২৯. শিশুপালের প্রতি যুধিষ্ঠির ও ভীষ্মের ‍বাক্য

শীঘ্রগতি যুধিষ্ঠির ত্যজি সিংহাসন।
শিশুপাল প্রতি কহে মধুর বচন।।
এ কর্ম্ম তোমার যোগ্য নহে চেদীশ্বর।
যজ্ঞ হৈতে লয়ে যাও সব নৃপবর।।
কি কারণে নিন্দা কর গঙ্গার নন্দনে।
আপনি দেখহ বড় বড় রাজগণে।।
কৃষ্ণের পূজায় কারো নাহি অপমান।
মুনিগণ আদি সবে আনন্দ-বিধান।।
পিতামহ জানেন যে গোবিন্দের তত্ত্ব।
প্রথমে পূজিয়া তাঁরে রাখেন মহত্ত্ব।।
ভীষ্ম বলিছেন, শুন ধর্ম্ম গুণাধার।
মান্যযোগ্য নহে দমঘোষের কুমার।।

কৃষ্ণপূজা করিবারে নিন্দে যেই জন।
সে জনারে মান্য না করিও কদাচন।।
দুষ্টবুদ্ধি শিশুপাল অল্প তার জ্ঞান।
রাজগণ মধ্যে না লিখিবা তার নাম।।
পূজা করে কৃষ্ণপদ ত্রৈলোক্য অবধি।
আমি কিসে গণ্য, যাঁরে পূজা করে বিধি।।
বহু বহু জ্ঞানী বৃদ্ধলোক-মুখে শুনি।
কৃষ্ণের মহিমা নাহি জানে পদ্মযোনি।।
জন্ম হৈতে কৃষ্ণের মহিমা অগোচর।
আমি কি বলিব সব খ্যাত চরাচর।।
পূর্ব্বে সাধুজন সব করিয়াছে পূজা।
পৃথিবীর রাজমধ্যে শ্রেষ্ঠ এই রাজা।।
বিপ্রমধ্যে পূজা পায় জ্ঞানী বৃদ্ধগণ।
ক্ষত্রমধ্যে বলবানে করি যে পূজন।।
বৈশ্যমধ্যে পূজা আগে বহু ধান্য ধনে।
শূদ্রমধ্যে পূজা পায় বয়োধিক জনে।।
যত ক্ষত্রগণ আছে সভার ভিতরে।
কোন্ জন জ্ঞাত নহে দেব দামোদরে।।
কোন্ রূপে কৃষ্ণ ন্যূন এ সভার মাঝ।
কুলে বলে কৃষ্ণ তুল্য আছে কোন্ রাজ।।
দান যজ্ঞ ধর্ম্ম আর কীর্ত্তি সম্পদেতে।
সংসারের যত গুণ আছয়ে কৃষ্ণেতে।।
সংসারের যত কর্ম্ম যে জন করয়।
গোবিন্দেরে সমর্পিলে সর্ব্ব সিদ্ধ হয়।।
প্রকৃতি অব্যক্ত কৃষ্ণ আদি সনাতন।
সর্ব্বভূতে আত্মারূপে আছে সেই জন।।
আকাশ পৃথিবী তেজ সলিল মরুত।
সংসারে যতেক সব কৃষ্ণে প্রতিষ্ঠিত।।
অল্পবুদ্ধি শিশুপাল কিছু নাহি জানে।
কৃষ্ণপূজা নিন্দা করে তাহার কারণে।।
এতেক বলেন যদি গঙ্গার নন্দন।
সহদেব বলিতে লাগিল ততক্ষণ।।
অপ্রমেয়-পরাক্রম যেই নারায়ণ।
হেন প্রভু পূজিবারে নিন্দে যেই জন।।
তাহার মস্তকে আমি বাম পদ দিয়া।
এ সভার মধ্যে তেঁই বলিব ডাকিয়া।।
রাজনীতি-বুদ্ধিবলে অধিক কে আছে।
কৃষ্ণ হৈতে এ সবার মধ্যে সবে পাছে।।
এতেক বলিল যদি মাদ্রীর নন্দন।
ঘৃত দিলে প্রজ্জ্বলিত যেন হুতাশন।।
শিশুপাল আদি করি যত নৃপগণ।
ক্রোধভরে গর্জ্জিয়া উঠিল ততক্ষণ।।
যজ্ঞ নাশ কর আর মারহ পাণ্ডব।
বৃষ্ণিবংশ মার আর মারহ মাধব।।
এত বলি রাজগণ মহা কোলাহলে।
প্রলয় সময়ে যেন সমুদ্র উথলে।।
রাজগণ-আড়ম্বর দেখি ধর্ম্মরায়।
ভীষ্মেরে বলেন কহ ইহার উপায়।।
রাজার সমুদ্র এই ক্রোধে উথলিল।
না দেখি কুশল বুঝি অনর্থ ঘটিল।।
