২৬. দশম দিনের যুদ্ধারম্ভ

সঞ্জয় বলেন, শুন কৌরব ঈশ্বর।
সূর্য্যোদয়-কালে আইল পাণ্ডব সকল।।
যখন যে কর্ম্ম হয় জানে ভগবান।
শিখণ্ডীরে আনিয়া কহিলা বিদ্যমান।।
ভীষ্ম বধ হেতু পূর্ব্বে জনম তোমার।
গুপ্তকথা নহে সেই বিদিত সংসার।।
আজি রণে কুরুগণে খুঁজিয়া মারিবে।
তেকারণে বলি তোমা নির্ভয়ে থাকিবে।।
আজি ভীষ্ম মহারনে হইবে নিধন।
ধনু ধরি আপনি করিহ কালি রণ।।
এত বলি শিখণ্ডীকে রণে পাঠাইয়া।
চলিল শ্রীকৃষ্ণ পার্থ সুসজ্জ হইয়া।।
নানা বাদ্য বাজয়ে দুন্দুভি শঙ্খধ্বনি।
গগন পূরিল শব্দে কাপিঁল মেদিনী।।
অর্দ্ধচন্দ্র ব্যূহ ধৃষ্টদ্যুম্ন বীর কৈল।
দক্ষিণ শৃঙ্গেতে ধৃষ্টকেতু নিয়োজিল।।
উত্তর শৃঙ্গেতে বিরাট দ্রুপদ রাজন।
মহা মহা যোদ্ধাগণ তাহার ভিড়ন।।
মধ্যে রহে যুধিষ্ঠির সৈন্যের সহিতে।
নকুল সহদেব রহে রাজারে রাখিতে।।
শিখণ্ডীকে আগে করি লয়ে যোদ্ধাগণ।
ব্যূহ করি রহিলেন করিবারে বাণ।।
শিখণ্ডীর দুই পাশে ভীম ধনঞ্জয়।
পৃষ্ঠে অভিমন্যু সঙ্গে দ্রৌপদী তনয়।।
তার পাশে রহিলা সাত্যকি চেকিতান।
তার পাশে ধৃষ্টদ্যুম্ন পাঞ্চাল প্রধান।।
তার পাছে ঘটোৎকচ নির্ভয় শরীর।
শিখণ্ডীর পাছে রৈলা এই দশ বীর।।
ব্যূহ করি সাজিলেক পাণ্ডবের পতি।
সৈন্যগণ সিংহনাদে উল্লাসিত মতি।।
তবে ত কৌরব যত ভীষ্ম আগে করি।
দুর্য্যোধন চলি আইল কুরু-অধিকারী।।
দ্রোণাচার্য্য আগু হৈলা দ্রৌণির সংহতি।
তার পাছে ভগদত্ত চড়ি মত্ত হাতী।।
তার পাছে কৃতবর্ম্মা কৃপ মহাশূর।
তার পাছে সুদক্ষিণ কম্বোজ-ঈশ্বর।।
জয়সেন জয়দ্রথ সৌবল মহাবল।
তার পাছে যত সব নৃপতি সকল।।
তার পাছে বৃহদ্বল মহাবলবন্ত।
সর্ব্ব শেষে আসে পুনঃ বীর অতিমন্ত।।
সৈন্য সমাবেশ করি শান্তনু-নন্দন।
পিশাচী রাক্ষসী ব্যূহ করিলা তখন।।
অসুর-আকার ব্যূহ অতি ভয়ঙ্কর।
এইমত সমরেতে রহিলা সকল।।
সাগর সমান সৈন্য সংগ্রামে দুর্জ্জয়।
সৈন্যের অগ্রেতে রহে ভীষ্ম মহাশয়।।
শিখণ্ডীকে আগে করি যুঝে ধনঞ্জয়।
না করে সম্ভ্রম বীর সমরে দুর্জ্জয়।।
ভীমসেন মারিল বহুত সৈন্যগণ।
বদনে রুধির উঠি ত্যজিল জীবন।।
সহদেব নকুল সাত্যকি মহাবীরে।
কুরুবল মারিয়া পাঠায় যমঘরে।।
পাণ্ডবের প্রতাপ সহিবে কোন জনা।
চতুর্দ্দিকে ধায় সৈন্য নাহি মানে মানা।।
সৈন্য ভঙ্গ দেখি ভীষ্ম সমরে প্রখর।
ক্রোধে হাতে করি তবে নিল ধনুঃশর।।
জ্বলন্ত অনলে যেন দিল ঘৃতধার।
পাণ্ডবের ধায় ভীষ্ম সমরে দুর্ব্বার।।
চেকিতান পাঞ্চালাদি যত বীরচয়।
একে একে হানে ভীষ্ম সমরে দুর্জ্জয়।।
