২৮. অনন্ত ব্রতের মাহাত্ম্য

ভীষ্ম বলিলেন শুন রাজা যুধিষ্ঠির।
শোক দূর কর রাজা চিত্ত কর স্থির।।
আর কিছু ইতিহাস শুন দিয়া মন।
অনন্ত নামেতে ব্রত অপূর্ব্ব কথন।।
নারদের মুখে পূর্ব্বে করিণু শ্রবণ।
সেই ইতিহাস কহি শুন দিয়া মন।।
চিত্রাঙ্গদ নামে ‍রাজা কৌশলেতে স্থিতি।
সোমবংশ চূড়ামণি মহাধর্ম্মে মতি।।
শীলতায় চন্দ্র যেন তেজে বৈশ্রবণ।
কীর্ত্তি ভাগীরথ সম মহাবিচক্ষণ।।
মন্ত্রণাতে বৃহস্পতি গুণে গুণধাম।
প্রজার পালনে যেন ছিলেন শ্রীরাম।।
অনন্ত নামেতে ব্রত গোবিন্দ উদ্দেশে।
ভার্য্যা সহ নরবর আচরে বিশেষে।।
বিচিত্র মন্দির এক করিয়া রচন।
লিঙ্গরূপে তাহাতে স্থাপিয়া নারায়ণ।।
রাজধর্ম্ম নিত্যকর্ম্ম ত্যজিয়া রাজন।
আপনি হস্তেতে করে মন্দির মার্জ্জন।।
অনন্তরে স্নানদান করি নরবর।
নানা উপহারে পূজে দেব দামোদর।।
পূজা শেষে করাইল ব্রাহ্মণ ভোজন।
অবশেষে লইয়া কুটুম্ব পরিজন।।
আনন্দিত হয়ে সবে করয়ে ভোজন।
এইরূপে নিত্য নিত্য পূজে নারায়ণ।।
বাদ্য বাজাইয়া এই জানায় নগরে।
অনন্ত নামেতে ব্রত বিখ্যাত সংসারে।।
দ্বিজ ক্ষন্ত্র বৈশ্য শূদ্র চতুর্ব্বিধ জন।
এই ব্রত যেবা না করিবে আচরণ।।
সবংশে লইব তারে শমনের ঘরে।
নগরে বাজারে এইরূপ বাদ্য করে।।
রাজভয়ে সর্ব্বলোক প্রাণপণ করে।
নিয়ম করিয়া শুভ ব্রত যে আচরে।।
ব্রত পুণ্যফলে সবে নিষ্পাপ হইল।
যতদূর ভুপতির অধিকার ছিল।।
যত লোক ছিল ভূপতির অধিকারে।
ব্রতপুণ্যফলে যার বৈকুণ্ঠ নগরে।।
সত্যকালে যেন লোক পুণ্যবান ছিল।
রাজার প্রতাপে তেন দ্বাপর হইল।।

জানিয়া দ্বাপরযুগ এ সব কারণ।
চিন্তাকুল হইয়া ভাবিল মনে মন।।
পূর্ব্বে প্রজাপতি হেন করিল বিচার।
সংসার উপরে দিল মম অধিকার।।
কোটি লোক মধ্যে কেহ মম অধিকারে।
নিয়ম করিয়া ভজিবেক দামোদরে।।
সহস্রেক মধ্যে কেহ হবে মহাজন।
মহাব্রত আচরি ভজিবে নারায়ণ।।
যতেক সংসারে প্রজা হবে পাপাচারী।
অল্প আয়ু হয়ে যাবে যমের নগরী।।
এইরূপ নিয়ম করিয়া সৃষ্টিধর।
অধিকার দিল মোরে সংসার উপর।।
মহাধর্ম্মশীল দেখি এই নৃপমণি।
ব্রহ্মার নিয়ম ভঙ্গ করে হেন জানি।।
কোনমতে ব্রত ভঙ্গ হইলে রাজার।
তবে সে নিয়ম রক্ষা হয়ত ব্রহ্মার।।

এইরূপে দ্বাপর ভাবিয়া মনে মন।
বিশ্বকর্ম্মা শিল্পিবরে করিল স্মরণ।।
সেইখানে বিশ্বকর্ম্মা আইল তখন।
করযোড়ে দ্বাপরে করিল নিবেদন।।
কি হেতু আমারে দেব ডাকিলে আপনে।
কোন কর্ম্ম সাধি দিব কহ নিজগুণে।।
দ্বাপর বলিল মোর কর এই কার্য্য।
অনুগ্রহ করি এক করহ সাহায্য।।
দিব্য এক কন্যা দেহ করিয়া গঠন।
পৃথিবীর মধ্যে যেন হয় সুলক্ষণ।।
তার রূপে গুণে যেন মোহে সর্ব্বজন।
এত শুনি বিশ্বকর্ম্মা করিল রচন।।
পৃথিবীর যত রূপ করিয়া মোহন।
মোহিত নামেতে কন্যা করিল সৃজন।।
দ্বাপরেরে কন্যা দিয়া হৈল অন্তর্দ্ধান।
দেখিয়া দ্বাপর হৈল অতি হর্ষবান।।
দ্বাপরের অগ্রে কন্যা কর যুড়ি কয়।
কি কর্ম্ম করিব আজ্ঞা কর মহাশয়।।

