২৭. শিব চতুর্দ্দশীর মাহাত্ম্য

যুধিষ্ঠির বলিলেন কর অবধান।
ব্রতের মাহাত্মা কিছু করহ বাখান।।

ভীষ্ম বলিলেন তাহা কহিতে কে পারে।
সংক্ষেপেতে কিছু রাজা কহিব তোমারে।।
ইক্ষ্বাকু বংশেতে রাজা চিত্রভানু নাম।
সর্ব্বশাস্ত্রে বিচক্ষণ রণে অনুপাম।।
জম্বুদ্বীপে একচ্ছত্র হৈল নরপতি।
কুবের সদৃশ তার ঐশ্বর্য্য বিভূতি।।
শীলতায় চন্দ্র যেন তেজে দিনকর।
প্রজার পালনে যেন রাম রঘুবর।।
দ্বিজসেবা বিনা রাজা অন্য নাহি জানে।
যেই যাহা মাগে দেয় তোষয়ে ব্রাহ্মণে।।
শিবব্রতে রত সদা শিবপরায়ণ।
শিবচতুর্দ্দশী ব্রত করে আচরণ।।
ভার্য্যার সহিত রাজা উপবাস করি।
দান ধ্যান করি বসিয়াছে অন্তঃপুরী।।
হেনকালে অষ্টাবক্র সঙ্গে শিষ্যগণ।
সত্বরে চলিয়া গেল রাজার সদন।।
দেখি আস্তে ব্যাস্তেতে উঠিয়া নরপতি।
দণ্ডবৎ প্রণাম করিল শীঘ্রগতি।।
বসিবারে আনি দিল দিব্য কুশাসন।
একে একে বসিল সকল মুনিগণ।।
সূপকারগণে আজ্ঞা দিল নরবর।
দিব্য উপহার দ্রব্য আসিল বিস্তর।।
যথাযোগ্য সবাকারে করায় ভোজন।
ভোজনান্তে দ্বিজগণ কৈল আচমন।।
তাম্বূল কর্পূর আদি করিল ভক্ষণ।
নৃপে চাহি অষ্টাবক্র চলিল বচন।।
ভ্রাতৃ মিত্র আদি সবে করিল ভোজন।
ভার্য্যা সহ উপবাস কর কি কারণ।।
দ্বিতীয় প্রহর বেলা সুদৃশ্য ভাস্কর।
কোন হেতু উপবাসে আছ নরবর।।
কিবা চিত্তে দুঃখ তব না জানি কারণ।
আত্মাকে দিতেছ দুঃখ কোন্ প্রয়োজন।।
এক আত্মা জগতের হন নারায়ণ।
আত্মা তুষ্ট হৈলে তুষ্ট ব্রহ্ম সনাতন।।
ষটচক্র কথা রাজা শুন দিয়া মন।
সর্ব্বভূতে আত্মারূপে স্থিত নারায়ণ।।
চতুর্থ অদ্ভূত দল প্রথমে গণিবে।
দ্বিতীয়েতে অষ্টদল উপরে বর্ণিবে।।
তৃতীয়েতে শতদল তাহার উপরে।
সূক্ষারূপে বৈসে জীব তাহার ভিতরে।।
মাঝেতে কেশর চতুর্দ্দিকে কর্ণিকার।
জীব আত্মা স্থিত তথা পদ্মের আকার।।
তদন্তে অদ্ভূত চক্র চতুর্থ উপর।
অষ্টোত্তর শতদল তাহার ভিতর।।
পঞ্চশত দল জীব মধ্যে কর্ণিকার।
কহিব তাহার কথা করিয়া বিস্তার।।
তদন্তেরে শতচক্র দলের নির্ম্মাণ।
দেব মুনিগণ করে যাহার বাখান।।
চতুর্দ্দিকে সূক্ষরূপে দলের গাঁথনি।
স্বহস্তে বিধাতা তাহা নির্ম্মাণ আপনি।।
চতুর্দ্দিকে কর্ণিকার মধ্যেতে কেশর।
সূক্ষারূপে তাহে উপবিষ্ট দামোদর।।
তার তিন ভাগ মধ্যে বৈসে নারায়ণ।
সুসিদ্ধ সজ্ঞান ভক্তি লভে যেই জন।।
শরীরেতে আত্মারূপে বৈসে নারায়ণ।
তপ ব্রত ফলে তার কোন্ প্রয়োজন।।

