১৯. বাসুকি নিমন্ত্রণে অর্জ্জুনের পাতালে প্রবেশ

জিজ্ঞাসেন অর্জ্জুনেরে দেব নারায়ণ।
কহ কারে কারে তুমি কৈলা নিমন্ত্রণ।।
শুনিয়া অর্জ্জুন নিবেদিলেন যতেক।
পুস্তক বাহুল্য হয় লিখিলে ততেক।।
করিলেন কুবেরাদি সবে নিমন্ত্রণ।
প্রত্যেক বৃত্তান্ত সব কহেন তখন।।
গোবিন্দ বলেন, যাহ পাতাল-ভবন।
শেষ-নাগরাজে গিয়া কর নিমন্ত্রণ।।
স্বর্গে ইন্দ্র দেবরাজ, পাতালে বাসুকি।
তোমা বিনা অন্যে যায়, এমন না দেখি।।
বাসুকি আইলে যজ্ঞ হইবে সম্পূর্ণ।
বিলম্ব না কর সখা, যাহ তুমি তূর্ণ।।
গোবিন্দের বচনেতে বিলম্ব না করি।
পাতালে গেলেন পার্থ দিব্য রথে চড়ি।।
উপস্থিত হইলেন নাগের আলয়।
চৌদিকে বেষ্টিত ফণী শেষ মহাশয়।।
দশ শত ফণা ধরে মস্তক-উপর।
তিন শত ফণাতে শোভিত চরাচর।।
কূর্ম্মপৃষ্ঠে উপবিষ্ট বেষ্টিত রতন।
উপনীত হন তথা পাণ্ডুর নন্দন।।
নাগরাজে প্রণাম করেন ধনঞ্জয়।
করযোড় করিয়া কহেন সবিনয়।।
শেষ জিজ্ঞাসেন, তব কেন আগমন।
প্রত্যক্ষে কহেন পার্থ সর্ব্ব বিবরণ।।
রাজসূয় নিমিত্ত তোমার নিমন্ত্রণ।
সুরাসুর সহ দেব যাবে সর্ব্বজন।।
ব্রহ্মা-শিব-ইন্দ্র-আদি যত দিকপতি।
সেই যজ্ঞে অধিষ্ঠান হৈবেন সম্প্রতি।।
সেই হেতু আইলাম তোমার ভবন।
রাজসূয়-মহাযজ্ঞে করিবা গমন।।
হাসিয়া কহেন শেষ, শুন ধনঞ্জয়।
তব যজ্ঞে আছেন গোবিন্দ মহাশয়।।
র্হ্ত্তা কর্ত্তা সেই প্রভু বিধি বিধাতার।
সর্ব্ব-যজ্ঞ-ফল পায় দরশনে যাঁর।।
যথা কৃষ্ণ বিদ্যমান তথা সর্ব্বজন।
ব্রহ্মা-শিব-আদি যত দিক্পালগণ।।
অকারণ আমা সবাকারে নিমন্ত্রণ।
সেই কৃষ্ণে ভালমতে করহ অর্চ্চন।।
অনন্ত ব্রহ্মাণ্ডে আছে কত শত প্রাণী।
কত ব্রহ্মা শিব ইন্দ্র কত শেষ ফণী।।
সকলে হইবে তুষ্ট তাঁরে তুষ্ট কৈলে।
শাখা-পত্র তুষ্ট যেন মূলে জল দিলে।।
অর্জ্জুন বলেন, দেব কর অবধান।
যতেক কহিলা তুমি বেদের প্রমাণ।।
নিজ বশ নহি সবে তাঁর মায়াবন্ধ।
জানিয়া শুনিয়া পুনঃ হয় মায়াধন্দ।।
পুনঃ নাগরাজ বলে অর্জ্জুনে, চাহিয়া।
আসিলে আমারে নিতে কিছু না জানিয়া।।
মস্তক-উপরে আমি ধরি যে সংসার।
আমি গেলে যজ্ঞে, কে ধরিবে ক্ষিতিভার।।
