২৩২. দ্রৌপদী-সত্যভামাসংবাদ পর্বাধ্যায়

২৩২তম অধ্যায়

দ্রৌপদী-সত্যভামাসংবাদ পর্ব্বাধ্যায়

বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহাত্মা পাণ্ডবগণ ও বিপ্ৰ-সমুদয় আশ্রমমধ্যে সুখে সমাসীন হইয়া আছেন, এমত সময়ে দ্রৌপদী ও সত্যভামা, তথায় প্রবেশ করিলেন। পরস্পর প্ৰিয়বাদিনী সেই কামিনীদ্বয় বহু দিবসের পর পরস্পর সাক্ষাৎকার লাভ করিয়া পরমপ্রফুল্লচিত্তে উপবেশনপূর্ব্বক কুরু ও যদুবংশ-সংক্রান্ত নানাবিধ কথােপকথন করিতে লাগিলেন। কিয়ৎক্ষণ পরে কৃষ্ণপ্রিয়া সত্যভামা একান্তে বসিয়া যজ্ঞসেনাকে কহিলেন, “হে দ্রৌপদী! তুমি লোকপালসদৃশ সুদৃঢ়-কলেবর মহাবীর পাণ্ডবগণের সহিত কিরূপ ব্যবহার করিয়া থাক? তাহারা যে কখনই তোমার প্রতি ক্রোধান্বিত হয়েন না, প্রত্যুত ঈদৃশ বশীভূত হইয়াছেন যে, তোমা ভিন্ন আর কাহাকেও মনে করেন না, ইহার কারণ কি ? সোমবারাদি ব্ৰতচৰ্য্যা, উপবাসাদিরূপ তপ, সঙ্গমাদিতে স্নান, মন্ত্র, ঔষধ, কামশাস্ত্রোক্ত বশীকরণবিদ্যা, অচ্যুত তারুণ্যাদি, জপ, হোম, বা অঞ্জনাদি ঔষধ, ইহার কোন উপায়ের প্রভাবে পাণ্ডবগণ তোমার এতাদৃশ বশীভূত হইয়াছেন? হে পাঞ্চালি! এক্ষণে তুমি আমাকে এরূপ কোন যশস্য ও সৌভাগ্যজনক উপায় বল, যদ্বারা আমি কৃষ্ণকে নিরন্তর বশীভূত করিয়া রাখিতে পারি।”

সত্যভামার প্রতি দ্রৌপদীর পাতিব্ৰত্যকথন

যশস্বিনী সত্যভামা এই কথা বলিয়া বিরত হইলে পর পতিব্ৰতা দ্রৌপদী তাঁহাকে কহিতে লাগিলেন, “হে সত্যভামে! তুমি আমাকে যেরূপ ব্যবহারের বিষয় জিজ্ঞাসা করিলে, অসৎ স্ত্রীগণই ঐ রূপ আচার করিয়া থাকে; অতএব কিরূপে উহার উত্তর প্রদান করিব? তুমি বুদ্ধিমতী, বিশেষতঃ কৃষ্ণের মহিষী, ঈদৃশ বিষয়ে সংশয় বা প্রশ্ন করা তোমার উচিত নহে। দেখ, স্বামী পত্নীকে মন্ত্রপরায়ণ জানিতে পারিলে গৃহস্থিত-সৰ্পের ন্যায় তাহার নিমিত্ত সতত উদ্বিগ্ন থাকে। উদ্বিগ্ন ব্যক্তির শান্তি নাই, অশান্ত লোক কখনই সুখলাভ করিতে সমর্থ হয় না। হে ভদ্রে! স্বামী কদাচ মন্ত্রদ্বারা বশীভূত হয়েন না। জিঘাংসু ব্যক্তিরাই উপায়দ্বারা শত্রুর রোগোৎপাদন বা তাহাকে বিষ প্ৰদান করিয়া থাকে। লোকে জিহ্বা বা ত্বকদ্বারা যে-সমস্ত বস্তু সেবন করে, তৎসমুদয়ে চূৰ্ণবিশেষ মিশ্ৰিত করিয়া প্ৰদান করিলে অবশ্যই প্রাণসংহার হয়।

অনেক পাপপরায়ণ কামিনীগণ স্বামীদিগকে বশ করিবার নিমিত্ত ঔষধ প্ৰদান করায় তাহাদিগের মধ্যে কেহ জালোদরগ্ৰস্ত, কেহ বা কুষ্ঠী, কেহ বা পলিত, কেহ বা পুরুষত্বরহিত, কেহ বা জড়, কেহ বা অন্ধ, কেহ বা বধির হইয়া গিয়াছে। হে বরবর্ণিনি! কামিনীগণের কদাপি স্বামীর বিপ্ৰিয়াচরণ কর্ত্তব্য নহে।

