৩২. ভীষ্মের শরশয্যা

সঞ্জয় বলেন, ভীষ্ম পড়িল সংগ্রামে।
ঘৃণায় না কৈল রণে শিখণ্ডীর সনে।।
জামদগ্ন্য বীর যাঁরে জিনিতে না পারে।
হেন বীর পড়িলেক শিখণ্ডীর শরে।।
আনন্দিত হৈল যত পাণ্ডবের গণ।
তবে দ্রোণ নিষেধিল আজি নাহি রণ।।
মলিন বদন হৈলা কৌরবের গণ।
পাণ্ডবের গণ হৈলা আনন্দিত মন।।
সবাকার তরে দ্রোণ কহিলা বচন।
পাণ্ডবে কৌরব দূত করহ প্রেরণ।।
যাবৎ না ভীষ্মে দেখি সবে ততক্ষণ।
দুই দলে তাবৎ না করি কোন রণ।।
হেনমতে দুই দলে সত্য আচরিল।
যত রাজরাজেশ্বর সকলি চলিল।।
পাণ্ডবের মহাবীর যত সেনাগণ।
ভীষ্মেরে দেখিতে শ্রদ্ধা সবাকার মন।।
যুদ্ধবেশ ছাড়িয়া নৃপতি শতে শতে।
একত্র চলিলা সবে ভীষ্মে সম্ভাষিতে।।
রথ হৈতে নামি তবে ধর্ম্মের নন্দন।
ভীষ্মে দেখিবারে যান সহ জনার্দ্দন।।
ভীম ধনঞ্জয় আর মাদ্রীর তনয়।
সাত্যকি দ্রুপদ ধৃষ্টদ্যুম্ন মহাশয়।।
অভিমন্যু ঘটোৎকচ মৎস্য অধিপতি।
দ্রৌপদীর পঞ্চ পুত্র রাজার সংহতি।।
শরের শয্যায় যথা আছে ভীষ্মবীর।
প্রণাম করিয়া কহিছেন যুধিষ্ঠির।।
ওহে পিতামহ তুমি বলে বীরবর।
সত্যবাদী জিতেন্দ্রিয় মর্য্যাদা-সাগর।।
ভৃগুরাম অভিশাপ দিলেন তোমারে।
দুর্য্যোধন হেতু তাহা ফলিল সমরে।।
শিশুকালে পিতৃহীন হৈনু পঞ্চ জনে।
পিতৃশোক না জানিনু তোমার কারণে।।
আজি পুনঃ বিধি তাহে হইলেন বাম।
এত দিনে আমরা অনাথ হইলাম।।
ধিক্ ক্ষত্রধর্ম্ম, মায়া মোহ নাহি ধরে।
হেন পিতামহ দেবে নাশিনু সমরে।।
ওহে মহাশয় এই উপস্থিত কালে।
নয়ন ভরিয়া দৃষ্টি করহ সকলে।।
হাসি ভীষ্ম মহাবীর নয়ন মেলিল।
সাধু সাধু বলি ধর্ম্মপুত্রে প্রশংসিল।।
কৌরব পাণ্ডব সবে মহাধনুর্দ্ধর।
চারিদিকে বেড়িলেক ভীষ্ম মহাবল।।
বক্রদৃষ্টি হেঁটমুখে বলয়ে বচন।
পতিত আমার শির দেখ দুর্য্যোধন।।
কোন্ মহাবীর আছে ক্ষত্রিয় প্রধান।
মাথা যেন না লুটায়, দেহ উপাধান।।
তোমা সবাকার যেন যুদ্ধ সদা দেখি।
হেন স্থান করি সবে মোরে যাও রাখি।।
রথ হৈতে দুর্য্যোধন আনিল সত্বরে।
দিব্য দিব্য উপাধান ভীষ্মের শিয়রে।।
হাসিয়া বলেন ভীষ্ম শয্যা মম শর।
হেন উপাধান কোন হেতু নৃপবর।।
ক্ষত্ররাজ হইয়া না বুঝহ সময়।
মস্তক তুলিয়া দেখে বীর ধনঞ্জয়।।
ভীষ্ম-মন বুঝিয়া অর্জ্জুন ধনুর্দ্ধর।
প্রণমিয়া গাণ্ডীবে যোড়য়ে দিব্যশর।।
তিন বাণ হানিলেক দৃঢ় মুষ্টি করি।
মস্তকের তিন ভাগে রহে সম করি।।
পুনরপি বলে ভীষ্ম শুন পার্থ বীর।
শয্যা করি দেহ যাহে থাকিবে সুস্থির।।
গাণ্ডীব লইয়া বীর পূরিয়া সন্ধান।
অস্ত্র এড়ি শরশয্যা করিল নির্ম্মাণ।।
অস্ত্রেতে তুলিল ভীষ্মে তাহার উপরে।
চরণ লম্বিত করি উচ্চ স্থান শরে।।
ভীষ্ম শুয়ে নেহারয়ে কুরুক্ষেত্র স্থান।
যুদ্ধস্থান সকল সম্মুখে বিদ্যমান।।
কৌরব পাণ্ডব দেখে সব সমুদিত।
ভীষ্ম বলে হও সাম্য এই ত উচিত।।
কৌরব পাণ্ডবে রণ না হয় উচিত।
বিবাদ না কর সব মোর সমুদিত।।
আজ্ঞা কৈলা ভীষ্মবীর পরিহর রণ।
জীয়ন্তে থাকহ সবে রাখহ বচন।।
বংশরক্ষা কর তুমি শুন দুর্য্যোধন।
আমার বচনে তুমি হও সম্বরণ।।
এই কথা ভীষ্মবীর কহিলেন যবে।
দুর্য্যোধন প্রত্যুত্তর দিলেন সে তবে।।
আমার কারণে হৈল তোমার নিধন।
পাণ্ডব সহিত প্রীতি কিসের কারণ।।
প্রাণ সংকল্পিনু আমি পাণ্ডবের রণে।
জীয়ন্তে পাণ্ডবসহ প্রীতে নহে মনে।।
এত শুনি নিবর্ত্তিল গঙ্গার নন্দন।
মনে ক্ষমা দিল জানি অদৃষ্ট লিখন।।
প্রণমিয়া ভীষ্মেরে রক্ষক দিয়া সব।
আপন শিবিরে গেলা কৌরব পাণ্ডব।।
একত্র বসিলা যত প্রধান পাণ্ডব।
যুধিষ্ঠিরে সম্বোধিয়া বলেন মাধব।।
এবে ত পড়িল ভীষ্ম অবধ্য দেবের।
সত্যবাদী মহাবীর পারগ শাস্ত্রের।।
ক্রোধ কৈলে ত্রিসংসারে পোড়াইতে পারে।
তোমা লাগি হেন বীর পড়িল সমরে।।
তবে যুধিষ্ঠির রাজা কহিল কৃষ্ণেরে।
তোমার প্রসাদে জয় হইল সমরে।।
পাণ্ডবের জয় তুমি ভক্তের অভয়।
তুমি যার হিতকর্ত্তা তার কিবা ভয়।।
অধিক আশ্চর্য্য নহে ভীষ্ম পরাজয়।
তোমার প্রসাদে প্রভু সর্ব্বত্রেতে জয়।।
মহাভারতের কথা অমৃত-লহরী।
কাশী কহে ভক্তজন পীয় কর্ণ ভরি।।