২৫. উত্তর ও পশ্চিম দ্বারে বিভীষণের অপমান

যাইতে যাইতে কৃষ্ণ কন বিভীষণে।
বহু রাজা দেখিয়াছ, শুনেছ শ্রবণে।।
এমত সম্পদ কি পেয়েছে কোনজনে।
আমা হেন জনে রাখে যার দ্বারিগণে।।
তিন ভুবনের লোক একত্র মিলিল।
ইন্দ্র-আদি করি সবে যাঁরে কর দিল।।
বিভীষণ বলে, দেব এ নহে অদ্ভুত।
ইহা হৈতে রাজসূয় হয়েছে বহুত।।
হরিশ্চন্দ্র মহারাজ এ যজ্ঞ করিল।
চৌদ্দ ভুবনের লোক একত্র হইল।।
আর আর যত রাজা পৃথিবীতে ছিল।
ইন্দ্র-আদি দেব জিনি নানা যজ্ঞ কৈল।।
একমাত্র পাণ্ডবের বাখানি বিশেষ।
আপনি এতেক স্নেহ কর হৃষীকেশ।।
ব্রহ্মা আদি ধ্যায় প্রভু তোমা দেখিবারে।
এ বড় আশ্চর্য্য, তুমি ভ্রম দ্বারে দ্বারে।।
তোমার চরিত্র প্রভু কি বুঝিতে পারি।
নিমিষে প্রলয় কর সৃষ্টি সংহারি।।
ব্রহ্মপদ কীট প্রভু তোমার সমান।
যারে যাহা কর, তাহা কে করিবে আন।।
ইন্দ্র-আদি-পদ প্রভু না করি গণন।
তব পদে ভক্তি যার সেই মহাজন।।
ভক্তিতে পাণ্ডব বশ করিয়াছে তোমা।
তেঁই দ্বারে দ্বারী রাখে, তারে কর ক্ষমা।।
কি কারণে জগন্নাথ এত পর্য্যটন।
দ্বারে দ্বারে ভ্রম প্রভু, কোন্ প্রয়োজন।।
দৈবেতে এ দ্বারিগণ না ছাড়ে আমারে।
মম প্রয়োজন কিছু নাহিক ভিতরে।।
মানস হইল পূর্ণ, সিদ্ধ হৈল কার্য্য।
তব আজ্ঞা হইল প্রভু, যাই নিজ রাজ্য।।
বিভীষণ-বাক্য শুনি বলে চক্রধর।
কত আর তোমারে কহিব লঙ্কেশ্বর।।
সর্ব্ব ধর্ম্ম জান তুমি বিচারে পণ্ডিত।
তুমি হেন কথা কহ, না হয় উচিত।।
নিমন্ত্রণ করিল যে, তারে না ভেটিয়া।
যদি যাহ, জিজ্ঞাসিলে কি বলিব গিয়া।।
তব আগমন এবে জ্ঞাত হৈল।
লোকে বলিবেক, সেই কৃষ্ণ ভেটি গেল।।
হেন অপকীর্ত্তি মম চাহ কি কারণ।
ক্ষণেক রহিয়া কর রাজ দরশন।।
এইরূপে পথে দোঁহে কথোপকথনে।
উত্তর-দুয়ারে উত্তরিলেন দুজনে।।
উত্তর দুয়ারে দ্বারী কামের নন্দন।
গোবিন্দে দেখিয়া আসি করিল বন্দন।।
শ্রীকৃষ্ণ বলেন, যাই রাজার গোচর।
ধর্ম্মরাজে ভেটাইব রাক্ষস-ঈশ্বর।।
অনিরুদ্ধ বলে, দেব রহ মুহূর্ত্তেকে।
এখনি মাদ্রীর পুত্র হেথা আসিবেক।।
তাঁর হাতে জানাইব রাজার গোচর।
আজ্ঞা হৈল লয়ে যাহ রাক্ষস-ঈশ্বর।।