রাজা বলে মুনিবর কহিলে প্রমাণ।
মম পূর্ব্বজন্ম কথা কর অবধান।।
চতুর্দ্দশী মহাব্রত বিখ্যাত সংসারে।
ইহার পুণ্যের কথা কে কহিতে পারে।।
অজ্ঞানে সজ্ঞানে নর উপবাস করি।
সমাহিত হয়ে পূজা কর ত্রিপুরারী।।
বিশ্বপত্র ধুস্তুর কুসুম রাশি রাশি।
রক্তচন্দনাদি নানা গন্ধে বস্ত্র ভূষি।।
পূজা ভক্তি করি স্তব করে পঞ্চাননে।
তাহার পূণ্যের কথা কি কব বদনে।।
পৃথিবীর রেণু যেবা গণিবারে পারে।
সরোবর জল যদি কলসীতে ভরে।।
বৃষ্টিবিন্দু জল যদি পারয়ে গণিতে।
তথাপি তাহার পুণ্য না পারি বলিতে।।
পূর্ব্বে ব্যাধকুলে জন্ম আছিল আমার।
সুস্বর আছিল নাম মহা দুরাচার।।
পরদ্রব্য পরবৃত্তি করি অপহার।
অধর্ম্মেতে রত ছিনু বিখ্যাত সংসার।।
মৃগ ব্যাঘ্র আদি পশু নানা পক্ষীগণ।
যতেক করিনু বধ না যায় লিখন।।
সেইরূপে নির্ব্বাহিনু কতেক দিবস।
একদিন অরণ্যে গেলাম দৈববশ।।
কুজ্বাটিতে অন্ধকার দেখিতে না পাই।
একেশ্বর ঘোর বনে ভ্রমিয়া বেড়াই।।
ভ্রমিতে ভ্রমিতে হৈল দিবা অবসান।
আসিতে না পারি গৃহে হইনু অজ্ঞান।।
ঘোর অন্ধকার নিশি চতুর্দ্দশী দিনে।
ক্ষুধা তৃষ্ণাযুক্ত আমি ভ্রমি একা বনে।।
ভ্রমিতে ভ্রমিতে তথা হৈল ঘোর নিশি।
বিল্ববৃক্ষে আরোহিনু মনে ভয় বাসি।।
নিত্য নিত্য মৃগয়া করিয়া যাই ঘরে।
নগরে বেচিয়া আনি দিই পরিবারে।।
তবেত ভক্ষণ করে ভার্য্যা পুত্রগণ।
উপবাসী রহি আজি দৈবের কারণ।।
মম মুখ চাহি আছে ভার্য্যা পুতগণ।
ধনহীন নরজন্ম হয় অকারণ।।
ভ্রাতৃ বন্ধু অনেক আছয়ে জ্ঞাতিগণ।
সবে ধনবান আমি দরিদ্র দুর্জ্জন।।
উপবাসী গৃহে আছে ভার্য্যা পুত্রগণ।
কেহ না চাহিবে ধনহীনের কারণ।।
এইরূপে হৃদয়েতে করিয়া চিন্তন।
আকুল হইয়া বহু করিনু ক্রন্দন।।
অশ্রুজল পড়ি মম ভাসে কলেবর।
পব্বপত্র ছিল এক বৃক্ষের উপর।।
পত্র পড়ে মম অশ্রুজলের সহিত।
আচম্বিতে একপত্র পড়িল ত্বরিত।।
তাহাতে সন্তুষ্ট হন দেব পঞ্চান।
নিরাহারে সেই রাত্রি করিনু বঞ্চন।।
প্রাতঃকালে মৃগ মারি লইয়া ত্বরিত।
নিজ গৃহে গিয়া আমি হৈনু উপনীত।।
আমার বিহনে সবে দুঃখিত আছিল।
মোরে দেখি সবে ক্ষুধা তৃষ্ণা পাসরিল।।
নগরেতে মৃগমাংস শীঘ্রগতি লৈয়া।
বেচিয়া ভক্ষণ দ্রব্য আনিনু কিনিয়া।।
শীঘ্রগতি ভার্য্যা গিয়া করিল রন্ধন।
হেনকালে অতিথি আইল এক জন।।
সেই অতিথিরে আমি করাই ভোজন।
পারণের মহাফল পাই সে কারণ।।

