২৭. মণিপুরে বভ্রুবাহনের সহিত অর্জ্জুনের পরিচয়

মুনি বলে শুন পরীক্ষিতের তনয়।
মণিপুরে প্রবেশিল পাণ্ডবের হয়।।
মণিপুরে বভ্রুবাহ নামে নরপতি।
তিন বৃন্দ সেনা তার নব লক্ষ হাতী।।
এক লক্ষ নৃপতি রাজায় সেবা করে।
নানা রত্ন আনে তারা ভূপতি গোচরে।।
চিত্রাঙ্গদাসুত সেই অর্জ্জুন নন্দন।
নব লক্ষ রথ যার আছে সুশোভন।।
যাটি কোটি রণেতে অশ্ব আছে যাহার।
মহাবল বভ্রুবাহ বীর অবতার।।
তীর্থযাত্রা যেই কালে করে ধনঞ্জয়।
সে কালে গন্ধর্ব্ব কন্যা করে পরিণয়।।
তার গর্ভে জনমিল সে বভ্রুবাহন।
অর্জ্জুন সমান তারে বলে সর্ব্বজন।।
নাগকন্যা উলুপী আছেন তার ঘরে।
ইলাবন্ত তার পুত্র পড়িল সমরে।।
কুরুক্ষেত্র রণে ইলাবন্ত হৈল ক্ষয়।
শুনিয়াছ সেই কথা শ্রীজনমেজেয়।।
অর্জ্জুন আইল অশ্ব রাখিবার তরে।
দৈবে আসি অশ্ব প্রবেশিল মণিপুরে।।
ধরিল যজ্ঞের ঘোড়া বভ্রুবাহ বীর।
জননীর কাছে কহে করি চিত্ত স্থির।।
তুমি বল মম পিতা পাণ্ডুর নন্দন।
মণিপুরে আইলেন দৈব্যের ঘটন।।
না জানিয়া যজ্ঞ অশ্ব ধরিলাম আমি।
কি করি উপায় এবে কহ গো জননী।।
চিত্রাঙ্গদা বলে মুন সুবুদ্ধি কুমার।
যত্নেতে পালন কর বচন আমার।।
অশ্ব লয়ে যাহ তুমি জনকের স্থানে।
অপরাধ মাগি লহ তাঁহার চরণে।।
নানারত্ন অগ্রে থুয়ে করিবেক নতি।
পশ্চাতে কহিবে পুত্র আপন ভারতী।।
চিত্রাঙ্গদা গর্ভে জন্ম কহিবে তাঁহারে।
তনয় বলিয়া তেঁই তুষিবেন তোরে।
বভ্রুবাহ বলে মাতা করি নিবেদন।।
শুনিলাম যত আমি তোমার বচন।
এ রীতি ক্ষন্ত্রের নহে শুনগো জননী।।
যুদ্ধ করি পরিচয় তার দিব আমি।
পদানত হৈলে ঘৃণা করিবে আমারে।।
শুনগো জননী অগ্রে না জানাব তাঁরে।
চিত্রাঙ্গদা বলে পুত্র না হয় যুকতি।।
কেমনে যুঝিবা তুমি পিতার সংহতি।
নাহি শুন লোকমুখে ইতিহাস কথা।।
পুজা কৈলে পিতৃলোকে প্রসন্ন দেবতা।
তারে পুত্র বলি যে পিতার সেবা করে।।
সেই পুত্র বলি যে পিতার বাক্য ধরে।
তুমি যাহ পিতা সঙ্গে করিবারে রণ।।
কিমতে এ সব লাজে ধরিবে জীবন।
অশ্ব লয়ে যাহ তুমি পাণ্ডব গোচরে।।
লোকধর্ম্ম কথা আমি কহিনু তোমারে।
আপন স্বধর্ম্ম রক্ষা করে যেইজন।।
সর্ব্বত্র কল্যাণ তার বলে মুনিগণ।
জননীর বাক্যে বভ্রুবাহ নরপতি।।
নানা রত্ন নিল সঙ্গে সুশোভন অতি।
অগুরু চন্দন গন্ধ লইল কস্তুরী।।
পুষ্পমালা স্বর্ণথালে নিল যত্ন করি।
অশ্ব নিয়া চলিলেক পার্থের নন্দন।।
অর্জ্জুনে ভেটিতে যান আনন্দিত মন।
দূত গিয়া কহিলেন পার্থের গোচরে।।
বভ্রুবাহ আইলেন তোমা ভেটিবারে।
পদাতিক সঙ্গে আসে পাত্র মিত্রগণ।।
অভিপ্রায় বুঝি তব লইবে শরণ।
তাহা শুনি সম্মতি দিলেন ধনঞ্জয়।।
দিব্যাসনে বসিলেন সানন্দ হৃদয়।
কামদেব বৃষকেতু যুবনাশ্ব রায়।।
হংসধ্বজ নীলধ্বজ বসিল সভায়।
অনুশাল্ব বৃকোদর সুবেগ সহিত।।
অর্জ্জুন সমাজ কৈল পেয়ে মহাপ্রীত।
পুষ্পক চন্দন অর্জ্জুনের পদে দিয়া।।
প্রণাম করিল রাজা ভূমিষ্ঠ হইয়া।
পঞ্চরত্ন সম্মূখে রাখিয়া নরপতি।।
অর্জ্জুন চরণে রাজা করিল প্রণতি।
অবধান করি শুন পাণ্ডুর সন্ততি।।
অর্জ্জুন চরণ প্রান্তে বসিয়া রাজন।
আপনার কথা যত করে নিবেদন।।
তোমার তনয় আমি শুন মহাশয়।
চিত্রাঙ্গদা গর্ভেতে আমার জন্ম হয়।।
যখন করিলা তুমি তীর্থ পর্য্যটন।
করিলা গন্ধর্ব্বসুতা বিবাহ তখন।।
তোমার ঐরসে চিত্রাঙ্গদার উদরে।
হইল আমার জন্ম কহিনু তোমারে।।
না জানি ধরিনু ঘোড়া ক্ষমা দেহ মোরে।
বভ্রুবাহ বলি নাম জানহ আমারে।।
এত বলি পুনরপি ধরিল চরণে।
শুনিয়া জন্মিল ক্রোধ অর্জ্জুনের মনে।।
কাহারে বলিস পিতা নটির তনয়।
অভিপ্রায় বুঝি তোর নাহি লজ্জা ভয়।।
নটি চিত্রাঙ্গদা সেই গন্ধর্ব্ব দুহিতা।
তুই যার ‍পুত্র তার শুনিয়াছি কথা।।
এত বলি করিলেন চরণ প্রহার।
ভুমেতে পড়িল চিত্রাঙ্গদার কুমার।।
না করিহ তিরস্কার পাণ্ডুর তনয়।
আমিত তোমার পুত্র কহিনু নিশ্চয়।।
তবে হংসধ্বজ আর নীলধ্বজ রায়।
অর্জ্জুনে কহিল যুক্তি না হয় তোমায়।।
কুসুম চন্দন দিয়া পূজিল তোমারে।
হরণ প্রহার করা নহেত উচিত।।
তোমার তনয় হয় এ কথা নিশ্চিত।
আপনি আসিয়া বলে তোমার তনয়।।
অন্যে পিতা কহিতে অন্যের লজ্জা হয়।
তাহা শুনি ধনঞ্জয় কহেন বচন।।
অভিমন্যু বীর ছিল আমার নন্দন।
সুভদ্রা তনয় বীর বিদিত ভুবনে।।
বক্রব্যুহে যুঝিলেক দ্রোণ গুরু সনে।
দ্রোণ দ্রৌণি কৃপ কর্ণে সংগ্রামে ‍তুষিয়া।।
স্বর্গে গেল মহাবীর শরীর ত্যজিয়া।
সেই পুত্র হয় মম কুলের ভুষণ।।
বক্রবাহ হয়ে দেখ নটীর নন্দন।
অগ্রে গর্ব্ব করিয়া ধরিল মম হয়।।
ভয় পেয়ে বলে শেষে তোমার তনয়।
এ যদি হইত মম ঔরস নন্দন।।
যুদ্ধ বিনা ঘোড়া না করিত সমর্পন ।
কাতর হইল নহে আমার নন্দন।।
অঙ্কুর জিনয়ে বীজে বলে সর্ব্বজন।
পিতা হৈতে পুত্র শ্রেষ্ঠ সর্ব্বলোকে জানে।।
শাস্ত্রেতে এ সব কথা কহে মুনিগণে।