গোবিন্দ বলেন, তুমি না জান ইহারে।
ক্ষণেক উচিত নহে রাখিতে দুয়ারে।।
রাবণের সহোদর লঙ্কা-অধিপতি।
রাক্ষসের রাজা যে ব্রহ্মার হয় নাতি।।
এত শুনি হাসি বলে কামের নন্দন।
কেন হেন কহ দেব জানিয়া কারণ।।
প্রত্যক্ষ দেখহ দেব যতেক নৃপতি।
অনেক দিবস হৈল দ্বারে কৈল স্থিতি।।
প্রাগ্ দেশ-অধিপতি রাজা ভগদত্ত।
নব-কোটি রথ সঙ্গে, কোটি গজ মত্ত।।
বিংশতি -সহস্র রাজা ইহার সংহতি।
ঐরাবত সম যার অযুতের হাতী।।
নানারত্ন কর দেখ সঙ্গেতে করিয়া।
বহুদিন দ্বারে আছে বারিত হইয়া।।
বাহ্লীক বৃহন্ত আর সুদেব কুন্তল।
সিংহরাজ সুশর্ম্মা রোহিত বৃহদ্বল।।
কামদেব কামেশ্বর রাজা কামসিন্ধু।
ত্রিগর্ত্ত দ্বিরদ শিব মহারাজ সিন্ধু।।
এ সবার সঙ্গে রাজা শত পঞ্চশত।
ত্রিশ-কোটি মত্ত হস্তী ত্রিশ-কোটি রথ।।
যেই দেশে নাহি শক্তি বিহঙ্গ যাইতে।
সে সকল ভূপে দেব দেখহ সাক্ষাতে।।
নানারত্ন কর লৈয়ে দ্বারে বসি আছে।
বৎসর অবধি হৈল কেহ নাহি পুছে।।
পুত্র-পৌত্র ব্রহ্মার এসেছে কত জন।
প্রপৌত্র আইল যত, কে করে গণন।।
ইন্দ্র চন্দ্র জলেশ কৃতান্ত দিনকর।
ব্রহ্ম-ঋষি দেব-ঋষি আইল বিস্তর।।
চিত্ররথ গন্ধর্ব্ব তুম্বুরু হাহা হুহু।
বিশ্বাবসু আদি সহ বিদ্যাধর বহু।।
যক্ষরাজ সহ এল, কত লব নাম।
আসিয়াছে, আসিতেছে, নাহিক বিরাম।।
দুই এক দিন সবে দ্বারে রহি গেছে।
রাজ-আজ্ঞা-মাত্র সবে দুই এক আছে।।
বিনা আজ্ঞা ছাড়ি দিলে দুঃখ পাই পাছে।
রাজদ্রোহী কর্ম্মে দেব বহু বিঘ্ন আছে।।
দোষ গুণ বুঝিতে ভীমের অধিকার।
ভীম ক্রোধ করিলে নাহিক প্রতিকার।।
বুঝিয়া করহ দেব যে হয় বিচার।
কি শক্তি আমার, আজ্ঞা বিনা ছাড়ি দ্বার।।
এত শুনি কৃষ্ণ তারে নিন্দিয়া অপার।
ক্রোধ করি চলিলেন পশ্চিম-দুয়ার।।
গোবিন্দ বলেন, রাজা দেখ বিদ্যমান।
পৌত্র হৈয়ে নাহি মারে করিল সম্মান।।
নাহিক উহার দোষ কর্ম্ম এইরূপে।
ইন্দ্র যম ভয় করে ভীমের প্রতাপে।।
অল্প দোষে দেয় দণ্ড, ক্রোধ নিরন্তর।
শ্রুতিমাত্র দেয় শাস্তি, নাহি পরাপর।।
চলহ পশ্চিম-দ্বারে আছে দুর্য্যোধন।
আমা দেখি কদাচ না করিবে বারণ।।
আর কহি বিভীষণ, না হও বিস্মৃতি।