এইরূপে কত দিন দুঃখে মোর গেল।
আয়ুঃশেষে মৃত্যু আসি উপনীত হৈল।।
মহাভয়ঙ্কর দুই যমের কিঙ্কর।
আসি মহাপাশে মোরে বান্ধিল সত্বর।।
যমের এ সব কর্ম্ম জানি পঞ্চানন।
দ্রুতগতি পাঠাইল দূত দুইজন।।
শিবের অকৃতি দোঁহে পরম সুন্দর।
অকপটে মোর পাশ খুলিল সত্বর।।
দেখিয়া বিস্মিত যমদূত দুইজন।
জিজ্ঞাসিল কে তোমরা কহ বিবরণ।।
এতেক শুনিয়া তারা করিল উত্তর।
শিবের নিকটে থাকি শিবের কিঙ্কর।।
শিবের আজ্ঞায় পাশ করিনু মোচন।
কহ শুনি কে তোমরা হও দুই জন।।
বিকৃত আকার মূর্ত্তি লোহিত নয়ন।
কোথায় নিবাস কর কাহার নন্দন।।
কি হেতু এ ব্যাধপুত্রে করিলে বন্ধন।
এত শুনি যমদূত বলয়ে বচন।।
মোরা দুই জন ধর্ম্মরাজ অনুচর।
তাঁর আজ্ঞা বহি ফিরি যত চরাচর।।
যক্ষ রক্ষ গন্ধর্ব্ব চারণ নরগণ।
সংসারের মধ্যেতে মরয়ে যত জন।।
তাহারে লইয়া যায় যমের সদন।
পাপ পুণ্য বুঝি দণ্ড করেন শমন।।
এই ব্যাধ মহাপাপী অধম দুর্জ্জন।
ইহার পাপের কথা না যায় কথন।।
যমপুরে গেলে পাপ হইবে খণ্ডন।
কি কারণে এই দুষ্টে করিলে মোচন।।

এত শুনি পুনঃ কহে শিবের কিঙ্কর।
তোমার ঈশ্বরে গিয়া কহরে বর্ব্বর।।
শিবের অনুজ্ঞা মোরা লঙ্ঘিতে না পারি।
এই ব্যাধপুত্রে লয়ে যবে শিবপুরী।।
সর্ব্বপাপে এই ব্যাধ হইবে মোচন।
শিব চতুর্দ্দশী ব্রত কৈল আচরণ।।
তোর কিছু অধিকার নাহিক ইহাতে।
এত বলি মোরে নিল শিবের সভাতে।।
তিন লক্ষ বর্ষমম তথা হৈল স্থিতি।
দেবতুল্য নানা ভোগ ভুঞ্জি নিতি নিতি।।
অনন্তর ইন্দ্রলোকে হইল গমন।
তিন কল্প কথা সুখে করিনু বঞ্চন।।
অনন্তর হৈল মোর ব্রহ্মলোকে স্থিতি।
চৌদ্দ মন্বন্তর তথা হইল বসতি।।
অনন্তর বৈকুণ্ঠেতে করিণু প্রয়াণ।
লক্ষী সহ বিরাজিত যথা ভগবান।।
তিনকোটি বর্ষ তথা সুখেতে বঞ্চিনু।
তারপর এই রাজবংশেতে জন্মিনু।।
অজ্ঞানেতে শিবচতুর্দ্দশী মহাব্রত।
আচরিনু হীনজাতি হয়ে ব্যাধসুত।।
সেই পুণ্যে হেন গতি হইল আমার।
ইক্ষ্বাকুবংশেতে জন্ম বৈভব বিস্তর।।
শুদ্ধচিত্তে এই ব্রত করি আচরণ।
সে কারণে উপবাসী আছি তপোধন।।