শুনিয়া দ্বাপর হৈল আনন্দিত মন।
কহে মর্ত্ত্যলোকে তুমি করহ গমন।।
চিত্রাঙ্গদ নামে রাজা বিখ্যাত ভুবনে।
আমার আজ্ঞায় তারে ভজিবে আপনে।।
দিব্য পর্ব্বতেতে দ্রুত করহ গমন।
এই সে নিয়ম চিত্তে রাখিবে স্মরণ।।
অনন্ত নামেতে ব্রত আচরে যে জন।
প্রকারেতে ব্রত তার করিবে ভঞ্জন।।
বিধির নির্ব্বন্ধ কভু না যায় খণ্ডন।
আজ্ঞামাত্রে মোহিনী চলিল সেইক্ষণ।।

মৃগয়া কারণ রাজা গেল সেই গিরি।
দেখিল অনূঢ়া কন্যা পর্ব্বত উপরি।।
রাজা করে একদৃষ্টে কন্যা নিরীক্ষণ।
ভুবনমোহন রূপ না যায় বর্ণন।।
মুখরুচি কত শশী করয়ে গঞ্জন।
কামধনু জিনি ভুরু অলক অঞ্জন।।
তিলফুল জিনি নাসা ভূজ করিকর।
সুতপ্ত কাঞ্চন জিনি গৌর কলেবর।।
কুচযুগ সম পূগ গঞ্জি রসায়ন।
কণ্ঠকম্বু জিনি শম্ভু অতি সুলক্ষণ।।
রক্তবস্ত্র পরিধানা অরুণ উদিত।
দেখি স্মরশরে রাজা হইল মোহিত।।
ক্ষণেকে চৈতন্য তবে পাইয়া নৃপতি।
নিকটেতে গিয়া জিজ্ঞাসিল কন্যা প্রতি।।
কি নাম ধরহ তুমি কোথায় বসতি।
সত্য করি কহ মোরে না ভাণ্ডহ সতী।।
নিজ পরিচয় মম গুন গুণবতী।
সোমবংশে জন্ম চিত্রাঙ্গদ নরপতি।।
তোমারে দেখিয়া মন মজিল আমার।
মম ভার্য্যা হও তুমি কর অঙ্গীকার।।

কন্যা বলে হই আমি অযোনি উৎপত্তি।
এইত পর্ব্বত মধ্যে আমার বসতি।।
অনূঢ়া যে আছি আমি বিবাহ না হয়।
মোহিনী আমার নাম বিধির নির্ণয়।।
এক সত্য কর রাজা আমার গোচরে।
তবে আমি পরিণয় করিব তোমারে।।
ইচ্ছামত তোমারে কহিব যেই কথা।
আমার সে কথা কভু না হবে অন্যথা।।
যদি বা দুষ্কর হয়ে এ তিন ভুবনে।
মম বাক্য কভু নাহি করিবা খণ্ডনে।।

রাজা বলে আমি সত্য করি অঙ্গীকার।
কভু না খণ্ডিব কন্যা বচন তোমার।।
এত শুনি কন্যা করিলেন অনুমতি।
পুরোহিত বিপ্রেরে স্মরিল নরপতি।।
কঙ্কায়ন নামে মুনি বিখ্যাত জগতে।
পূর্ব্বাপর পুরোহিত সোমক বংশেতে।।
রাজার স্মরণে দ্বিজ আইল তখন।
প্রণমিয়া নৃপতি কহিল বিবরণ।।
পুরোহিত উভয়ে বিবাহ করাইল।
সেই রাত্রি নরপতি তথা নির্ব্বাহিল।।
মোহিনীরে কৈল রাজা মুখ্য পাটেশ্বরী।
ইন্দ্রের শোভয়ে যেন পুলোমা কুমারী।।

এইরূপে কতদিন রাজা বিহরয়।
অনন্ত ব্রতের আসি হইল সময়।।
চিত্ররেখা সহ রাজা ব্রত আচরিল।
উপবাস করি ব্রত নিয়মে রহিল।।
ভূমিদান গোদান করিল দ্বিজগণে।
অন্নদান তুষিল যতেক দুঃখীজনে।।
দৈবের লিখন কভু না হয় খণ্ডন।
যুগবাক্য মোহিনীর হইল স্মরণ।।
নৃপতিরে চাহি কন্যা বলয়ে বচন।
উপবাসে কি কারণে আছহ রাজন।।
এতেক দুষ্কর ব্রতে কোন প্রয়োজন।
আমার বচনে রাজা করহ ভোজন।।
আমার বচন রাজা কহ সবাকারে।
হেন পাপ ব্রত যেন কেহ না আচরে।।

