২২৩. খাণ্ডবদাহার্থ অর্জুনসকাশে অগ্নির আগমন

২২৩. খাণ্ডবদাহার্থ অর্জুনসকাশে অগ্নির আগমন, খাণ্ডববনের ইতিহাস—শ্বেতকিবৃত্তান্ত, শ্বেতকির দীর্ঘকালসাধ্য যজ্ঞ, রুদ্রানুরোধে দুর্বাসার যজ্ঞে বরণ, বহু ঘৃত ভক্ষণে অগ্নির অগ্নিমান্দ্য, খাণ্ডবারণ্য দাহ

ত্রয়োবিংশত্যধিকশিততম অধ্যায়।

ব্রাহ্মণ অসন পরিগ্রহানন্তর মানবশ্রেষ্ঠ বাসুদেব ও অর্জুনকে কহিলেন, আমি ব্রাহ্মণ, অধিক আহার করিয়া থাকি এবং সর্বদাই অপরিমিত ভোজন করি; অতএব আপনাদের নিকটে ভিক্ষা প্রার্থনা করিতেছি, আপনারা আমার প্রার্থনা সফল করুন। ব্রাহ্মণ এইরূপ প্রার্থনা করিলে কৃষ্ণ ও পাণ্ডব তাঁহাকে কহিলেন, আপনি নানাবিধ অম্নের মধ্যে কি প্রকার অন্ন প্রার্থনা করেন, বলুন; আমরা তাহা আহরণ করিতে যত্নবান হই। ব্রাহ্মণ এইরূপ অভিহিত হইয়া কহিলেন, আমি অন্ন ভোজন করি না; আমি অগ্নি, অতএব আমার অনুরূপ অন্ন প্রদান করুন। ইন্দ্রের সখা পন্নগরাজ তক্ষক স্বীয় পরিবারবর্গের সহিত খাণ্ডবনে বাস করে। বজ্রভৃৎ ইন্দ্র ঐ খাণ্ডববন সর্বদাই রক্ষা করিয়া থাকেন। আমি তাহার প্রভাবে খাণ্ডববন দগ্ধ করিতে পারি না। ইন্দ্র আমাকে প্রজ্বলিত দেখিলেই মুষলধারে জলবর্ষণ করিতে থাকেন, তন্নিমিত আমার অভিলষিত খাণ্ডবদাহ, সম্পন্ন করিতে পারিতেছি না। অতএব আপনাদের নিকটে এই ভিক্ষা প্রার্থনা করি যে, আপনারা আমার সহায় হইয়া অস্ত্রধারণপূর্বক উদকধারা ও তত্রস্থ ইসম্বন্ধীয় প্রাণিগণকে নষ্ট করুন, তাহা হইলে আমি খাণ্ডববন দগ্ধ করিতে সমর্থ হই।

জনমেজয় কহিলেন, “ভগবান্ হব্যবাহন যে নিমিত্ত অতিশয় ক্রুদ্ধ হইয়া মহেন্দ্রকর্তৃক রক্ষ্যমান নানাসত্ত্বসমাকুল খাণ্ডববন দগ্ধ করতে অভিলাষ করিয়াছিলেন, বোধ হয়, তাহা সামান্য কারণ নহে; অতএব হে দ্বিজবর! আমি সেই বৃতান্ত আদ্যোপান্ত শ্রবণ করিতে অতিষ করি, বর্ণন করুন।

বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! আমি ঋষিগণপ্রশংসিত, খাণ্ডববনদাশ্রিত পৌরাণিকী কথা কীর্তন করিতেছি, শ্রবণ করুন। মহারাজ! শুনিয়া থাকিবেন, পূৰ্বকালে শ্বেতকি নামে মহাবল পরাক্রান্ত এক সুবিখ্যাত ভূপাল ছিলেন। এইরূপ জনশ্রুতি আছে যে, সেই রাজর্ষি অতিশয় যাজ্ঞিক ও বুদ্ধিমান্ ছিলেন। তিনি প্রভূত দক্ষিণ দানপূর্বক যজ্ঞানুষ্ঠান করিতেন। ক্ৰিয়ারম্ভ, যজ্ঞানুষ্ঠান ও বিবিধ ধনদানবিষয়ে প্রতিদিনই তাহার যেরূপ অনুরাগ হইত, অন্য কোন বিষয়েই সেরূপ অনুরাগ জন্মিত না। এইরূপে মহারাজ শ্বেতকি ঋত্বিকগণ সমভিব্যাহারে অনেকানেক যজ্ঞানুষ্ঠান করিয়াছিলেন। অনন্তর ঋত্বিকগণ অনবরত উত্থিত যজ্ঞধুমদ্বারা ব্যাকুল লোচন ও বহুকাল যাজনকাৰ্য্য সমাধানপূর্বক একান্ত খিন্ন হইয়া রাজাকে কহিলেন, আপনি আমাদিগকে পরিত্যাগ করুন। রাজা তাহাদিগকে বিকলনেত্র ও যজ্ঞানুষ্ঠানে নিতান্ত অপটু বিবেচনা করিয়া বিদায় করিলেন এবং তাঁহাদিগের অনুমত্যনুসারে অপরাপর ঋত্বিকগণ সমভিব্যাহারে যজ্ঞকর্ম সমাপন করিলেন।

এইরূপে কিয়ৎকাল অতীত হইলে রাজা শতবর্ষ-ব্যাপী এক দীর্ঘ সত্ৰ আহরণ করিবার নিমিত্ত সেই সমস্ত ঋত্বিগণকে আহ্বান করিলেন, কিন্তু তাঁহারা উপস্থিত হইলেন না। তখন তিনি বন্ধুবান্ধবের সহিত ঋত্বিকগণকে অনুনয় করিতে লাগিলেন। প্রণিপাত, সান্ত্ববাদ ও ধনদানদ্বারা বারংবার তাহাদিগকে অনুনয় করিলেন, তথাচ তাঁহারা রাজার মনোরথ সফল করিলেন না। তখন মহীপাল রোষপরবশ হইয়া আশ্রমবাসী মহর্ষিদিগকে কহি লেন, হে মহর্ষিগণ! যদি আমি পতিত হইতাম এবং আপনাদিগের শুশ্রূষায় নিরত না হইতাম, তাহা হইলে অপনারা ও অন্যান্য ব্রাহ্মণেরা আমাকে ঋণাকরিয়া পরিত্যাগ করিতে পারিতেন; কিন্তু আমি সেরূপ নহি, অতএব মদী যজ্ঞনিষ্ঠার ব্যাঘাত বা অযোগ্য সময়ে আমাকে পরিত্যাগ করা আপনাদিগের বিধেয় নহে। এক্ষণে আমি আপনাদিগের শরণাপন্ন হইয়াছি, প্রস হউন। সামাদ, দাম ও যথার্থ বাক্যদ্বারা আপনাদিগকে প্রসন্ন করিয়া যাহা কর্তব্য, সমুদয় নিবেদন করিব। অথবা যদি বিদ্বেষবশতঃ আপনারা আমাকে পরিত্যাগ করেন, তাহা হইলে আমি যাজনকাৰ্য্য সমাধা করিবার নিমিত্ত অন্যান্য ঋত্বিকগণের নিকট গমন করিব। মহারাজ শ্বেতকি এইকথা বলিয়া মৌনাবলম্বন করিলেন। মহর্ষিগণ রাজার যাজন কাৰ্য্য অস্বীকার করিয়া ক্রোধভরে কহিলেন, মহারাজ! আমরা বহুকালাবধি আপনকার অবিচ্ছিন্ন যজ্ঞকাৰ্যে নিরন্তর দীক্ষিত হইয়া একান্ত ক্লান্ত ও নিতান্ত পরিশ্রান্ত হইয়াছি। এক্ষণে আপনি আমাদিগকে পরিত্যাগ করুন। আপনার নিতান্ত বুদ্ধিবিপৰ্যয় ঘটিয়াছে, এই কারণে আমাদিগকে বারংবার এইরূপ অনুরোধ করিতেছেন। এক্ষণে আপনি রুদ্রদেবসন্নিধানে গমন করুন; তিনিই আপনার যাজন কাৰ্য্য করিবেন।