ইহার বিধান আজ্ঞা কর মহাশয়।
রাজগণ রক্ষা পায় যজ্ঞ পূর্ণ হয়।।
ভীষ্ম বলিলেন, রাজা না করিহ ভয়।
প্রথমে কহেছি আমি ইহার উপায়।।
গোবিন্দেরে আরাধনা করে যেই জনে।
তাহার কাহারে ভয় এ তিন ভুবনে।।
এই সব ক্রুদ্ধ যত দেখ রাজগণ।
শৃগালের সম দেখে দেবকী-নন্দন।।
যতক্ষণ সিংহ নিদ্রা হৈতে নাহি উঠে।
গর্জ্জয়ে শৃগালগণ তাহার নিকটে।।
যতক্ষণ গোবিন্দ না করে অবধান।
ততক্ষণ গর্জ্জিবেক এ সব অজ্ঞান।।
শিশুপালের বুদ্ধিতে গর্জ্জে যত জন।
তাহারা যাইবে শীঘ্র যমের সদন।।
অগ্নি দেখি পতঙ্গ বিক্রম যত করে।
ক্ষণমাত্রে ভস্ম হয় পরশি অগ্নিরে।।
উৎপত্তি প্রলয় স্থিতি যাঁহার স্বভাব।
মূঢ় শিশুপাল কিছু না জানে সে ভাব।।
ভীষ্মের বচন শুনি দমঘোষ-সুত।
কটু বাক্যে নিন্দা করি বলিল বহুত।।
বৃদ্ধ হৈলি নাহি লজ্জা কুলাঙ্গার ওরে।
বিভীষিকা প্রাণভয় দেখাও সবারে।।
বৃদ্ধ হৈলে প্রায় লোক মহিচ্ছন্ন হয়।
ধর্ম্মচ্যুত কথা তাই কহ দুরাশয়।।
কুরুগণ-মধ্যে তোমা দেখি এই মত।
অন্ধ যেন অন্ধ স্থানে জিজ্ঞাসয়ে পথ।।
কৃষ্ণের বড়াই নাহি কর বহুতর।
তাহার মহিমা যত কার আগোচর।।
তার আগে কহি, নাহি জানে যেই জন।
নারী পূতনায় দুষ্ট করিল নিধন।।
কাষ্ঠের শকটখান দিল ফেলাইয়া।
পুরাতন দুই বৃক্ষ ফেলিল ভাঙ্গিয়া।।
বৃষ অশ্ব মারিয়া হইল অহঙ্কার।
ইন্দ্রজাল করি কংসে করিল সংহার।।
সপ্ত দিন গোবর্দ্ধন ধরিল বলয়।
এ সব তোমার চিত্তে মোর চিত্তে নয়।।
বল্মীকের ছত্র প্রায় লাগে মোর মনে।
বড় বলি কহে যত মূঢ় গোপগণে।।
সাধুজন সঙ্গে তোর নাহিক মিলন।
শুন আমি কহি যে কহিল সাধুজন।।
স্ত্রীলোক গো দ্বিজ আর অন্ন খাই যার।
এত জনে কদাচিৎ না করি প্রহার।।
স্ত্রীলোক পূতনা মারে, বৃষ মারে মাঠে।
কংসেরে মারিল যার অর্দ্ধ অন্ন পেটে।।
মাতুলহন্তা স্ত্রীঘাতী পাপী দুরাচার।
হেন জনে কর স্তুতি আরে কুলাঙ্গার।।
তোর কর্ম্মে পাণ্ডবের বড় হৈল তাপ।
ধর্ম্মচ্যুত হৈলি তুই দুষ্টমতি পাপ।।
আপনারে ধর্ম্মজ্ঞ বলিস্ লোকমাঝ।
ইহার যতেক কর্ম্ম শুন সর্ব্বরাজ।।
কাশীরাজ-কন্যা অম্বা শাল্বে বরেছিল।
এই দুষ্ট গিয়া তারে হরিয়া আনিল।।
বার্ত্তা জানি পুনঃ তারে করিল বর্জ্জন।
শাল্বরাজা শুনি তারে না কৈল গ্রহণ।।
তবে কন্যা প্রবেশিল অনল ভিতরে।
স্ত্রী বধিয়া মহাপাপী খ্যাত চরাচরে।।
আরে ভীষ্ম তোর ভাই স্বধর্ম্মেতে ছিল।
সুপথে বিচিত্রবীর্য্য জন্ম গোঁয়াইল।।
সে মরিল নিজ ভার্য্যা দিয়া অন্য জনে।
তুমি দুরাচর জন্মইলে পুত্রগণে।।
ব্রহ্মাচারী আপনারে বলাইস্ লোকে।
হেন ব্রহ্মচর্য্য করে বহু নপুংসকে।।
কোন রূপে তব শ্রেয় নাহি দেখি আমি।
