২৯. অষ্টমী ব্রত-কথন প্রস্তাবে অহল্যার শাপ-বিবরণ

আর এক কথা কহি অষ্টমী-আচার।
আপনি ভবানী সে অষ্টমী অবতার।।
অষ্টমীর ব্রতফল শুনহ রাজন।
মহাপুণ্য তিথি হয় শুনহ কারণ।।
গৌতমের স্থানে ইন্দ্র পড়েন আপনে।
নানাশাস্ত্রে শিক্ষা করে গৌতমের স্থানে।।
দশ বিদ্যা আছে আর যন্ত্র সারোদ্ধার।
সকলি পড়ায়মুনি সকল বিচার।।
পড়িয়া শুনিয়া ইন্দ্র মতিচ্ছন্ন হৈল।
গুরুপত্নী হরি বলি মনেতে করিল।।
আর দিন মুনি গেল তপস্যা করিতে।
দণ্ড কমণ্ডলু নিলা কোশাকুশী হাতে।।
তপস্যা করিতে ‍মুনি গেলা তপোবন।
দেখিয়া ত ইন্দ্র তবে ভাবে মনে মন।।
তদন্তরে দেবরাজ মুনিবেশ ধরি।
হস্তে কমণ্ডলু লৈয়া চলিলা সত্বরি।।
অহল্যা নিকটে ইন্দ্র আইলা তখনে।
অহল্যা বলেন, মুনি ফিরি আইলা কেনে।।
মায়া করি বলে ইন্দ্র অহল্যার তরে।
তপস্যা করিতে যাই কানন-ভিতরে।।
তথায় দেখিনু আমি মৃগীর সঙ্গম।
তাহাই দেখিয়া মোর স্থির নহে মন।।
এই সে কারণে আইনু শুন প্রাণপ্রিয়া।
প্রাণরক্ষা কর মোরে আলিঙ্গন দিয়া।।
পতিগতি অহল্যা ত সতী পতিব্রতা।
স্বামীর বচন কভু না হবে অন্যথা।।
শীঘ্র শয্যা করি তবে দিল আলিঙ্গন।
অহল্যা সহিত ইন্দ্র ভুঞ্জিল রমণ।।
নানামতে স্বামী প্রতি করিল সেবন।
সন্ধ্যার সময় মুনি আসে ততক্ষণ।।
ইন্দ্র জানিলেন তবে মুনি আগমন।
বুঝি ইন্দ্র পলায়ন করিল তখন।।
তারপর মুনি এল তপস্যা করিয়া।
মুনিকে দেখিয়া দেবী বিস্ময় হইয়া।।
ভূমিকম্প হৈল বুঝি না বুঝি কারণ।
এখনি আমার সঙ্গে ভুঞ্জিল রমণ।।
এখনি আইল পুনঃ দণ্ড হাতে করি।
বুঝিতে না পারি যত মুনির চাতুরী।।
বিস্ময় হইয়া দেবী ভাবে মনে মন।
অহল্যা দেখিয়া মুনি ভাবেন তখন।।
চুল কেন খসে তোর খসিল সিন্দূর।
লোচনে কাজল কেনে হৈল তোর দূর।।
মলিন বদন দেখি অলকা মলিন।
বদন উপরে কেনে দেখি অন্য চিন।।
বসন কোঁকড়া কেন পদ নহে স্থির।
নিদ্রাগত দেখি কেন তোমার শরীর।।
স্তনযুগ দেখি কেন রক্তের আকার।
নখের আচঁড় কেন হৃদয় মাঝার।।
নয়নযুগল তোর কেন বা বিভোর।
ঘন ঘন হাই উঠে উদর ডাগোর।।
আমাকে দেখিয়া কেন কাঁপ থর থর।
ঊরু দুই দেখি তোর রক্ত যেন ভর।।
উলট পালট কেশ দেখিয়া কেমন।
শীঘ্রগতি কহ কথা মোর বিদ্যামান।।
আরক্ত লোচন করি মুনি যদি চায়।
অহল্যার প্রাণ উড়ে যোড় হাতে কয়।।
নিবেদন করি কিছু তোমার চরণে।
আপনি যে কর্ম্ম কর পাসর আপনে।।
এখনি আপনি তুমি করিলে রমণ।
পুনরপি দোষ দেহ না বুঝি কারণ।।
তুমি বুঝি বসেছিলে সদাশিব পাছে।
সিদ্ধি ভাঙ্গ কিছু বুঝি পাও তাঁর কাছে।।
এত শুনি মুনিবর করিলেন ধ্যান।
ধ্যানেতে সকল তত্ত্ব হৈল বিদ্যামান।।
জানিল পাপিষ্ঠ ইন্দ্র করে হেন কর্ম্ম।
ইহা সম অধার্ম্মিক নাহিক অধম।।
গুরুপত্নী হরে বেটা বৈসে দেবপুরী।
যতেক পড়াই তারে এত যত্ন করি।।
তাহার দক্ষিণা দিল গুরুপত্নী হরি।
হেন কর্ম্ম কৈল হৈয়া স্বর্গ-অধিকারী।।
বেদাগম নানা শাস্ত্র পড়াইনু তারে।
উচিত দক্ষিণা বেটা দিলেক আমারে।।
