২৭. কুরুসৈন্যের সহিত ঘটোৎকচের মহাযুদ্ধ ও অলম্বুষ বধ

মহাপরাক্রম বীর হিড়িম্বা নন্দন।।
তালতরু সম গদা হাতে মহাবীর।
কুরুসেনা মধ্যে ধায় নির্ভয় শরীর।।
গদা লয়ে ঘটোৎকচ বায়ুবেগে ধায়।
রথ গজ পদাতিক চূর্ণ করি যায়।।
সৃষ্টি নাশ করে যেন প্রচণ্ড তপন।
সেইমত ঘটোৎকচ ভীমের নন্দন।।
পর্ব্বত আকার কৈল দীর্ঘ কলেবর।
অভেদ্য শরীর কৈল বজ্র সম সর।।
কৈল দশ যোজন সুদীর্ঘ কলেবর।
মেঘের আকার বর্ণ মহাভয়ঙ্কর।।
মুখখান যুড়ে ‍পৃথ্বী গগণমণ্ডল।
আনন্দিত ঘটোৎকচ হাসে খল খল।।
মুখ দেখি কুরুসৈন্য হারায় চেতন।
বিনা যুদ্ধে শত শত ত্যজিল জীবন।।
ঘটোৎকচ মুখ দেখি কুরুসেনাগণ।
সত্বরে পলায় সবে লইয়া জীবন।।
শিমুলের তুলা যেন উড়ায় পবন।
হেনমতে পলাইল সব সেনাগণ।।
ঘটোৎকচ আগেতে না রহে কোন বীর।
সিংহনাদ করে বীর নির্ভয় শরীর।।

হেনকালে আসে দুঃশাসনের নন্দন।
দোষণ তাহার নাম ‍রূপেতে মদন।।
রথে চড়ি ধনু ধরি আসে শীঘ্রগতি।
শরজালে আবরিল ঘটোৎকচ রথী।।
আনন্দিত ঘটোৎকচ ভীমের নন্দন।
গদা লয়ে ধায় যেন কাল হুতাশন।।
ক্ষুধার্ত্ত গরুড় যেন পইল ডুণ্ডুভ।
মহাক্রোধে ঘটোৎকচ ধায় সেইরূপ।।
গদার প্রহার কৈল তাহার উপর।
রথ অশ্ব সারথিরে দিল যমঘর।।
লাফি দিয়া যায় দুঃশসনের নন্দন।
দেখি ধায় ঘটোৎকচ মহাক্রুদ্ধ মন।।
অষ্টশিরা গদা গোটা নিল বীর হাতে।
হাসিতে হাসিতে মারে দোষণের মাথে।।
বজ্রাঘাতে যেন গিরি শৃঙ্গ চূর্ণ হয়।
সেইমত পড়ে দুঃশাসনের তনয়।।
দোষণ পড়িল দেখি কান্দে দুঃশাসন।
হাহাকার করি কান্দে যত যোদ্ধাগণ।।
পুত্রশোকে দুঃশাসন মহাক্রুদ্ধ হয়ে।
হাতে ধনু করি আসে দিব্য শর লয়ে।।
সন্ধান পূরিয়া যোড়ে চোখ চোখ শর।
দেখি ঘটোৎকচ বীর হরিষ অন্তর।।
দুঃশাসনে ডাকি বলে ঘটোৎকচ বীর।
আজি যুদ্ধ দেহ মোরে হইয়া সুস্থির।।
কৌতুক দেখিবে আজি যত যোদ্ধাগণ।
অবশ্য পাঠাব তোরে যমের সদন।।

এত বলি দিব্য অস্ত্র নিল ঘটোৎকচ।
দশ বাণে বিপক্ষের কাটিল কবচ।।
আর দশ বাণ এড়ে পূরিয়া সন্ধান।
দুঃশাসন অঙ্গ কাটি করে খান খান।।
মূর্চ্ছিত হইয়া পড়ে দুঃশাসন বীর।
রণ ত্যজি পলাইল হইয়া অস্থির।।
দুঃশাসন ভঙ্গ দেখি হাসে মহাবীর।
সিংহনাদ করি বুলে নির্ভয় শরীর।।
নানা মায়া করি বুলে ভীমের নন্দন।
রাক্ষসী মায়ায় বীর বড় বিচক্ষণ।।
কোনখানে অগ্নিরূপে দহে সেনাগণ।
দাবানলে ধরি কোথা হস্তী করে নাশ।।
দেখিয়া কৌরবগণ গণিল তরাস।