দান যজ্ঞ ব্রহ ব্যর্থ কর অধোগামী।।
বেদপাঠ ধ্যান ব্রহ যোগযোগ দান।
ইহা সবে নাহি হয় অপত্য সমান।।
সর্ব্বদোষ কুলাঙ্গার আছে তোর স্থান।
অনপত্য বৃদ্ধ তোর কুপথ বিধান।।
পূর্ব্বে শুনিয়াছি আমি হংস-বিবরণ।
তাহার সদৃশ ভীষ্ম তোর আচরণ।।
হংস-যূথ মধ্যে এক বৃদ্ধ হংস থাকে।
ধর্ম্ম কর পুণ্য কর বলে সর্ব্বলোকে।।
অহর্নিশি হংসগণে ধর্ম্মকথা কয়।
ধার্ম্মিক জানিয়া সবে তার বাক্য লয়।।
হংসগণ যায় যদি আহার কারণে।
সবে কিছু কিছু আনে তাহার ভোজনে।।
আপন আপন ডিম্ব রাখিয়া তথায়।
বিশ্বাস করিয়া সবে চরিয়া বেড়ায়।।
ক্রমে ক্রমে ডিম্ব সব করিল ভক্ষণ।
দেখি শোকাকুল হৈল সব কংসগণ।।
এক হংস বুদ্ধিমন্ত তাহাতে আছিল।
বৃদ্ধ হংস ডিম্ব খায় প্রকারে জানিল।।
ক্রোধে সব হংস তারে করিল নিধন।
সেই হংস মত ভীষ্ম তব আচরণ।।
বৃদ্ধ হংসে হংস যথা করিল নিধন।
সেরূপে মারিবে তোরে যত রাজগণ।।
আরে ভীষ্ম জ্ঞানহারা হৈলি বৃদ্ধকালে।
যে গোপজাতির নিন্দা করয়ে সকলে।।
বৃদ্ধ হৈয়ে তারে তুই করিস্ স্তবন।
ধিক্ ক্ষত্র ভীষ্ম নাম ধর অকারণ।।
জরাসন্ধ রাজা চিল রাজচক্রবর্ত্তী।
কদাচিত না যুঝিল ইহার সংহতি।।
গোপজাতি বলি ঘৃণা কৈল নরবর।
তার ভয়ে রয়েছিল সমুদ্র-ভিতর।।
দেশের বাহিরে যেন শৃগাল-প্রকৃতি।
কপটে মারিল জরাসন্ধ নৃপবরে।
দ্বিজরূপে গেল দুষ্ট পুরীর ভিতরে।।
ইহার জাতির আমি না পাই নির্নয়।
কভু ক্ষত্র কভু গোপ কভু দ্বিজ হয়।।
কহ ভীষ্ম এই যদি দেব জগৎপতি।
তবে কেন ক্ষণে ক্ষণে হয় নানাজাতি।।
এই সে আশ্চর্য্য বোধ হইতেছে মনে।
ধর্ম্মহীন অসম্ভব কথা বল কেনে।।
দুর্দ্দেব হইবে, যার তুমি বুদ্ধিদাতা।
তব বুদ্ধি-দোষে রাজসূয় হৈল বৃথা।।
শিশুপাল ভীষ্মে কটু বলিল অপার।
শুনি ক্রোধে জ্বলিলেন পবন কুমার।।
দুই চক্ষু রক্তবর্ণ দন্ত কটমটি।
সর্ব্বাঙ্গ ঘামিল ক্রোধে ললাটে ভ্রুকুটি।।
রক্তমুখ বিকৃতি অধরে দন্তচাপে।
সিংহাসন হৈতে বীর উঠে এক লাফে।।
যুগান্তের যম যেন সংহারিতে সৃষ্টি।
শিশুপাল উপরে ধাইল ক্রোধদৃষ্টি।।
দুই হস্ত ধরে তার গঙ্গার নন্দন।
কার্ত্তিকে ধরিল যেন দেব ত্রিলোচন।।
বহু বহু মিষ্টভাষে ভীমে নিবারিল।
সমুদ্র-তরঙ্গ যেন কূলে লুকাইল।।
না পারিল ভীম, হস্ত করিতে মোচন।
জলে নিবারিল য্নে দীপ্ত হুতাশন।।
দুষ্ট শিশুপাল তবে অল্পজ্ঞান করি।
ক্ষুদ্র মৃগ দেখি যেন হাসয়ে কেশরী।।
ডাকি বলে, আরেরে রহিলি কি কারণ।
হস্ত ছাড় ভীষ্ম কেন কর নিবারণ।।
কৌতুক দেখুক যত নৃপতি সকলে।
পতঙ্গের মত যেন দহিব অনলে।।
ভীমে নিবারিয়া কহে গঙ্গার নন্দন।
এই শিশুপালের শুনহ বিবরণ।।