এত শুনি সবিস্ময় মহা তপোধন।
পুনরপি নৃপতিরে জিজ্ঞাসে কারণ।।
অপমান পেয়ে দুই যমের কিঙ্কর।
ধর্ম্মরাজে দিয়া কিবা করিল উত্তর।।
রাজা বলে মুনিবর কর অবধান।
বিস্ময় হইয়া দূত হয়ে অপমান।।
ক্রোধে থর থর অঙ্গ সঘনে কম্পিত।
যমের সাক্ষাতে গিয়া হৈল উপনীত।।
ভীতমন দুতগণে দেখিয়া শমন।
জিজ্ঞাসিল কহ দূত কেন দুঃখী মন।।
আমার কিঙ্কর তোরা নির্ভয় অন্তরে।
কার শক্তি তোলবারে হিংসা করিবরে।।
দূতগণ বলে আর কি কহিব কথা।
দণ্ডভগ্ন আজি হৈতে হইল সর্ব্বথা।।
আজি হৈতে জগতের হইল নিস্তার।
পাপপুণ্য বিচার ঘুচিল তা সবার।।
সুস্বর নামেতে ব্যাধ মহা দুরাচার।
আজি দৈবে পরলোক হইল তাহার।।
তাহারে আনিতে মোরা করিনু গমন।
পাশে বান্ধি লয়ে আসি করিয়া তাড়ন।।
হেনকালে আসি দুই শিবের কিঙ্কর।
পাশ হৈতে মুক্ত তারে করিল সত্বর।।
নানা কটুত্তর বলি আমা দুই জনে।
রথে তুলি তারে লয়ে গেল দূতগণে।।
এই হেতু চিত্তে দুঃখ হইল সবার।
আজি হৈতে তোমার ঘুচিল অধিকার।।

এত শুনি হাসি যম বলয়ে বচন।
হেন কর্ম্ম আর না করিহ কদাচ।।
শিব নামে রত যেই বিষ্ণুপরায়ণ।
বিষ্ণু শিব সমরূপে ভাবে যেই জন।।
ব্রত আচারিয়া যেবা পূজে পঞ্চানন।
চতুর্দ্দশী মহাব্রত যে করে সাধন।।
ভূমিদান অন্নদান করয়ে যে জন।
বিষ্ণুভক্তি করি কিবা পূজয়ে ব্রাহ্মণ।।
একাদশী চান্দ্রায়ণ পূর্ণিমার ব্রত।
সংসারের মধ্যে নর ইহাতে যে রত।।
তীর্থ পর্য্যটন করি পূজে দেবরাজে।
বারাণসীক্ষেত্রে গিয়া যেবা প্রাণ ত্যজে।।
তারপরে অধিকার নাহিক আমার।
কদাচ না যাবি তোরা তারে অনিবার।।

এত শুনি হৈল দূত সবিস্ময় মন।
কহিনু তোমারে আমি কথা পুরাতন।।
এত শুনি অষ্টবক্র হন হৃষ্টমন।
আশীষ করিয়া নৃপে গেল তপোধন।।
সেই হৈতে হৈল ঋষি শিবপরায়ণ।
শিবব্রতে রত হৈল অচ্যুত নন্দন।।
বসন্ত প্রথম ঋতু চতুর্দ্দশী দিনে।
এই উপবাস যেবা করে একমনে।।
সর্ব্বকালে ফল লভে নাহিক সংশয়।
শিব চতুর্দ্দশী ব্রতে মহাফল পায়।।
শান্তিপর্ব্ব ভারতের অপূর্ব্ব কথনে।
কাশীদাস দেব কহে গোবিন্দ চরণে।।