রাজা মহর্ষিগণের এইরূপ তিরস্কারবাক্য শ্রবণ করিয়া ক্রোধে অধীর হইয়া উঠিলেন, এবং কৈলাসপৰ্বতে গমন করিয়া অতি কঠোর তপস্যার অনুষ্ঠান ও ব্রতোপবাসাদিদ্বারা দেবদেব মহাদেবকে আরাধনা করত সুদীর্ঘকাল বাস করিতে লাগিলেন। তিনি কখন দ্বাদশ দিবসে, কখন ষোড়শ দিবসে বন্য ফল মুল আহার করিতেন, কখন বা উৰ্দ্ধবাহু হইয়া ছয় মাস অনিমেষলোচনে নিশ্চল স্থাণুর ন্যায় অবস্থান করিতেন। ভগবান চন্দ্রশেখর রাজার এইরূপ অতি কঠোর তপস্যায় প্রীত ও প্রসন্ন হইয়া তথায় আবির্ভূত হইয়া ভূপালকে কহিলেন, মহারাজ! আমি তোমার তপস্যায় অতিশয় প্রীত হইয়াছি; তোমার মঙ্গল হউক। এক্ষণে স্বেচ্ছানুসারে বর প্রার্থন, কর। রাজর্ষি রুদ্রের এইরূপ কথা শুনিয়া প্রণিপাতপূর্বক কহিলেন, ভগব। আপনি সর্বজন-পূজিত, এক্ষণে যদি প্রসন্ন হইয়া থাকেন, তবে আপনি স্বয়ং আমার, যাজন কাৰ্য্য সমাধা করিবেন, এই বর প্রদান করুন। ইহা শুনিয়া ভগবান্ উমাপতি প্রীতমনে ও সস্মিতবচনে কহিলেন, মহারাজ! যজ্ঞ কার্য্য করিতে পারে, এমন লোক এই প্রদেশ কাহাকেও দেখি না। তুমিও আমার নিকট বরার্থী হইয়া অতি কঠোর তপোনুষ্ঠান করিয়াছ; কিন্তু আমার সহিত তোমাকে একটি নিয়ম সংস্থাপন করিতে হইবে, যদি তুমি দ্বাদশ বৎসর সমাহিত ও ব্রহ্মচারী হইয়া নিরবচ্ছিন্ন ঘৃতধারাদ্বারা অনলকে পরিতৃপ্ত করিতে পার, তাহা হইলে তুমি আমার নিকট যে বিষয় প্রার্থনা করিবে, তাহা সুসম্পন্ন করিব।

রাজা রুদ্ৰকর্তৃক এইরূপ অভিহিত ও আদিষ্ট হইয়া দ্বাদশ বৎসর ব্রহ্মচৰ্য্য অনুষ্ঠান করিলেন। অনন্তর দ্বাদশ বৎসর সম্পূর্ণ হইলে তিনি পুনরায় ভূতাবন ভগবান্ মহাদেবের নিকটে উপস্থিত হইলেন। মহাদেব রাজাকে দেখিয়া প্রীতমনে কহিলেন, মহারাজ! আমার আজ্ঞা পালন করিয়াছ বলিয়া আমি সাতিশয় সন্তুষ্ট হইলাম, কিন্তু যাজন কার্যে দীক্ষিত হওয়া ব্রাহ্মণদিগেরই বিধেয়, এই কারণে আমি স্বয়ং তোমার যাজন কাৰ্য্য করিতে পারিব না। এই ভূমণ্ডলে দুর্বাসা নামে এক মহর্ষি আছেন, তিনি অতিশয় সুবিখ্যাত ও আমারই অংশভূত। তিনিই তোমার যাজন কার্য সম্পন্ন করিবেন। এক্ষণে স্বনগরে গমন করিয়া যজ্ঞীয়, দ্রব্যসামগ্ৰীসকল আহরণ কর। রাজা ভগবান্ পশুপতির আদেশানুসারে স্বনগরে প্রতিগমনপূর্বক যজ্ঞীয় দ্রব্যজাত আহরণ করিলেন। দ্রব্যসম্ভার সস্তৃত হইলে তিনি পুনরায় রুদ্রসমিধানে উপনীত হইয়া কহিলেন, ভগবন্! যজ্ঞীয় দ্রব্যসম্ভার ও উপকরণ সমস্ত আহৃত হইয়াছে, এক্ষণে আপনি প্রসন্ন হইয়া অনুমতি করিলে আমি পরদিনেই যজ্ঞকার্যে দীক্ষিত হই। রুদ্র রাজার এই কথা কর্ণগোচর করিয়া মহর্ষি দুর্বাসাকে আহ্বানপূর্বক কহিলেন, হে দ্বিজেন্দ্র! এই মহানুভাব ভূপতির নাম শ্বেতকি, আমার নিদেশপ্রযুক্ত তোমাকে ইহার জনক্রিয়া সম্পন্ন করিতে হইবে। মহর্ষি তৎক্ষণাৎ ‘তথাস্তু’ বলিয়া তাঁহার বাক্য স্বীকার করিলেন। অনন্তর যজ্ঞকাৰ্য্য যথাবিধানে আরব্ধ হইল। সেই যজ্ঞ সমাপ্ত হইলে মহর্ষি দুর্বাসার আদেশানুসারে দীক্ষিত যাজক ও সদস্যগণ স্ব স্ব স্থানে প্রস্থান করিলেন।

