২৩. ভীষ্ম কর্ত্তৃক শ্রীকৃষ্ণের প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ

রথী মহারথিগণ,                আশোয়ার অগণন,
পাণ্ডবের যতেক বাহিনী।
সহদেব নকুলাদি,                অভিমন্যু যথাবিধি,
চক্রবক্র ভীম মহামণি।।
নানাবিধ অস্ত্রগণ,                ক্রোধে করে বরিষণ,
শেল শূল মুষল মুদগর।
বিষ্ণুচক্র ব্রহ্মজাল,                যেন বাণ রুদ্রকাল,
নিরন্তর ভীষ্মের উপর।।
বরিষার জলধার,                বরিষে পর্ব্বতোপর,
ততোধিক ফেলে অস্ত্রগণ।
নাহিক সন্দেহ মনে,                সিংহ যেন মৃগগণে,
দিব্য অস্ত্র লৈল ততক্ষণ।।
মহাবল গঙ্গাসুত,                এড়ে অস্ত্র যূথে যূথ,
আকর্ণ টানিয়া শরাসন।
অস্ত্রে অস্ত্রে ততক্ষণ,                কাটি কৈল খান খান,
বাণে যেন ভাঙ্গে ঘোর ঘন।।
বশিষ্ঠের শিক্ষা বাণ,                পুনরপি সুসন্ধান,
ক্রোধদৃষ্টে করে বরিষণ।
নিমিষেক শরজালে,                সৈন্যে যেন বর্ষে ব্যালে,
অন্ধকার করিল গগন।।
রথী মহারথিগণ,                পদাতিক অগণন,
শর হানি কৈল খণ্ড খণ্ড।
মধ্যদেশে কোন বীর,                মুকুট সহিত শির,
বাণে কাটি পাড়ে ধ্বজদণ্ড।।
কাহার কাটিল হাত,                দন্তিদন্ত শুণ্ড সাথ,
চারিপদ কত অশ্বগণ।
ছত্র দণ্ড রথ ধ্বজ,                মাহুত সহিত গজ,
দুই পদ কাটে কত জন।।
রণমধ্যে রথ পড়ে,                পাকা তাল যেন ঝড়ে,
আশোয়ার পত্তি অগণন।
নানা অস্ত্র হাতে আছে,                রণভূমে কালী নাচে,
দেখি ভয় পাইল পাণ্ডুগণ।।
সহিতে না পারি রণ,                ভঙ্গ দিল সর্ব্বজন,
প্রশংসিয়া গঙ্গার নন্দন।
সৈন্যগণ ভঙ্গ দেখি,                ধনঞ্জয় বলে ডাকি,
শীঘ্র রথ লহ নারায়ণ।।
যথা আছে পিতামহ,                শীঘ্রগতি রথ লহ,
আজি তারে করিব নিধন।
দেখ দেখি জনার্দ্দন,                যত মহাবীরগণ,
পরাজিল গঙ্গার নন্দন।।
কেহ অগ্রে স্থির নহে,                মৃগ যেন সিংহ ভয়ে,
রণে ভঙ্গ দিল সর্ব্বজন।।
ভাঙ্গিল ব্যূহের সেনা,                হত খৈল কত জনা,
অস্থির করিল সৈন্যগণ।।
আজ্ঞামাত্র দামোদর,                রথ লৈল শীঘ্রতর,
অতিবেগে ভীষ্মের অগ্রেতে।
হাসি ভীষ্ম হর্ষময়,                দেখি কৃষ্ণ মহাশয়,
দিব্য অস্ত্র লইল করেতে।।
দোঁহাকার দোঁহে বাণ,                কাটি করে খান খান,
দেখিয়া বিস্ময় সুরগণ।
হৈয়া অতি ক্রোধমন,                এড়ে ভীষ্ম অস্ত্রগণ,
সহিতে না পারে কৃষ্ণার্জ্জুন।।
শেল শূল শক্তি জাঠি,                ভল্ল বাণ কোটি কোটি,