ভীষ্ম যে হানিছে বাণ হৈয়া কোপবন্ত।
যত অস্ত্র মারে বীর নাহি দিগঅন্ত।।
একে একে বিন্ধিল পাঞ্চাল পঞ্চজন।
হ্স্তী অশ্ব রথ ধ্বজ কে করে গণন।।
অশ্বপৃষ্ঠ হৈতে পড়ে আশোয়ারগণ।
গজ হৈতে মাহুত পড়িল ততক্ষণ।।
বজ্র হস্তে ইন্দ্র যেন অসুর সংহারে ।
সর্ব্বসৈন্য ক্ষয় কৈল ভীষ্ম ধনুর্দ্ধরে।।
যেমত ইন্দ্রের ধনু শোভয়ে আকাশ।
তেন মত ভীষ্ম ধনু করয়ে প্রকাশ।।
নিবারিতে না পারি পাণ্ডব ধনুর্দ্ধর।
বিষণ্ন বদন হৈল পঞ্চ সহোদর।।
নমুচি দানব যেন ইন্দ্রের সংহতি।
সেইমত ভীষ্ম কৈল সংগ্রামে দুর্গতি।।
এইরূপে দুই দলে হৈল মহারণ।
দেবাসুর যুদ্ধ যেন ঘোর দরশন।।
দশম-দিবস যুদ্ধে ভীষ্ম মহাবল।
বাণে বিন্ধি পাণ্ডুসেনা করিল বিকল।।
কালান্তক যম যেন সংগ্রাম ভিতর।
শিখণ্ডী যে ভীষ্মকে মারিল পঞ্চশর।।
হাসিয়া বলেন ভীষ্ম শিখণ্ডীকে দেখি।
যদি মৃত্যু হয়তবে তোমাকে উপেক্ষি।।
শিখণ্ডিনী তোকে ত বিধাতা সিরজিল।
দৈবের বিপাকে তোরে পাণ্ডবে বরিল।।
শরীর কাটিয়া যদি পাড়হ ভূতলে।
অস্ত্র না মারিব আমি তোমার শরীরে।।
ক্রুদ্ধ হৈয়া শিখণ্ডী ভীষ্মেরে বলে দাপে।
নিরস্ত্র হইল ক্ষত্র তোমার প্রতাপে।।
পূর্ব্বে পরশুরামের সনে কৈলে রণ।
দেবের প্রতাপ তব শুনিনু বচন।।
তোমার প্রতাপ সব জগতে বিদিত।
তেকারণে তোমা সহ যুঝিব নিশ্চিত।।
পাণ্ডব সাহায্য হেতু আমি করি রণ।
সংগ্রামেতে জিনিব দেখুক সর্ব্বজন।।
আজি সত্য করিয়াছি শুন মহাবল।
মোর অস্ত্রে আজি তবে হৈবে অমঙ্গল।।
বাক্য-যুদ্ধ ছাড়িয়া মারিল পঞ্চ বাণ।
ভীষ্মবীর নাহি হানে করি নারীজ্ঞান।।
শিখণ্ডীকে বলে তবে পার্থ ধনুর্দ্ধার।
কাল হেন জানি ভীষ্মে মারহ সত্বর।।
তব পাছে থাকি আমি এড়িব যে বাণ।
ভীষ্মেরে জানাহ তুমি করিয়া সন্ধান।।
এই জানি ভীষ্মে হান শীঘ্র মার শর।
না মরিয়া ভীষ্মে আজি না যাইব ঘর।।
রণে ভীষ্মে না মারিয়া যদি যাই ঘর।
তোমা আমা দেখি লোক হাসিবে বিস্তর।।
কুরুযোদ্ধা যতেক সকলে ডরে তোরে।
নিরাতঙ্কে মার ভীষ্মে ভয় নাহি তারে।।
কৃষ্ণসঙ্গে আমি তোমা রাখিব সংগ্রামে।
কি করিতে পারে দ্রোণ অশ্বত্থামা সনে।।
শল্য ভূরিশ্রবা আর কৌরবের পতি।
চিত্রসেন বিকর্ণ সৌবল মহামতি।।
বিন্ধ্য অনুবিন্ধ্য সুদক্ষিণ ভগদত্ত।
অলম্বুষ মগধ বাহ্লীক সোমদত্ত।।
আর যত মহামতি ত্রিগর্ত্ত নৃপতি।
কি করিতে পারে তোমা কাহার শকতি।।
সমুদ্রে পড়য়ে যেন সমুদ্রের জল।
একেশ্বর নিবারিব কুরু-মহাবল।।
ভীষ্ম তোকে অস্ত্র না মারিবে কদাচিত।
এতেক জানিয়া যত্নে হানহ ত্বরিত।।
