ্জয় কৃষ্ণের উত্তর।
ঈষৎ হাসিয়া বীর ত্যজেন সমর।।
পাণ্ডবের কৃষ্ণ বলি জানে সর্ব্বজন।
তব পদে ভক্তি মোর নাহি নারায়ণ।।
দর্পহারী তব নাম বিদিত সংসারে।
সাক্ষাৎ সে দর্প তুমি দেখাও আমারে।।
এত ‍শুনি কৃষ্ণচন্দ্র হাস্যমুখে কন।
তোমা বিনা সখা মম আছে কোন্ জন।।
রণ জিনি তাম্রধ্বজ ছাড়ে সিংহনাদ।
চলিল বাপের ‍পাশে লইতে প্রসাদ।।
অশ্বমেধ পুণ্যকথা অমৃত সমান।
কাশীরাম দাস কহে শুনে পুণ্যবান।।