এতেক বলেন যদি বীর ধনঞ্জয়।।
বভ্রুবাহন তবে যে অধোমুখে রয়।
মহাকোপ জন্মিল বভ্রুবাহ চিতে।।
সম্মূখে দাণ্ডায়ে বীর রহে যোড়হাতে।
শুন মহাশয় তুমি কহিলা বিস্তর।।
শুনিবারে মন্দ কিন্তু ধর্ম্মেতে গোচর।
আপন জন্মের কিছু জান সমাচার।।
সে কথা কহিতে হৈল সাক্ষাতে সবার।
জারজ বলিয়া তুমি গালি দিলা মোরে।।
যে জন জারজ তাহা বিদিত সংসারে।
(মিসিং)

সে কারণে অপমান করিলে আমারে।
আজি নিজ পরাক্রম দেখাব তোমারে।।

কি পরাক্রম আমি দেখাব তোমারে।
বান্ধিয়া রাখহ অশ্ব করিয়া শকতি।।
এত বলি অশ্ব দিল অনুচরগণে।
অশ্ব লয়ে গেল তারা পরম যতনে।।
যে আজ্ঞা বলিয়া বীর প্রবেশিল ঘরে।
সেনাগণে আজ্ঞা দিল যুদ্ধ করিবারে।।
নৃপাদেশে সৈন্যগণ করিল সাহস।
আনন্দেতে দেয় সবে দামামা নির্ঘোষ।।
সাজ সাজ বলি পুরে উঠিল ঘোষণা।
নানা অস্ত্র লইয়া চলিল সর্ব্বসেনা।।
হয় গজ বিমানে করিয়া আরোহন।
ধনুর্ব্বাণ হাতে নিল করিবারে রণ।।
তোমার পট্টিশ গদা মুষল মুদগর।
শেল টাঙ্গি হাতে নিল করিতে সমর।।
চিত্রাঙ্গদা পাইলেক যুদ্ধ সমাচার।
পুত্রের সম্মূখে গেল করি হাহাকার।।
কি কহিল প্রাণনাথ পাণ্ডুর নন্দন।
কেন পুত্র যুদ্ধ হেতু করহ সাজন।।
শুনিয়া মাতার কথা বভ্রুবাহ কর।
বিলক্ষণ পাইনু পিতার পরিচয়।।
মহাভারতের কথা অমৃত সমান।
কাশীরাম দাস কহে শুনে পুণ্যবান।।