পৌরুষ করিয়া আজি মার গঙ্গাসুত।
দুই দলে দেখুক আজি বিক্রম অদ্ভুত।।
এত বলি ধনঞ্জয় করে শরবৃষ্টি।
চারিদিক অন্ধকার মজাইতে সৃষ্টি।।
হইল তুমুল যুদ্ধ মহাকোলাহল।
অর্জ্জুনের বিক্রম না সহে কুরুদল।।
সিংহ যেন অরণ্যে খেদায় মৃগগণ।
ভঙ্গ দিল কুরুগণ পরিহরি রণ।।
সৈন্যভঙ্গ দেখি দুর্য্যোধন পায় দুখ।
বিষণ্ণ বদরে গেলা ভীষ্মের সম্মুখ।।
অর্জ্জুনের শরজালে ভাঙ্গে মোর সৈন্য।
নির্বাত কালেতে যেন দহয়ে অরণ্য।।
গজেন্দ্র মারিতে যেন ধায় মৃগরাজ।
কুরুসেনা খেদাইল পাণ্ডব সমাজ।।
লণ্ডভণ্ড কৈল মোর যত সেনাগণ।
কার শক্তি সহিবেক অর্জ্জুনের রণ।।
তোমা ছাড়া গতি নাহি আমার সেনার।
তুমি না রাখিলে গতি না দেখি যে আর।।
এতেক কহিল যদি রাজা দুর্য্যোধন।
মুহূর্ত্তেক রহি বলে শান্তনু নন্দন।।
স্থির হও দুর্য্যোধন না হও বিমন।
জয় পরাজয় জান দৈব-নিবন্ধন।।
পূর্ব্বেতে প্রতিজ্ঞা কৈনু তোমার অগ্রেতে।
দশ সহস্র রথী আমি মারিব যুদ্ধেতে।।
দশ সহস্র রথী যদি না মারি পরাণে।
রথ হতে নিবর্ত্তন নহি কদাচনে।।
পাণ্ডবের সেনা মারি করিব যে ক্ষয়।
নতুবা আমারে মারি লভুক বিজয়।।
এক কর্ম্ম পণে নিবর্ত্তিনু দশ দিন।
আমার প্রতিজ্ঞা কভু নহিবেক ভিন।।
এত বলি ভীষ্ম বীর হাতে নিল শর।
নিরন্তর শরজালে ছাইল অম্বর।।
পাণ্ডবের সৈন্য সব ভেদিলেক শরে।
যুগান্তের কালে যন সংসার সংহারে।।
সর্ব্বসৈন্য সংহারিল ভীষ্ম ধনুর্দ্ধর।
লক্ষ লক্ষ বাণ মারে পান্ডব উপর।।
এক লক্ষে বিন্ধিল পাঞ্চাল মহাবীর।
দশ সহস্র অশ্বের কাটিলেক শির।।
জ্বলন্ত অনলে যেন দহিল শরীর।
দেখিয়া ক্রোধিত হৈল ধৃষ্টদ্যুম্ন বীর।।
ধৃষ্টদ্যুম্ন ডাক দিয়া বলিল সত্বরে।
ভয় না করিহ কেহ মারহ ভীষ্মেরে।।
এই যে অর্জ্জুন দেখ ভীষ্মকে মারিতে।
চলিছে করিয়া ক্রোধ শিখণ্ডী সহিতে।।
ধৃষ্টদ্যুম্ন বাক্য শুনি ফিরে সেনাগণ।
পথ আগুলিয়া যুদ্ধ করে দুঃশাসন।।
দুঃশাসন অর্জ্জুনেরে হানে তিন বাণ।
নয় বাণে বাসুদেবে হানিল তখন।।
কৃষ্ণেরে মারিয়া পার্থে মারিবারে চায়।
শতেক নারাচ পার্থ এড়িলেক তায়।।
কবচ ভেদিয়া বাণ উঠয়ে গগন।
রথে পড়ে দুঃশাসন হৈয়া অচেতন।।
সংজ্ঞা পেয়ে ধনু ধরি মারে পঞ্চবাণ।
অর্জ্জুন-ললাটে গিয়া ভেদিল তখন।।
পঞ্চশির সর্প যেন অতি শোভা করে।
অশোক কিংশুক যেন শোভে বৃক্ষোপর।।
অর্জ্জুন করিয়া ক্রোধ হানে দুঃশাসন।
শরে হানি কৈল যেন অরুণ-বরণ।।
লইয়া শাণিত বাণ এড় দুঃশাসন।
অর্জ্জুন কাটিল তাহে তিল পরিমাণ।।