অনন্তর ভগবান্ হুতাশন বিকৃতভাবাপন্ন ও তেজোহীন হইয়া, ক্রমশঃ গ্লানিযুক্ত হইতে লাগিলেন। তখন তিনি আপনাকে তেজোহীন বিবেচনা করিয়া অতি পবিত্র ও লোকপূজিত ব্ৰহ্মলোকে গমন করিলেন। তথায় মাকে আসনে আসীন দেখিয়া নিবেদন করিলেন, ভগব!, আমি তেজোহীন ও নির্বীৰ্য্য হইয়াছি; এক্ষণে আপনকার অনুকম্পায় পুনরায় স্বীয় নিশ্চলা প্রকৃ%ি প্রাপ্ত হইতে অভিলাষ করি। ইহা শ্রবণ করিয়া ভগবান্ বিশ্বনির্মাতা বিধাতা হাস্যমুখে বহিকে কহিলেন, হে মহাভাগ! তুমি দ্বাদশ বৎসর বসুধারাহুত ঘৃত উপযোগ করিয়াছিলে বলিয়াই এইরূপ গ্লানিযুক্ত হইয়াছ; কিন্তু তেজোহীনতাবশতঃ সহসভগ্নাশ হইও না; তুমি পুনৰ্বাব পূর্ববৎ প্রকৃতি হইবে। পুৰ্বে দেবনিয়োগক্রমে দেবশ অসুরগণের আলয়ভূত যে ভয়ঙ্কর খাদ্যারণ্য দগ্ধ করিয়াছিলে, তথায় নানাবিধ জন্তুগণ বাস করে, তুমি তাহাদিগের মেদোমাংস ভক্ষণে পরিতৃপ্ত হইয়া পুনরায় প্রকৃতিস্থ হইবে। অতএব শীঘ্র যাইয়া খাণ্ডববন দগ্ধ কর, তাহা হইলে অবশ্যই গ্লানিরূপ পাপ হইতে আশু মুক্ত হইতে পারিবে।

হুতাশন ব্রহ্মার মুখে এই কথা শুনিয়া প্রচণ্ডবেগে খাবারণ্যে গমন করিলেন। তথায় উপনীত হইয়া ক্রোধভরে সহসা প্রজ্বলিত হইয়া উঠিলেন, বায়ু তহার সাহায্য করিতে লাগিলেন।, খাণ্ডববন প্রদীপ্ত দেখিয়া তত্ৰত্য প্রাণিগণ দাহশান্তির নিমিত্ত একান্ত যত্নবান হইল। করিযূথ ক্রোধপরবশ হইয়া সত্বরে শুদ্বারা জলানয়নপূর্বক অনলোপরি সেক করিতে লাগিল, বহুশীর্ষ সর্পগণ ক্রোধে মূর্চ্ছিত হইয়া মন্তকারা জলসেক করিতে আরম্ভ করিল এবং অন্যান্য প্রাণিগণও নানাপ্রকার উপায়দারা অনতিকালমধ্যে দাবদাহ শান্তি করিল। বহি ক্রমে ক্রমে সাত বার প্রজ্বলিত হইয়া উঠিলেন, তাহারা সাতবারই নির্বাণ করিল।