যখন করিব দৃষ্টি ধর্ম্ম-নরপতি।।
ভূমিষ্ঠ হইয়া তুমি প্রণাম করিবে।
নৃপতির আজ্ঞা পেলে তখনি উঠিবে।।
বিভাষণ বলে, প্রভু নহে কদাচন।
নিবেদন করিয়াছি মম বিবরণ।।
পূর্ব্ব হৈতে তব পদে বিক্রীত শরীর।
তব পদ বিনা অন্যে না নোয়াব শির।।

এত শুনি গোবিন্দ ভাবেন মনে মনে।
করিয়াছি কুকর্ম্ম আনিয়া বিভীষণে।।
বিভীষণ যদি দণ্ডবৎ না করয়।
সভাতে পাইবে লজ্জা ধর্ম্মের তনয়।।
এত চিন্তি জগন্নাথ করেন বিচার।
ব্রহ্মা আদি করাব নত, এবা কোন্ ছার।।
যজ্ঞারম্ভ কৈল রাজা আমার বচনে।
আমি যজ্ঞেশ্বর বলি জানে সর্ব্বজনে।।
ব্রহ্মা আদি কৈল যজ্ঞ ব্রহ্মাণ্ড ভিতর।
কোন যজ্ঞ নাহি হবে এ যজ্ঞ উপর।।
এত চিন্তি জগন্নাথ সহ বিভীষণ।
পশ্চিম-দ্বারেতে যান যথা দুর্য্যোধন।।
দুর্য্যোধন নৃপতির দুই অধিকার।
দ্রব্যের ভাণ্ডারী আর রক্ষা করে দ্বার।।
অসংখ্য ভাণ্ডার যেন শোভে গিরিবর।
কনক রজত মুক্তা প্রবাল পাথর।।
অমূল্য কীটজ চীর লোমজ বসন।
কস্তুরী দশন হস্তী শৃঙ্গী অগণন।।
চতুর্দ্দিকে হইতে আসিছে ঘনে ঘন।
আষাঢ় শ্রাবণে যেন হয় বরিষণ।।
দরিদ্র ভিক্ষুক দ্বিজ ভ্ট্ট আদি যত।
বিদুরের সম্মত দিতেছে অনুব্রত।।
যত দ্রব্য আসে, তত দিতেছে সকল।
পুনঃ পুনঃ আসে যেন জোয়ারেরজল।।
কত জনে কত দেয়, নাহি পরিমাণ।
অদরিদ্রা কৈল পৃথ্বী দিয়া বহু দান।।
ঊনশত ভাই সহ নিজ পরিবার।
দুর্য্যোধন দ্বারী রাখে পশ্চিম দুয়ার।।
গোবিন্দেরে নিরখিয়া বলে দুর্য্যোধন।
কহ কোন্ হেতু দাণ্ডাইয়া নারায়ণ।।
গোবিন্দ বলেন, ইনি লঙ্কার ঈশ্বর।
যাইতে নিবারে কেন তোমার কিঙ্কর।।
দুর্য্যোধন বলে, কৃষ্ণ নাহি তার দোষ।
আপনি জানহ প্রভু ভীমের আক্রোশ।।
হেথা দেখ জগন্নাথ দ্বারেতে আছয়।
পশ্চিম-দিকেতে বৈসে যত রাজচয়।।
শিরসি দেশের রাজা দেখহ রোহিত।
শতসংখ্য রাজা আছে ইহার সহিত।।
পঞ্চকোটি হস্তী সঙ্গে দশ-কোটি রথ।
যার সৈন্য যুড়িয়াছে দশ ক্রোশ পথ।।
নানা যান করিয়া বিবিধ রত্ন লৈয়া।
দ্বারেতে আছয়ে সব বারিত হইয়া।।
মালব-ঈশ্বর শিবি পুষ্কর নৃপতি।
পঞ্চশত রাজা আছে দোঁহার সংহতি।।
এক কোটি রথ আর গজ কোটি সাত।