“হে সত্যভামে! আমি মহাত্মা পাণ্ডবগণের প্রতি যেরূপ ব্যবহার করিয়া থাকি, তাহা কহিতেছি, শ্রবণ কর। আমি কাম, ক্ৰোধ ও অহঙ্কার পরিহারপূর্ব্বক সতত পাণ্ডবগণ ও তাঁহাদের অন্যান্য স্ত্রীদিগের পরিচর্য্যা করিয়া থাকি। অভিমান পরিহারপূর্ব্বক প্ৰণয় প্রকাশ করিয়া অনন্যমনে পতিগণের চিত্তানুবর্ত্তন করি। দুর্ব্বাক্য প্রয়োগ ও দূরবেক্ষণে সতত শঙ্কিত থাকি, কদাপি দ্রুতপদসঞ্চারে মন্দরূপে গমন বা কুৎসিতরূপে উপবেশন করি না এবং সেই সূৰ্য্যসম তেজস্বী অরতিনিপাতন মহারাথ পাণ্ডবগণের ইঙ্গিতজ্ঞ হইয়া সতত সেবা করি। কি দেব, কি গন্ধর্ব্ব, কি পরমসুন্দর অলঙ্কৃত যুবা-মানব, কাহাকেও মনে স্থান প্রদান করি না। ভর্ত্তৃগণ স্নান, ভোজন ও উপবেশন না করিলে কদাপি আহার বা উপবেশন করি না। ভর্ত্তা ক্ষেত্ৰ, বন বা গ্রাম হইতে গৃহে আগমন করিলে তৎক্ষণাৎ গাত্ৰোত্থানপূর্ব্বক আসন ও উদকপ্রদানদ্বারা তাঁহার অভিনন্দন করি।

“আমি প্রত্যহ উত্তমরূপে গৃহপরিষ্কার, গৃহোপকরণ-মার্জ্জন, পাক, যথাসময়ে ভোজন প্ৰদান ও সাবধানে ধান্য রক্ষা করিয়া থাকি। দুষ্টা স্ত্রীর সহিত কখন সহবাস করি না; তিরস্কারবাক্য মুখেও আনি না; সকলের প্রতি অনুকূল ও আলস্যশূন্য হইয়া কালব্যাপন করি। পরিহাসসময় ব্যতীত হাস্য এবং দ্বারে বা অপরিষ্কৃত স্থানে কিংবা গৃহোপবনে সতত বাস করি না। অতিহাস ও অতিরোষ পরিত্যাগপূর্ব্বক সত্যে নিরত হইয়া নিরন্তর ভর্ত্তৃগণের সেবা করিয়া থাকি; তাঁহাদিগকে অবলোকন না করিয়া একমুহূর্ত্তও সুখী থাকি না। স্বামী কোন আত্মীয়ের নিমিত্ত প্রোষিত [স্থানান্তরিত।] হইলে পুষ্প ও অনুলেপন পরিত্যাগপূর্ব্বক ব্ৰতানুষ্ঠান করি। ভর্ত্তা যে যে দ্রব্য পান, সেবন বা ভোজন না করেন, আমিও তৎসমুদয় তৎক্ষণাৎ পরিত্যাগ করি। উপদেশানুসারে অলঙ্কৃত ও প্ৰযত্ন হইয়া স্বামীর হিতানুষ্ঠানসাধন করিয়া থাকি।

“আমার শ্বশ্রূ কুটুম্ববিষয়ে আমাকে যে-সমুদয় ধর্ম্মোপদেশ প্ৰদান করিয়াছেন এবং ভিক্ষা, বলি, শ্ৰাদ্ধ, পর্ব্বাহে স্থালীপাক ও মান্যগণের পূজা প্রভৃতি যে সকল কর্ম্ম আমার মনে জাগরকে আছে, আমি অতীন্দ্ৰিত-চিত্তে দিবারাত্র তৎসমুদয় পালন করি। আমি প্ৰযত্নাতিশয় সহকারে সর্ব্বদা বিনয় ও নিয়ম অবলম্বন এবং মৃদু, সত্যশীল, সাধু ও ধর্ম্মপালক পতিগণকে ক্রুদ্ধসৰ্প-সমূহের ন্যায় জ্ঞান করিয়া পরিচর্য্যা করিয়া থাকি।

“হে ভদ্রে! আমার মতে পতিকে আশ্রয় করিয়া থাকাই স্ত্রীদিগের সনাতন ধর্ম্ম। পতিই নারীর দেবতা ও একমাত্র গতি; তজন্য তাঁহার বিপ্রিয়ানুষ্ঠান করা নিতান্ত গৰ্হিত। আমি পতিগণকে অতিক্ৰম করিয়া শয়ন, আহার বা অলঙ্কার পরিধান করি না এবং প্রাণান্তেও শ্বশ্রূর নিন্দায় প্রবৃত্ত হই না। হে শুভে! সতত সাবধানতা, কাৰ্য্যদক্ষতা ও গুরুশুশ্রূষা-সন্দর্শনে স্বামীগণ আমার বশীভুত হইয়াছেন।