পুনঃ পার্থ দুঃশাসনে হানিল অপার।
পার্থে বিংশ বাণ হানে কৌরব-কুমার।।
ভঙ্গ দিল দুঃশাসন সমর এড়িয়া।
ভীষ্মেরে নিকটে গিয়া রহে স্থির হৈয়া।।
মজিয়া থাকয়ে কেহ অগাধ সলিলে।
নিস্তার পায় ত সেই স্রোতে নিলে কূলে।।
ভীষ্মের নিকটে তেন পাইল নিস্তার।
শ্রমশান্তি করি পুনঃ আইল যুঝিবার।।
বৃত্র-বাসবেতে যেন পূর্ব্বে কৈলরণ।
পরস্পর হানা-হানি হৈল দুইজন।।
তবে পার্থ দিব্য অস্ত্র এড়িল সন্ধিয়া।
দুঃশাসন কাটিলেক অর্দ্ধচন্দ্র দিয়া।।
রণমধ্যে যুঝেন অর্জ্জুন দুঃশাসনে।
সিংহ যেন মৃগেরে খেদায় মহারণে।।
অর্জ্জুনের সম্মুখে পলায় দুঃশাসন।
রণ এড়ি পুনঃ গেলা ভীষ্মের সদন।।
অলম্বুষ সাত্যকিতে হৈল মহারণ।
হাসিয়া রাক্ষসে বলে লইব জীবন।।
অলম্বুষ সাত্যকি হানিল নব শরে।
মূর্চ্ছিত হইয়া পড়ে রথের উপরে।।
ক্ষণেকে চেতন পেয়ে উঠয়ে রাক্ষস।
সাত্যকিরে হানে বাণ করিয়া সাহস।।
ভগদত্ত ক্রোধ করি আইর তখন।
সাত্যকি উপরেকরে বাণ করিষণ।।
সাত্যকির ধনু কাটে ভগদত্ত বীর।
তবে আর ধনু লৈলা সাত্যকি সুধীর।।
ক্রোধ করি ভগদত্তে হানে চোখ শর।
অগ্নি হেন বাণে বিন্ধে তার কলেবর।।
দেখি রাজা ভগদত্ত সক্রোধ অন্তরে।
শেলপাটে এড়িলেক সাত্যকি উপরে।।
শেল লৈল ভগদত্ত যমদণ্ড সম।
সাত্যকি মারিতে এড়ে করিয়া বিক্রম।।
সাত্যকি কাটিয়া শেল করে দুইখান।
ভূমিতে পড়িল শেল উল্কার সমান।।
তবে আজ্ঞা কৈল ভাতৃগণে দুর্য্যোধন।
সব যোদ্ধা লৈয়া কর ভীষ্মের রক্ষণ।।
রাজার বচন শুনি চলে রথিগণ।
অভিমন্যু সাত্যকি সনে পথে দরশন।।
কাম্বোজ সহিত যুদ্ধ অভিমন্যু করে।
ষাটি বাণ হানিলেক সুভদ্রা-কুমারে।।
সহদেব সহিত নকুল যুধিষ্ঠির।
ভীষ্মকে মারিতে যায় নির্ভয় শরীর।।
তবে কুরুবল সব আইল সত্বর।
একে এক নিবারয়ে পাণ্ডবের শর।।
ধৃষ্টদ্যুম্নে নিবারিল কৃতবর্ম্মা বীর।
সোমদত্ত মারি ভীমে করিল অস্থির।।
নকুলে নিবারে সে বিকর্ণ মহাবীর।
সহদেবে নিবারে কৃপ নির্ভয় শরীর।।
ঘটোৎকচে নিবারে সকল মহাবল।
পরস্পর দুই দলে এড়ে দিব্য শর।।
ক্রোধে ভূরিশ্রবা অস্ত্র এড়য়ে নির্ভয়।
সেই বাণে হানিলেক ভীমের হৃদয়।।
ভীমসেন হানিলেক সোমদ্ত্ত-সুত।
সূর্য্যের সমান বাণ দেখিতে অদ্ভুত।।
চিত্রসেন চেকিতান যুঝে পরস্পর।
প্রাণপণে চেকিতান করিল সমর।।
দুই বীরে যুদ্ধ হৈল দেখে সর্ব্বজনে।
কেহ কারে নিবারিতে না পারিল রণে।।
বিমুখ কৌরবসৈন্য কৈল ধনঞ্জয়।
পাণ্ডবের সেনা মারি ভীষ্ম কৈল ক্ষয়।।
মহাভারতের কথা অমৃত-সমান।
কাশীরামদাস কহে শুনে পুণ্যবাণ।।