নারাচ পরিঘ অগণন।
বিষ্ণুচক্র ব্রহ্মজাল,                রুদ্রশেল অস্ত্র কাল,
ক্রোধে ভীষ্ম করে বরিষণ।।
না চলয়ে রথখান,                কৃষ্ণ পাইল অপমান,
কাতর হইল ধনঞ্জয়।
গুণ টানি বীরবর,                মারে অস্ত্র দোঁহাপর,
না পারয়ে পার্থ ধনুর্দ্ধর।।
পার্থ পেয়ে অপমান,                ইন্দ্রদত্ত নিয়া বাণ,
গাণ্ডীবেতে সন্ধান পূরিল।
আকাশে উঠিল বাণ,                কুরুগণ কম্পমান,
ধনু কাটি ভীষ্মেরে বিন্ধিল।।
আর ধনু লয়ে বীর,                শীঘ্রহস্ত রণে স্থির,
মহাবল শান্তনু-নন্দন।
শুন দিয়া ধনুকেতে,                দিব্য শর লৈল হাতে,
সেই ধনু কাটিল অর্জ্জুন।।
ভৃগুপতিদত্ত বাণ,                শত্রুঞ্জয় অনুপাম.
টঙ্কারিতে হরে রিপু-দর্প।
ঝাঁকে ঝাঁকে অস্ত্রগণে,                পার্থে করে বরিষণ,
ভয়ঙ্কর যেন কাল সর্প।।
সর্ব্বাঙ্গে ফুটিল শর,                মোহ গেল পার্থবর,
অবসর পাইয়া ভীষ্ম বীর।
দিব্য বাণ পূরি তন্ত্র,                অভিষেক করি মন্ত্র,
বিন্ধিলেক কৃষ্ণের শরীর।।
হাসে ভীষ্ম মহামতি,                ভয় পাইলা জগৎপতি,
সর্ব্বাঙ্গে ফুটিল মহাশর।
তথাপি ভ্রুক্ষেপ নহে,                সর্ব্বাঙ্গে রুধির বহে,
মনে চিন্তে দেবকী-কোঙর।।
প্রায় বুঝি ভীষ্মহাতে,                আজিকার সংগ্রামেতে,
সর্ব্ব সৈন্য হইল নিধন।
আপনি করিয়া রণ,                যদি মারি কুরুগণ,
রাম-বাক্য হয়ত লঙ্ঘন।।
পূর্ব্বে মোর অঙ্গীকার,                অর্জ্জুনের রণভার,
প্রকারে মারিব কুরুগণে।
অনেক প্রকার কৈনু,                ভীষ্মে তবু না পারিনু,
সংহার করিতে মহারণে।।
ধর্ম্মভয় খণ্ডি রণে,                যদি মারি কুরুগণে,
রামবাক্য হয়ত লঙ্ঘন।
চিন্তিয়া ত চিন্তামণি,                কৈল ঘোর শঙ্খধ্বনি,
অস্থির হইল কুরুগণ।।
রাখিলে রামের ভাষ,                পাণ্ডুপুত্র হয় নাশ,
না দেখি যে ইহার উপায়।
ভাঙ্গিব ধর্ম্মের সেতু,                শরণ রক্ষণ হেতু,
সংহারিব গঙ্গার তনয়।।
এত ভাবি মনে মন,                অতি ক্রোধে জনার্দ্দন,
লাফ দিয়া নামে রথ হৈতে।
ত্রিলোকের নাথ হরি,                ক্রোধে রথচক্র ধরি,
বেগে ধায় ভীষ্মেরে মারিতে।।
বিশ্বম্ভরূপ হরি,                দেখি কুরু-অধিকারী,
হাত হৈতে খসে শরাস।
ভাবে পুলকিত বপু,                নিরখিয়া মধুরিপু,
করযোড়ে করয়ে স্তবন।।
জয় জয় নারায়ণ,                পূর্ণব্রহ্ম সনাতন,
নমো জয় বিধাতার ধাতা।
