২১. হস্তিনায় শ্রীকৃষ্ণের উপস্থিতি

মুনি বলে, শুন কুরুবংশ-চূড়ামণি।
বৃকদেশে রাত্রি বঞ্চি দেব চক্রপাণি।।
প্রাতঃকৃত্য সমাপিয়া আরোহেন রথে।
মেলানি মাগিয়া চলিলেন হস্তিনাতে।।
বিচিত্র মন্দির, পথে পথে নানা বাস।
দেখিয়া বিস্মিত হৈল দেব শ্রীনিবাস।।
কোনখানে মুনিগণ বেদ উচ্চারয়।
কোনখানে বাদ্যকার সুবাদ্য বাজায়।।
নানা রত্ন অলঙ্কার পরি পুষ্পমালা।
কোনখানে শিশুগণ করে নানা খেলা।।
নগরের প্রজাগণ দিব্য বেশ ধরে।
চতুরঙ্গদলে বসিয়াছে পথধারে।।
দেখিয়া কহেন কৃষ্ণ ডাকি সাত্যকিরে।
পূর্ব্বমত নাহি দেখি হস্তিনা নগরে।।
দ্বিতীয় ইন্দ্রের পুরী সম সুশোভন।
বড়ই ধর্ম্মাত্মা দেখি হেথা প্রজাগণ।।
বুঝি এবে ধৃতরাষ্ট্র ধর্ম্মে মতি দিল।
সে কারণে মহোৎসব গীত আরম্ভিল।।
সাত্যকি বলিল, নহে ধর্ম্মের কারণ।
তোমারে পরীক্ষা করিতেছে দুর্য্যোধন।।
লোকমুখে শুনি ভক্তাধীন জনার্দ্দন।
পাণ্ডবের বশ তেঁই ভক্তির কারণ।।
ভক্তিতে পাণ্ডব বশ করিয়াছে তাঁরে।
আমি ভক্তি করি দেখি এবে কিবা করে।।
এমত মন্ত্রণা করি যত কুরুগণ।
যজ্ঞ মহোৎসব করিয়াছে আরম্ভণ।।
ইহা শুনি হাসি হাসি কহে দামোদর।
আমার কপট ভক্তি নহে প্রীতিকর।।
বিড়ম্বিলে মোরে সেই নিজে বিড়ম্বিবে।
এই দোষে যমঘরে অবিলম্বে যাবে।।
এত বলি জগন্নাথ করিলা প্রস্থান।
নগর মধ্যেতে উত্তরিলেন শ্রীমান।।
কৃষ্ণ আগমন শুনি কৌরবের পতি।
আগু বাড়াইয়া গিয়া আনে শীঘ্রগতি।।
নর্ত্তক চারণ আদি গায়কের গণ।
দুঃশাসন সঙ্গে করি আসিল তখন।।
চতুরঙ্গ দলে গিয়া বীর দুঃশাসন।
আগু বাড়াইয়া শীঘ্র আনে নারায়ণ।।
সাত্যকি সহিত কৃষ্ণ আনিল সভাতে।
যথাযোগ্য স্থানে সবে দিলেন বসিতে।।
ভক্তি করি দুর্য্যোধন রত্ন সিংহাসনে।
সভামধ্যে বসাইল দেব নারায়ণে।।
যত দ্রব্য আহরণ করে দুর্য্যোধন।
গোবিন্দের অগ্রে লয়ে দিল সেইক্ষণ।।
অশ্রদ্ধায় যত দ্রব্য করে সমর্পণ।
কোন দ্রব্য না নিলেন তার নারায়ণ।।
প্রসঙ্গ করিয়া কহিলেন জনার্দ্দন।
আজি কোন দ্রব্যে মোর নাহি প্রয়োজন।।
আজি আমি রহি গিয়া বিদুরের বাসে।
কালি রাজা মম পূজা করিহ বিশেষে।।
ইহা বলি সভা হৈতে উঠি নারায়ণ।
সাত্যকির হাত ধরি করেন গমন।।
তবে দুর্য্যোধন রাজা উঠি সভা হৈতে।
কর্ণ দুঃশাসন মাতুলেরে নিল সাথে।।
আনন্দে অমাত্য সহ বসি দুর্য্যোধন।
যুক্তি করে কি উপায় করিব এখন।।
পাণ্ডবের পক্ষ দেখি দেব নারায়ণ।
পাণ্ডবের গতি কৃষ্ণ পাণ্ডব জীবন।।
কৃত্যা করি বান্ধি এবে রাখহ নিবাস।
দন্ত উপাড়িলে যেন ভুজঙ্গ নিরাশ।।
কৃষ্ণ বিনা মরিবেক পাণ্ডু-অঙ্গজনু।
জলহীন মৎস্য যেন নাহি ধরে তনু।।
দুঃশাসন বলে, যুক্তি নিল মোর মন।
গোবিন্দেরে রাখ রাজা করিয়া বন্ধন।।
বলিকে বান্ধিয়া যথা ইন্দ্র ‍রাজ্য করে।
এই কর্ম্মে তব হিত দেখি যে অন্তরে।।
শকুনি বলিল, যুক্তি নিল মোর মন।
এই কর্ম্মে সব সুখ দেখি যে রাজন।।
পূর্ব্বাপর শাস্ত্রমত আছে হেন নীত।
ছলে বলে শত্রুকে না ক্ষমিতে উচিত।।
তোমার পরম শত্রু পাণ্ডুর নন্দন।
তার অনুগত হয় দেব নারায়ণ।।
তারে কৃত্যা করি দোষ নাহিক ইহাতে।
বন্ধন করিয়া কৃষ্ণে রাখহ ত্বরিতে।।
কর্ণ বলে, ভাল বলে গান্ধার-নন্দন।
এই কর্ম্মে তব সুখ হইবে রাজন।।
কিন্তু বলভদ্র আদি যত যদুগণ।
পাছে আসি যুদ্ধ করে জানিয়া কারণ।।
পাণ্ডবের পক্ষ হবে যত যদুগণ।
গোবিন্দ বিচ্ছেদে সবে করিবেক রণ।।
যাহা হৌক, তারা তব কি করিতে পারে।
নিভৃতে বান্ধিয়া তুমি রাখ দামোদরে।।
এতেক বলিল যদি রাধার নন্দন।
এমত মন্ত্রণা করি প্রীত দুর্য্যোধন।।
যত দৃঢ়ঘাতিগণ দ্বারেতে আছিল।
নিভৃতে ডাকিয়া আনি সবারে কহিল।।
কল্য কৃষ্ণ আসিবেন মোর অন্তঃপুরে।
দ্বারকা যাবেন তিনি কহিয়া আমারে।।
মহাপাশে শীঘ্র তাঁরে করিয়া বন্ধন।
যতনে রাখিবে তাঁরে করিয়া গোপন।।
শুনি অঙ্গীকার কৈল দুষ্টমতিগণ।
হইল সানন্দ চিত্ত রাজা দুর্য্যোধন।।
মহাভারতের কথা অমৃত লহরী।
কাশী কহে, শুনিলে তরয়ে ভববারি।।