যে কর্ম্ম করিল আজি, দিব তার ফল।
ভগময় হক বেটার শরীর সকল।।
নিরবধি সর্ব্বক্ষণ মলমূত্র ঝরে।
কন্দর্প-জর্জ্জর সদা হইবে শরীরে।।
দুঃখানলে দগ্ধ সদা হইবে অন্তর।
মহাদুঃখ পাবে ইন্দ্রদেব নিরন্তর।।
ইন্দ্রত্ব হইল দূর বসিতে না পারে।
নিরবধি কামজ্বর থাকয়ে অন্তরে।।
এইমতে ইন্দ্রে শাপ দিলা মহামুনি।
তবে শাপ দিলা তার আপন রমণী।।
অহল্যা বলেন প্রভু বুঝি দেহ শাপ।
মায়াছলে মোরে তব শিষ্য করে পাপ।।
বুঝিয়া শাপহ মোরে শুনহ গোঁসাই।
সহজে অবলা জাতি বল বুদ্ধি নাই।।
ইন্দ্রের কপটে আমি পড়িনু সঙ্কটে।
কতকালে মোরে প্রভু আনিবে নিকটে।।
শুনি মুনি অহল্যার কাতর বচন।
আশ্বাসিয়া মুনিবর বলে ততক্ষণ।।
যেকালে জন্মিবে রাম দশরথ-ঘরে।
বিশ্বামিত্র লৈয়া যাবে মিথিলা নগরে।।
শ্রীরাম-পরশে তোর হইবে মোচন।
তবে তুমি আসি পাবে মোর দরশন।।
এত বলি মুনিবর তারে শাপ দিল।
পাষাণ মূরতি ধরি অহল্যা রহিল।।
সেইমত রহে দেবী বনের ভিতরে।
গৌতম চলিয়া গেল অন্য বনান্তরে।।
প্রভাসের তীরে মুনি আশ্রম করিল।
সেইখানে মহামুনি তপেতে রহিল।।
সত্য গেল, ক্রেতাযুগে রাম অবতার।
দশরথ-ঘরে জন্মে সংসারের সার।।
বিশ্বামিত্র লয়ে যায় যজ্ঞ রাখিবারে।
অহল্যা পাষাণ সেই বনের ভিতরে।।
বিশ্বামিত্র বলে, রাম শুনহ বচন।
ইহাকে পরশ কর কমললোচন।।
মুক্তিপদ পাবে এই অহল্যা সুন্দরী।
পাষাণ হইতে শীঘ্র দেহ মুক্তি করি।।
রাম বলে, কোন্ হেতু হইল পাষাণ।
তবে মুনি কহিলেন পূর্ব্বের আখ্যান।।
শুনিয়া কহেন রাম, আমি নাহি পারি।
পরনারী পরশনে পাপ হবে ভারি।।
মুনি বলে, তুমি হও সবার জীবন।
তুমি না তারিলে তরাইবে কোন্ জন।।
তুমি যে জগৎকর্ত্তা চারিবেদ-সার।
রমণী পুরুষ সব রচন তোমার।।
তবে রাম পদাঙ্গুলে অহল্যা ছুঁইলা।
পাষাণ-মূরতি ছাড়ি পূর্ব্বদেহ হৈলা।।
তবেত পাইল দেহ মুক্তিপদ পেয়ে।
রামের চরণে পড়ে দণ্ডবৎ হয়ে।।
সংসারের সার তুমি দেব নারায়ণ।
আদি ও অনাদি তুমি সবার জীবন।।
তুমি ত্রিদশের নাথ তোমা বিনা নাই।
সর্ব্বদেবগণে প্রভু তোমারে ধেয়ায়।।
কৃপা করি মুক্ত মোরে করিলে এখন।
তোমার পরশে ধরি মানবী জীবন।।
তোমার পদের আমি কি জানি মহিমা।
চারি মুখে ব্রহ্মা যার দিতে নারে সীমা।।
এমতে অহল্যা বহু করিল স্তবন।
রামেরে প্রণাম করি করিল গমন।।
প্রভাসের তীরেতে আছেন মুনিবর।
সেইস্থানে গেলা দেবী স্বামীর গোচর।।
মুনি দেখি অহল্যার সিদ্ধ হৈল কাম।
মুনির চরণে দেবী করিল প্রণাম।।
দেখিয়া সন্তোষ বড় হৈলা মুনিবর।
অহল্যারে বসাইলা ঊরুর উপর।।
গায়ে হস্ত দিয়া মুনি করিল সান্ত্বনা।
এতকাল দুঃখ দিল অসৎ-বাসনা।।
এইমতে দুইজন হৈল একত্তর।
প্রভাসের তীরে রহে সানন্দ অন্তর।।
কহিনু অহল্যা, হৈল পাপেতে মোচন।
মহাপাপ মুক্ত হবে যে করে শ্রবণ।।
নারীতে শুনিলে সেই পুত্রবতী হয়।
পাপীতে শুনিলে তার পাপ হয় ক্ষয়।।
এইত কহিনু অহল্যার উপাখ্যান।
তার পর শুন রাজা ইন্দ্রের মোচন।।