কন্যার বচন রাজা শুনি বজ্রাঘাত।
ক্রোধানলে নয়নে হইল অশ্রুপাত।।
ক্ষণে ক্রোধ সন্বরিয়া বলয়ে বচন।
অবলা স্ত্রীজাতি তুমি না বুঝ কারণ।।
এই ত অনন্ত ব্রত বিখ্যাত সংসারে।
হেন ব্রত বল মোরে ভঙ্গ করিবারে।।
অবলা স্ত্রীজাতি কিবা বলিব তোমারে।
এই ব্রত আচরিলে সর্ব্ব দুঃখে তরে।।
স্বর্গভোগ মহাফল অবহেলে পায়।
কদাচিত যমের নগর নাহি যায়।।
পূর্ব্ব কথা মম এই করহ শ্রবণ।
যেই হেতু এই ব্রত করি আচরণ।।

সত্যযুগে ছিনু আমি শ্বপচের বংশে।
সুষেণ আছিল নাম শূদ্র অবতংসে।।
বেশ্যাতে ছিলাম মত্ত মদ্যপানে রত।
পশু পক্ষী মৃগ বধ কৈনু শত শত।।
মম দুষ্টাচার দেখি ভ্রাতৃ বন্ধুগণ।
দূর করি দিল মোরে করিয়া তাড়ন।।
ক্রোধচিত্তে ঘোর বনে করিয়া প্রবেশ।
ক্ষুধায় তৃষ্ণায় হয়ে আকুল বিশেষ।।
ভ্রমিতে ভ্রমিতে পাই কেশব মন্দির।
তাহাতে আশ্রয় করি হইয়া অস্থির।।
অনন্ত ব্রতের সেই দিন শুভক্ষণ।
উপবাসী রহিলাম করিয়া শয়ন।।
দৈবযোগে নিশাশেষে সর্প ভয়ঙ্কর।
চরণে আমার আসি দংশিল সত্বর।।
বিষের জ্বলনে মৃত্যু হইল আমার।
দুই যমদূত আসিল বিকৃতি আকার।।
মহাপাশে শীঘ্র মোরে করিল বন্ধন।
হেনকালে এল বিষ্ণুদূত দুইজন।।
যমদূতে অনেক করিল তিরস্কার।
শীঘ্রগতি মুক্তি তারা করিল আমার।।
রথে করিল নিল মোরে বৈকুণ্ঠ ভুবন।
অপমান পেয়ে গেল যমদূতগণ।।
দুই লক্ষ বর্ষ বিষ্ণু লোকে হৈল স্থিতি।
অনন্তর ব্রহ্মলোকে করিনু বসতি।।
কত দিন ব্রহ্মলোকে সুখেতে বঞ্চিনু।
তারপরে পুনরপি মর্ত্ত্যলোকে এনু।।
দুই মন্বন্তর তথা করিনু বিহার।
সেই পুণ্যে রাজবংশে জনম আমার।।
হেন ব্রত করিবারে নিষেধ করহ।
এমত কুৎসিত বাক্য কভু না বলহ।।

কন্যা বলে রাজা তুমি করিলা স্বীকার।
না খণ্ডিবে কোন কালে বচন আমার।।
এবে তুমি মিথ্যাবাদী জানিনু কারণ।
মিথ্যা সম পাপ নাহি বেদের বচন।।
আপনার সত্য রাজা করহ পালন।
মম বাক্য এই ব্রত করহ ভঞ্জন।।

এতেক শুনিয়া রাজা হৈল ভীত মন।
কন্যারে চাহিয়া রাজা বলিল বচন।।
যে বলিলে কন্যা সত্য কভু নহে আন।
ত্যজিবারে পারি আমি আপনার প্রাণ।।
তথাপি এ ব্রত আমি না পারি ত্যজিতে।
সে কারণে কহি আমি তোমার সাক্ষাতে।।
এইক্ষণে নিজ আত্মা করিব নিধন।
এত বলি জৈষ্ঠপুত্রে আনি সেইক্ষণ।।
ছত্রদণ্ড দিয়া তারে বলিল বচন।
প্রাণত্যাগ করি আমি সত্যের কারণ।
রাজ্যখণ্ড যত দেখ সকলি তোমার।
দেব দ্বিজে ভক্তি পূজা করিবে সবার।

যোগাসন করি তবে বসিল রাজন।
দেহ ছাড়ি বৈকুণ্ঠেতে করিল গমন।।
রাজার মরণে সবে করয়ে ক্রন্দন।
অনেক কান্দিল পুরে পাত্র মন্ত্রীগণ।।
রাজার শরীর লয়ে করিল দাহন।
নৃপতি বিচ্ছেদে সবে নিরানন্দ মন।।
শ্রাদ্ধশান্তি করিলেন শাস্ত্রের বিধানে।
ভূমিদান গোদান করিল দ্বিজেগণে।।
ইহা দেখি কন্যা তবে স্বস্থানে চলিল।
বাদ্য বাজাইয়া সবে নগরে বলিল।।
স্ত্রীর সহ সত্য না করিবে কদাচন।
স্ত্রীর বাক্য কদাচ না করিবে গ্রহণ।।
মহাভারতের কথা অমৃত সমান।
কাশীরাম দাস কহে শুনে পুণ্যবান।।