২৮. শিশুপালের কৃষ্ণনিন্দা

মুনি বলে, শুন পরীক্ষিতের নন্দন।
সুধারস রাজসূয়-যজ্ঞের কথন।।
যুধিষ্ঠির সমাপন করিলেন যাগ।
তুষ্ট করিলেন দিয়া যার যেই ভাগ।।
সাক্ষাতে লইল পূজা দেব পিতৃ ভূপে।
ব্রাহ্মণে দক্ষিণা দিতে কহিলেন কৃপে।।
ব্রাহ্মণেরে দিতে কৃপাচার্য্য কৃপাবান।
যতেক দক্ষিণা দিল নাহি পরিমাণ।।
যে রাজ্যে হইতে আসে যত দ্বিজগণ।
সে রাজ্যের রাজা এনেছিল যত ধন।।
তাহার দ্বিগুণ করি দক্ষিণা যে দিল।
আনন্দেতে দ্বিজগণ দেশেতে চলিল।।
এক দ্বিজ করি দক্ষিণা যে দিল।
আনন্দেতে দ্বিজগণ দেশেতে চলিল।।
এক দ্বিজ দুই চারি লইয়া রাখাল।
দেশেতে চালায়ে দিল গবী বৎসপাল।।
কেহ অশ্ব গজপৃষ্ঠে কেহ চড়ি রথে।
রত্নের শকট চালাইয়া দিল সাথে।।
দক্ষিণা পাইয়া দেশে গেল দ্বিজগণ।
ধর্ম্মপুত্রে চাহি ভীষ্ম বলেন বচন।।
বহুদূর হইতে আইল রাজগণে।
বৎসর হইল পূর্ণ তোমার ভবনে।।
সবাকারে পূজা কর বিবিধ বিধানে।
যজ্ঞ পূর্ণ হৈল সবে যাউক ভবনে।।
যথাযোগ্য জানি রাজা পূজ ক্রমে ক্রমে।
শ্রেষ্ঠ জন জানি আগে পূজহ প্রথমে।।
এত শুনি যুধিষ্ঠির ভীষ্মের বচন।
ভাল বলি সহদেবে করেন স্মরণ।।
আজ্ঞামাত্র সহদেব তখনি আইল।
অর্ঘ্যপাত্র করে লৈয়ে সম্মুখে দাঁড়াল।।
যুধিষ্ঠির জিজ্ঞাসেন কহ পিতামহ।
কাহাকে পূজিব আগে শ্রেষ্ঠ কেবা কহ।।
ভীষ্ম বলে বৃষ্ণিবংশে বিষ্ণু-অবতার।
উদ্দেশে মহেন্দ্র-আদি পূজা করে যাঁর।।
সর্ব্বাগ্রেতে অর্ঘ্য দেহ চরণে তাঁহার।
তারাগণ মধ্যে যেন চন্দ্রের আকার।।
ভকতবৎসল তিনি কৃপা-অবতার।
তাঁর অগ্রে অর্ঘ্য পায় হেন নাহি আর।।
তবে অর্ঘ্য দেহ বীর রাজগণ শিরে।
এত শুনি আনন্দিত সহদেব বীরে।।
অর্ঘ্য দিয়া গোবিন্দ-চরণ পূজা করে।
হৃষ্টচিত্ত হৈয়ে কৃষ্ণ লইলেন করে।।
কৃষ্ণে পূজি আনন্দিত পাণ্ডুপুত্রগণ।
সহিতে নারিল দমঘোষের নন্দন।।
জ্বলন্ত অনলে যেন ঘৃত দিল ঢালি।
ভীষ্ম আদি সবাকারে ক্রোধে পাড়ে গালি।।
রাজসূয়-যজ্ঞ পূর্ণ কৈল কুরুবর।
দেখিয়া কৃষ্ণের পূজা চেদির ঈশ্বর।।
ক্রোধেতে অবশ অঙ্গ বলে বার বার।