কত অশ্ব আছে কেবা করে দৃষ্টিপাত।।
নানাবর্ণ রত্ন লৈয়ে দুয়ারেতে আছে।
মাস দুই তিন হৈল কেহ নাহি পুছে।।
দ্বারপাল রাজা আর রাজা বৃন্দারক।
প্রতিবিন্ধ্যা নরপতি অমর কণ্টক।।
এ সবার সঙ্গে রাজা শত পঞ্চশত।
লিখনে না যায় যত জগ বাজী রথ।।
চারি জাতি প্রজা এল নানা কর লৈয়া।
দ্বারেতে আছয়ে সবে বারিত হইয়া।।
চিত্রসেন রাজা দেখ গন্ধর্ব্ব-ঈশ্বর।
ত্রিশ-কোটি রথ ত্রিশ-কোটি যে কুঞ্জর।।
নানারত্ন আনিল নাহিক তার ওর।
এ সবার পাছে যেন দাণ্ডাইযা চোর।।
বসুদেব সহ আসে যত যদুবীর।
শল্য মদ্রেশ্বের যে মাতুল নৃপতির।।
আজ্ঞা পেয়ে মাদ্রীপুত্র লইল ভিতরে।
তথাপিও দুই দিন রহিলেন দ্বারে।।
আসিবা মাত্রেতে লয়ে চাহ যাইবার।
আজ্ঞা বিনা কিরূপেতে দ্বারী ছাড় দ্বার।।
এইক্ষণে আসিবেক মাদ্রীর নন্দন।
ক্ষণমাত্র হেথায় বৈসহ নারায়ণ।।
এত বলি দুর্য্যোধন দিল সিংহাসনে।
দুই সিংহাসনে বসিলেন দুই জন।।
কে বুঝিতে পারে জগন্নাথের চরিত।
অখিল ব্রহ্মাণ্ড যাঁর মায়ায় মোহিত।।
ধন্য রাজা ইন্দ্রদ্যুন্ন, জন্ম শুভক্ষণে।
হেন প্রভু বশ কৈল আপনার গুণে।।
ধন্য ধন্য অশ্বমেধ কৈল শত শত।
কঠোর তপস্যা, রাজা ধন্য কৈল কত।।
কেহ যজ্ঞ ব্রত করে বৈভব কারণ।
ইন্দ্রপদ বাঞ্ছে কেহ কুবেরের ধন।।
তিন লোক মধ্যে ইন্দ্রদ্যুন্নেরে বাখানি।
কত ইন্দ্রপদ যার কর্ম্মের নিছনি।।
যাহার যশের গুণে পূরিল সংসার।
ক্ষিতিমধ্যে খণ্ডাইল যম-অধিকার।।
যাবৎ ব্রহ্মাণ্ড আর যাবৎ ধরণী।
করিল অদ্ভুত কীর্ত্তি নিস্তারিতে প্রাণী।।
গোহত্যা স্ত্রীহত্যা আদি করে যে নারকী।
অবহেলে স্বর্গে যায় কৃষ্ণ-মুখ দেখি।।
জন্মে জন্মে কাশী আদি নানাতীর্থ সেবে।
তপঃক্লেশ যজ্ঞ ব্রত সদা করে যবে।।
পঞ্চ মহাপাতকী শ্রীমুখ যদি দেখে।
সে কোটি কল্পের পাপ শরীরে না থাকে।।
শ্রীমুখ না দেখে যেবা থাকিতে নয়ন।
সংসারেতে নর-জন্ম তার অকারণ।।
জগন্নাথ না দেখে যেবা থাকিতে নয়ন।
সংসারেতে নর-জন্ম তার অকারণ।।
জগন্নাথ-মুখপদ্ম যে করে দর্শন।
জগন্নাথ নাম যেবা করয়ে স্মরণ।।
পৃথিবীর মধ্যে তাঁর সফল জীবন।
কাশীরাম প্রণময় তাঁহার চরণ।।