ঘটোৎকচ যুদ্ধ দেখি ধর্ম্মের নন্দন।।
ধন্য ধন্য করিয়া করেন প্রশংসন।
কৌরবের দলে হৈল রোদন অপার।।
একা ঘটোৎকচ বীর কৈল মহামার।
সৈন্যগণ পড়ে দেখি কান্দে দুর্য্যোধন।।
হেনকালে আসে কর্ণ রবির নন্দন।
ক্রোধে ধনু ধরি বীর চলে সেইক্ষণ।
ঘটোৎকচ সহ গেল করিবারে রণ।।
দেখি ঘটোৎকচ বীর ধাইল সত্বর।
গদা তুলি মারে বীর কর্ণের উপর।।
অশ্ব সহ সারথিরে করিলেক চূর।
লাফ দিয়া পলাইল কর্ণ মহাশূর।।
কর্ণ পলাইল দেখি ভীমের নন্দন।
মহাকোপে বহু সৈন্য করিল নিধন।।
শত শত হস্তী মারে গদার প্রহারে।
লক্ষ লক্ষ পদাতিক নিমিষে সংহারে।।
শত শত রথ পড়ে হয়ে খান খান।
দেখিয়া কৌরবদল হৈল কম্পমান।।
হাহাকার শব্দ করে যত যোদ্ধাগণ।
দেখি দুর্য্যোধন রাজা শোকাকুল মন।।

ঘটোৎকচ যুদ্ধ দেখি দ্রোণের নন্দন।
সিংহনাদ করি গেল করিবারে রণ।।
সন্ধান পূরিয়া অশ্বথামা এড়ে বাণ।
দেখি ঘটোৎকচ বীর ক্রোধে কম্পমান।।
এক লাফে নিজ রথে চড়ে বীরবর।
গদা এড়ি ধনুঃশর লইল সত্বর।।
হাতে তুলে নিল বীর দুর্দ্ধরিষ ধনু।
সন্ধান পুরিয়া বিন্ধে দ্রোণপুত্র তনু।।
শীঘ্র অস্ত্র অশ্বথামা পূরিয়া সন্ধান।
নিমিষেতে নিবারিল ঘটোৎকচ বাণ।।
বাণ ব্যর্থ দেখি বীর সন্ধান পূরিল।
তীক্ষ্মভল্ল দশ গোটা অঙ্গেতে মারিল।।
মোহ গেল ঘটোৎকচ রথের উপর।
সিংহনাদ করি বুলে দ্রোণের কুমার।।
কতক্ষণে ঘটোৎকচ পাইল চেতন।
ক্রোধমূর্ত্তি দেখি যেন কাল হুতাশন।।
ধনু এড়ি গদা লয়ে ধাইল সত্বর।
দোহাতিয়া বাড়ি মারে রথের উপর।।
যদার প্রহারে রথ খণ্ড খণ্ড হৈল।
লাফ দিয়া অশ্বথামা বেগে পলাইল।।
ভয়ে কম্পমান হৈল দ্রোণের নন্দন।
দ্রুতগতি পলাইল লইয়া জীবন।।

তবে ঘটোৎকচ বীর কুপিত অন্তরে।
হাতে গদা করি বীর ভ্রময়ে সমরে।।
লেখা জোখা নাহি যত পড়ে সেনাবর।
পলাইয়া যায় সবে ত্যজিয়া সমর।।
বায়ুবেগে ধায় যত অশ্ব আসোয়ার।
পলায় পদাতিগণ লেখা নাহি তার।।
হেনমতে ঘটোৎকচ করে মহামার।
কৌরবের দলে উঠে শব্দ হাহাকার।।