ওহে ভীষ্ম এ তোমার কিমত বিচার।।
সভাতে আছেন রাজা রাজার কুমার।
পৃথিবীর যত রাজা দ্বারেতে তোমার।।
এ সব থাকিতে পূজ্য বৃষ্ণি-কৃলোদ্ভব।
সহজে বালক বুদ্ধি কি জানে পাণ্ডব।।
রাজসূয়-যজ্ঞ আগে পূজিবেক রাজা।
কোন্ রাজপুত্র কৃষ্ণ তারে কৈলা পূজা।।
কোন্ রূপে পূজাযোগ্য হয় দামোদর।
কহ শুনি ওহে ভীষ্ম সভার ভিতর।।
বড় দেখি পূজা যদি চাহ করিবারে।
দ্রুপদেরে ছাড়ি কেন পূজহ ইহারে।।
বিশেষ আছেন বসুদেব মহামতি।
পিতা স্থিতে পুত্রে পূজা কহ কোন্ রীতি।।
যদি বা পূজিবে ইথে আচার্য্যের ক্রমে।
দ্রোণে ত্যজি কৃষ্ণে কেন পূজিলে প্রথমে।।
ঋষিশ্রেষ্ঠ পূজিতে চাহ যদি রাজন।
গোপালে পূজহ কেন ত্যজি দ্বৈপায়ন।।
রাজক্রমে পূজিবারে চাহ নরবর।
দুর্য্যোধনে ত্যজি কেন পূজ নারায়ণ।।
প্রিয়শিষ্য শ্রীরামের কর্ণ মহাবীর।
ভুজবলে শাসিল নৃপতি পৃথিবীর।।
অশ্বত্থামা কৃপ শল্য ভীষ্মক নৃপতি।
আমা আদি করি রাজা আছে মহামতি।।
গণিলে কাহার মধ্যে এই গোপালেরে।
কি বুঝিয়া অর্ঘ্য দিলে সভার ভিতরে।।
প্রিয়বন্ধু বলি যদি কৃষ্ণে কৈলে পূজা।
তবে কেন নিমন্ত্রি আনিলে সর্ব্ব রাজা।।
ক্ষত্রিয় মধ্যেতে এই পৃথিবী ভিতরে।
এমন অমান্য কেহ কভু নাহি করে।।
অর্থ-গর্ব্বে ভুজ-গর্ব্বে কৈলে হেন বাসি।
ভয়ে কিম্বা লোভে মোরা কেহ নাহি আসি।।
ধর্ম্মবাঞ্ছা করিয়াছে ধর্ম্মের নন্দন।
ধর্ম্মকার্য্য হেতু মো সবার আগমন।।
নিমন্ত্রিয়া আনি শেষে কর অপমান।
এই হৈতে ধর্ম্ম তব হৈল সমাধান।।
হে গোপাল তব মুখে নাহি দেখি লাজ।
কেমনে লইলে অর্ঘ্য এ সবার মাঝ।।
এ সভায় তব পূজা হৈল বড় শোভা।
নপুংসক জনের হইল যেন বিভা।।
অন্ধ-স্থানে অন্ধ যেন জিজ্ঞাসয়ে পথ।
সভামাঝে তব পূজা হৈল সেই মত।।
দুষ্ট ভীষ্ম, দুষ্ট কৃষ্ণ, দুষ্ট এ রাজন।
দুষ্টের সভায় নাহি রহি কদাচন।।
যেই ছার সভায় সুজনে অপমান।
ক্ষণমাত্র তথায় না রহে জ্ঞানবান।।
এত বলি উঠিয়া চলিল শিশুপাল।
সঙ্গেতে চলিল দুষ্ট কতেক ভূপাল।।
মহাভারতের কথা অমৃত-সমান।
কাশীরাম দাস কহে, শুনে পুণ্যবান।।