“হে সত্যভামো! আমি প্রত্যহ বীরপ্রসবিনী আৰ্য্যা কুন্তীকে স্বয়ং অন্নপান ও আচ্ছাদন-প্ৰদানদ্বারা সেবা করি; কদাপি উঁহার অপেক্ষা উৎকৃষ্ট ভােজন বা বসন-ভূষণ পরিধান করি না। পূর্ব্বে মহারাজ যুধিষ্ঠিরের নিকেতনে প্রত্যহ অষ্টসহস্র ব্রাহ্মণ রুক্মপাত্রে ভোজন করিতেন এবং যাঁহাদিগের প্রত্যেকের সমভিব্যাহারে ত্রিংশৎ কর্ম্মচারী পরিচর্য্যায় নিযুক্ত ছিল, এমন অষ্টাশীতিসহস্র গৃহমেধী স্নাতক প্রতিদিন প্রতিপালিত হইতেন। অপর দশসহস্র স্নাতকের নিমিত্ত প্রত্যহ স্বর্ণপাত্ৰসমুদয় সুসংস্কৃত অন্নে পরিপূর্ণ থাকিত। আমি ঐ সমুদয় ব্রাহ্মণগণকে অন্নপান ও আচ্ছাদন প্রদানপূর্ব্বক সমুচিত সৎকার করিলাম।

“মহাত্মা যুধিষ্ঠিরের নৃত্যগীতবিশারদ শতসহস্ৰ দাসী ছিল; তাহারা মহার্হ মাল্য ও চন্দনে বিভূষিত এবং সর্ব্বদা বলয়, কেয়ূর, নিষ্ক ও মণি প্রভৃতি অলঙ্কারে অলঙ্কৃত হইয়া থাকিত। আমি তাহাদের সকলেরই নাম, রূপ ও কৃতকৃত কর্ম্মসমুদয় জ্ঞাত ছিলাম এবং তাহাদিগকে অন্ন, পান ও আচ্ছাদন প্ৰদান করিতাম। সেই সকল দাসীরা পাত্র হস্তে লইয়া দিবারাত্র অতিথিগণকে ভোজন করাইত। ইন্দ্ৰপ্ৰস্থবাসকালে শতসহস্ৰ অশ্ব ও দশ-অযুত হস্তী যুধিষ্ঠিরের অনুযাত্রী ছিল।

আমি তৎসমুদয় অন্তঃপুরস্থ ভৃত্যগণ, গোপালগণ ও মেষপালগণের তত্ত্বাবধান করিতাম। হে ভদ্রে! আমি একাকিনী মহারাজের সমুদয় আয়ব্যয়ের বিষয় অবগত ছিলাম। পাণ্ডবগণ আমার উপর সমুদয় পোষ্যবর্গের ভার অর্পণ করিয়া ধর্ম্মানুষ্ঠানে নিরত হইতেন, আমি সমুদয় সুখ পরিহার করিয়া দিবারাত্র সেই দুর্ব্বহ ভার বহন করিতাম। আমি একাকিনী জলনিধির ন্যায় নিধিপূৰ্ণ কোষাগারের তত্ত্বাবধান করিতাম; দিবা ও রাত্রি সমান জ্ঞান এবং ক্ষুধাতৃষ্ণাকে সহচরী করিয়া সতত পাণ্ডবগণের আরাধনা করিতাম। আমি সর্ব্বাগ্রে প্রতিবোধিত ও সর্ব্বশেষে শয়ান হইতাম এবং সতত সত্য-ব্যবহারে রত থাকিতাম। হে সত্যভামে! আমি পতিগণকে বশীভূত করিবার এই মহৎ উপায় জানি, কিন্তু অসদাচার কামিনীগণের ন্যায় কদাচ কুব্যবহার করি না, তাহা করিতে অভিলাষও করি না।”

সত্যভামা ধর্ম্মচারিণী পাঞ্চালরাজতনয়ার এইরূপ ধর্ম্মসংযুক্ত বাক্য শ্রবণানন্তর তাঁহাকে কহিলেন, “হে যজ্ঞসেনি! আমার অপরাধ হইয়াছে, ক্ষমা কর; সখীজনের পরিহাসবাক্য স্বভাবতঃ প্রায়ই এইরূপ হইয়া থাকে, তাহাতে ক্ৰোধ বা দুঃখ করা উচিত নয়।”