হেনকালে অলম্বুষ আইল রাক্ষস।
মহাপরাক্রম বীর অসীম সাহস।।
রাক্ষসের সেনা লয়ে ধাইল সত্বর।
পর্ব্বত আকার বীর মহাভয়ঙ্কর।।
রাক্ষস দেখিয়া ধায় ঘটোৎকচ বীর।
মহাগদা হাতে করি নির্ভয় শরীর।।
গদার প্রহার করে রাক্ষস উপর।
অনেক রাক্ষস মারে সংগ্রাম ভিতর।।
অশ্ব হস্তী পদতিক সম্মূখে যা পায়।
গদার প্রহারে বীর চূর্ণ করি ধায়।।
কোটি কোটি সেনা পড়ে না যায় লিখন।
দেখি পলাইয়া যায় যত যোদ্ধাগণ।।
তবে ক্রোধে অলম্বুষ রাক্ষস ঈশ্বর।
গদা লয়ে ধায় বীর সংগ্রাম ভিতর।।
তবে ক্রোধে ঘটোৎকচ ভীমের কোঙর।
গদা প্রহারিল অলম্বুষের উপর।।
গদার প্রহারে বীর হইল জর্জ্জর।
ত্রাস পেয়ে উঠে গিয়া আকাশ উপর।।
অন্তরীক্ষে থাকি বীর করে ঘোর রণ।
দেখিয়া কুপিল বীর হিড়িম্বা নন্দন।।
অন্তরীক্ষে ঘটোৎকচ উঠিল সত্বর।
মহাযুদ্ধ করে দোঁহে শূন্যের উপর।।
মহাত্রাসে অলম্বুষ মেঘে লুকাইল।
দেখি ঘটোৎকচ বীর কুপিত হইল।।
মায়া করি লুকাইল হিড়িম্বা নন্দন।
দেখি ভয়ে রাক্ষস পলায় সেইক্ষণ।।
তথা হৈতে অলম্বুষ নামে রণস্থল।
দেখিয়া ধাইল ঘটোৎকচ মহাবল।।
পুনরপি দুইজনে হইল সংগ্রাম।
নানা মায়া করে বীর অতি অনুপম।।
দিব্য রথে অলম্বুষ করি আরোহণ।
ভীমের নন্দনে করে বাণ বরিষণ।।

তবে কটোৎকচ বীর গদা লয়ে ধায়।
রথ অশ্ব চূর্ণ বীর করে এক ঘায়।।
লাফ দিয়া পলাইল রাক্ষস ঈশ্বর।
পুনরপি গদা লয়ে ধাইল সত্বর।।
মহাযুদ্ধ করে দোঁহে ধরণী উপর।
গদার প্রহারে দোঁহে হইল জর্জ্জর।।
পুনরপি রাক্ষস হইল লুকি কায়।
কোথায় আছয়ে কেহ দেখিতে না পায়।।
কতক্ষণে রাক্ষস আইল আরবার।
সৈন্যের উপরে করে গদার প্রহার।।
দেখিয়া ধাইল বীর হিড়িম্বানন্দন।
পুনরপি দুইজনে করে মহারণ।।
দিব্য রথে চড়ি দোঁহে করয়ে সমর।
বাণাতে দোঁহার অঙ্গ হইল জর্জ্জর।।
তবে কোপে বাণ এড়ে ঘটোৎকচ বীর।
বাণে বিন্ধে অলম্বুষে করিল অস্থির।।
সহিতে না পারি ভঙ্গ দিল দ্রুতগতি।
পুনরপি লুকাইল রাক্ষসের পতি।।
মায়া করি পর্ব্বত হইল নিশাচর।
শত শৃঙ্গ ধরে তার মহাভয়ঙ্কর।।
তার এক শৃঙ্গে রহে রাক্ষসের পতি।
রণস্থলে পর্ব্বত হইল শীঘ্রগতি।।
মহাশব্দ করি পড়ে সৈন্যের উপর।
রথধ্বজ চূর্ণ করে সংগ্রাম ভিতর।।
দেখি ঘটোৎকচ বীর ধাইল সত্বর।
এক লাফে চড়ে গিয়া পর্ব্বত উপর।।
পর্ব্বতের শৃঙ্গে দেখে বসেছে রাক্ষস।
গদা হাতে করি ধায় অসীম সাহস।।
এক গদাঘাতে সব মায়া কৈল চূর।
অলম্বুষ পলাইয়া গেল অতি দূর।।
পুনরপি ‍রাক্ষস আইল আচম্বিত।
দেখি ধায় ঘটোৎকচ নহে কিছু ভীত।।
একলাফে চড়ে তার রথের উপর।
অলম্বুষ রাক্ষসেরে ধরিল সত্বর।।
চুলে ধরি রাক্ষসেরে ভূমেতে পাড়িল।
মুকুটির ঘায়ে তার মস্তক ভাঙ্গিল।।
অলম্বুষ পড়িল তরাস কুরুদলে।
মহামার ঘটোৎকচ করে রণস্থলে।।
মহাভারতের কথা অমৃত-সমান।
কাশীরাম দাস কহে শুনে পুণ্যবাণ।।