পুরুষ প্রকৃতি পর,                ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বর,
তিনরূপধারী জগৎকর্ত্তা।।
সংহার পালন স্থিতি,                নমস্তে শ্রীজগৎপতি,
দুষ্টধ্বংস শিষ্টের পালন।
তুমি সূর্য্য দিবাকর,                তুমি যত দণ্ডধর,
যক্ষপতি জলেন্দ্র পালন।।
দুর্জ্জয় রাক্ষস যক্ষ,                কীট পতঙ্গাদি পক্ষ,
সর্ব্বভূতে তুমি অনুরূপ।
ইন্দ্র আদি বায়ু শিব,                চরাচর যত জীব,
কেহ নহে তোমার বিরূপ।।
তুমি কান্ত তুমি মায়া,                ত্রিজগৎ তব কায়া,
তুমি উগ্র নিগ্রহ বিগ্রহ।
তুমি স্থল, তুমি শূন্য,                জগন্নাথ জগজ্জন্য,
জলে স্থলে চতুর্ব্বাণ দেহ।।
আকাশ মস্তক বর,                পৃথিবী চরণতল,
সুমেরুর শৃঙ্গ মধ্যস্থল।
তুমি সূক্ষ্ম দেহ ধর,                বিশ্বম্ভর কলেবর,
সপ্তসিন্ধু তব পদ জল।।
এইরূপে বহু স্তুতি,                কৈল ভীষ্ম মহামতি,
সদয় হইলা জনার্দ্দন।
চিত্রের পুত্তলী প্রায়,                রহিলেন যদুরায়,
আগু হৈতে না চলে চরণ।।
পুনঃ ভীষ্ম বীরমণি,                যুড়িয়া উভয় পাণি,
ডাকি বলে দেবকী কুমারে।
হোক মোর স্বর্গপতি,                পার্থ পাবে অব্যাহতি,
শীঘ্রগতি কাটহ আমারে।।
এত বলি ভীষ্ম বীর,                বাড়াইয়া দিল শির,
অধোমুখ হৈল মহাশয়।।
দেখিয়া কৃষ্ণের ক্রোধ,                শীঘ্র করিবারে রোধ,
রথ হৈতে নামে ধনঞ্জয়।।
শত পদ অন্তরেতে,                ধরিল কৃষ্ণের হাতে,
শীঘ্রগতি ইন্দ্রের নন্দন।
সম্বর সম্বর ক্রোধ,                অখিল ভুবন নাথ,
জগৎকর্ত্তা দেব নারায়ণ।।
পূর্ব্বেতে তোমার আগে,                গঙ্গাপুত্র মহাভাগে,
প্রতিজ্ঞা করিনু সংহারিতে।
এত বলি ধনঞ্জয়,                প্রবোধিয়া দয়াময়,
ক্রোধ ত্যজি উঠিলা রথেতে।।
হাতে করি ধনুঃশর,                রণস্থলে বীরবর,
পূর্ব্বাপর লাগিল যুঝিতে।
আকর্ণ পূরিয়া ধনু,                বিন্ধিল ভীষ্মের তনু,
নানা অস্ত্র লইয়া করেতে।।
পুনরপি ভীষ্মার্জ্জুন,                হৈল দোঁহে মহারণ,
শরজালে ছাইল গগন।
মুষল মুদগর আদি,                শক্তি শূল নানাবিধি,
দোঁহে বর্ষে হৈয়া ক্রোধমন।।
হেনকালে গগনেতে,                দিনকর অস্তগতে,
দেখি সবে যুদ্ধ নিবর্ত্তিল।
দুর্য্যোধন দুঃখ চিতে,                চলি গেল শিবিরেতে,
পাণ্ডুপুত্র নিজ গৃহে গেল।।
মহাভারতের কথা,                ব্যাস বিরচিত গাথা,
শ্রবণেতে পাপ হয় নাশ।
হৃদয়ে চিন্তিয়া হরি,                পয়ার রচনা করি,
বিরচিল কাশীরাম দাস।।