৩০. কর্ণ কর্ত্তৃক ঘটোৎকচ বধ

কি করিব কি হইবে ইহার উপায়।
ভাবিতে ভাবিতে তার হৃদয় শুকায়।।
চিন্তাজ্বর উপজিল থর থর কাঁপি।
আগুন ছুটিল গায় হয়ে অনুতাপী।।
হেনকালে অশ্বথামা দ্রোণের নন্দন।
কর্ণেরে কহিল শুন আমার বচন।।
একঘাতী অস্ত্র আছে তোমার সদনে।
বজ্রের সদৃশ অস্ত্র নহে নিবারণে।।
সেই অস্ত্র এড়ি মার ভীমের নন্দন।
অবশ্য সংহার হবে না যায় খণ্ডন।।
ইহা বিনা আর কিছু না দেখি উপায়।
সেই বাণে হবে ক্ষয় কহিনু তোমায়।।
কর্ণ বলে সেই বাণে বধিব অর্জ্জুনে।
যতনে রাখিনু আমি তাহার কারণে।।
কবচ বিতরি পাই সেই মহাবাণ।
তাহাতে অর্জ্জুন বীর না ধরিবে টান।।
এই অস্ত্রাঘাতে যদি ঘটোৎকচে বধি।
নিশ্চয় লিখিল মম মৃত্যু তবে বিধি।।
অর্জ্জুনের হাতে মম অবশ্য মরণ।
করিল বিধাতা তার এই সংঘটন।।
বধিতাম অর্জ্জুনে অবশ্য এই বাণে।
যত্ন করি রাখিয়াছি তাহার কারণে।।

অশ্বথামা বলে, ভাল বলিলে বিধান।
আজি ঘটোৎকচেরে কর সমাধান।।
ইহার হাতেতে যদি রক্ষা পাও রণে।
তবে অর্জ্জুনেরে তুমি বধিবে জীবনে।।
এই শুনি কর্ণ কহে আনন্দিত মন।
ভাল যুক্তি কহিলা হে গুরুর নন্দন।।
দুর্য্যোধন বলে শুন কর্ণ ধনুর্দ্ধর।
এই অস্ত্র এড়িয়া রাক্ষস বধ কর।।
হেন অস্ত্র আছে যদি তোমার সদনে।
তবে চিন্তা কর তুমি কিসের কারণে।।
অর্জ্জুনে বধিবে বলি রাখিয়াছে বাণ।
যে হয় পশ্চাৎ তার করিব বিধান।।
আজি রক্ষা কর ঝাট রাক্ষসের হাতে।
কেমনে দেখহ সেনা সংহারে সাক্ষাতে।।
এইকালে শীঘ্র কর রাক্ষস সংহার।
কোটি কোটি সৈন্য দেখ মারিল আমার।।

এত শুনি কর্ণবীর চলিল সত্বর।
হাতে ধনু করি উঠে রথের উপর।।
মহাদম্ভ করি যায় রবির নন্দন।
দেখি দুর্য্যোধন হৈল আনন্দিত মন।।
তবে কর্ণ মহাবীর সন্ধান পূরিয়া।
ঘটোৎকচ সন্নিধানে উত্তরিল গিয়া।।
কোপে ঘটোৎকচ বীর গদা লয়ে করে।
হুঙ্কার করিয়া ধায় সংগ্রাম ভিতরে।।
গদার প্রহারে মারে বড় বড় রথী।
নলবন দলে যেন মদমত্ত হাতী।।
গলা ধরি ঘোড়া মারে করি কুম্ভে গদা।
গর্জ্জিয়া গজেন্দ্র পড়ে, পাড়ে রণে গদা।।
চরণের বীরদাপে বসুমতী কাঁপে।
সাগর লঙ্ঘিতে যার শক্তি একলাফে।।
বাণ নাহি বিন্ধে গায় উখড়িয়া পড়ে।
ঘন ঘন সংগ্রামেতে সিংহনাদ ছাড়ে।।
বিপরীত বীরবর মহা বক্রগতি।
দেখি মহাকোপে ধায় অঙ্গদেশ পতি।।
লইয়া একাঘ্নী অস্ত্র রবির তনয়।
সন্ধান পূরিয়া মারে রাক্ষস হৃদয়।।
অনল সমান চলে একঘাতী অস্ত্র।
দেখি ঘটোৎকচ ভয়ে হইলা নিরস্ত্র।।
পর্ব্বত হইয়া অস্ত্র আইসে ত্বরিতে।
পড়িছে অনলকণা সে অস্ত্র হইতে।।
বাণ দেখি রাক্ষসের উড়িল পরাণ।
নিতান্ত ইহার হাতে নাহিক এড়ান।।
নানা অস্ত্র এড়ে বীর বাণ কাটিবারে।
মুষল মুদগর মারে অস্ত্রের উপরে।।
সর্ব্ব অস্ত্র ব্যর্থ করি ধায় বাণপতি।
বক্ষঃদেশ বিন্ধিলেক ঘটোৎকচ রথী।।
বাণাঘাতে ব্যথিত হইল বীরবর।
ডাকিয়া বলিল শুন পিতা বৃকোদর।।
হেন বুঝি অন্তকাল হইল আমার।
মৃত্যুকালে কি করিব তব উপকার।।

এত শুনি বৃকোদর শোকেতে আকুল।
ডাকিয়া বলিল চাপি পড় কুরুকুল।।
বারকর্ম্ম করিয়াছ অতুল সংসারে।
সম্মূখ সংগ্রামে পড়ি যাও স্বর্গপুরে।।
এত শুনি ঘটোৎকচ হৈল ভয়ঙ্কর।
দ্বাদশ যোজন দীর্ঘ করে কলেবর।।
কুরুবল চাপিয়া পড়িল মহাশূর।
লক্ষ লক্ষ রথ অশ্ব করিলেক চূর।।
শত শত হস্তী পড়ে দীর্ঘ দীর্ঘ দন্ত।
পদাতিক যত পড়ে নাহি তার অন্ত।।
কুরুবল ক্ষয় করে ভীমের নন্দন।
দেখি শোকাকুল তাহে যত বন্ধুজন।।
দুই দলে হইল ক্রন্দন কোলাহল।
প্রলয়ের কালে যেন সমুদ্র কল্লোল।।
দ্বিতীয় প্রহর রাত্রি ঘোর অন্ধকার।
এই কালে ঘটোৎকচ হইল সংহার।।
রোদন করয়ে যত পাণ্ডবের সেনা।
কুরুকুলে জয় জয় বাজিছে বাজনা।।
দ্রোণপবর্ব সুধারস ঘটোৎকচ বধে।
কাশীরাম দাস কহে পাঁচালীর ছাঁদে।।