অর্জ্জুন বলেন, কৃষ্ণ কহেন আমারে।
যজ্ঞ পূর্ণ হৈবে, তুমি গেলে তথাকারে।।
ক্ষিতিভার হেতু যদি করহ বিচার।
তুমি যাহ আমি লৈব পৃথিবীর ভার।।
এত শুনি বিস্ময় মানিয়া বিষধর।
হাসিয়া অর্জ্জুন প্রতি করিল উত্তর।।
পৃথিবী ধরিবে হেন করিলে স্বীকার।
পৃথিবী ছাড়িনু, বাক্য পাল আপনার।।
এত শুনি ধনঞ্জয় লইয়া গাণ্ডীব।
করযোড়ে প্রণমিয়া শিবদাতা শিব।।
ভক্তিভাবে কৃষ্ণনাম করিয়া স্মরণ।
শিরে দ্রোণাচার্য্য-পদ করিয়া বন্দন।।
অদ্ভুত স্তম্ভন-অস্ত্র তূণ হৈতে নিয়া।
জুড়েন গাণ্ডীবে ক্ষিতি-অস্ত্র বসাইয়া।।
ধরেন ধরণী, শেষ স্বতন্ত্র হইল।
দেখিয়া সকল নাগ অদ্ভুত মানিল।।
তবে শেষ, যত নাগ লইয়া সংহতি।
রাজসূয়-যজ্ঞ-স্থানে গেল শীঘ্রগতি।।
বাসুকি আসিল আর তক্ষক কৌরব।
নহুষ কর্কট ধৃতরাষ্ট্র জরদগর।।
কোপন কালিয় ত্রিকপূর্ণ ধনঞ্জয়।
অজ্যক উগ্রক দুষ্ট রুষ্ট মহাশয়।।
নীল শঙ্খমুখ শ্ঙ্খপিণ্ড বক্রদন্ত।
কলিচূড় পিঙ্গচক্ষু কালমহাবন্ত।।
পুত্র-পৌত্র সংহতি চলিল লক্ষ লক্ষ।
দেখিয়া সকল লোক মানিল অশক্য।।
পাচঁ সাত শির কার, ষট্ সপ্ত শত।
সহস্র মস্তক কার আকার পর্ব্বত।।
নিজ পরিবারে মিলি চলে ফণিরাজ।
হেথায় সুরেন্দ্রালয়ে দেবের সমাজ।।
ঐরাবত-আরোহণে বজ্র শোভা করে।
মাতলি ধরয়ে ছত্র মস্তক-উপরে।।
অষ্টবসু নবগ্রহ অশ্বিনী-কুমার।
দ্বাদশ অদিত্য রুদ্র একাদশ আর।।
ঊনপঞ্চাশ বায়ু, সাতাশ হুতাশন।
যজ্ঞ মন্ত্র দক্ষিণা পুরোধা দণ্ড ক্ষণ।।
যোগ তিথি কারণ নক্ষত্র রাশিগণ।
চারি মেঘ বিদ্যুৎ সহিত সৈন্যগণ।।
গন্ধর্ব্ব কিন্নর যত অপ্সরী অপ্সর।
দেব-ঋষি ব্রহ্ম-ঋষি চলিল বিস্তর।।
বশিষ্ঠ পৌলস্ত্য ভৃগু পুলহ অঙ্গিরা।
পরাশর ক্রুতু দক্ষ লোমশ সুধীরা।।
অসিত দেবল কৌণ্ড শুক সনাতন।
মার্কণ্ড মাণ্ডব্য ধ্রুব জয়ন্ত কোপন।।
ইত্যাদি যতেক ঋষি ইন্দ্রপুরে থাকে।
ইন্দ্রসহ যজ্ঞস্থানে চলে লাখে লাখে।।
চড়িয়া পুষ্পক-রথে ধনের ঈশ্বর।
সঙ্গেতে চলিল যক্ষ গন্ধর্ব্ব কিন্নর।।
চিত্ররথ তুম্বুরু অঙ্গিরা গুণনিধি।
বিশ্বাবসু মহেন্দ্র মাতঙ্গ সুর আদি।।
ফলকর্ণ ফলোদক চিত্রক লোত্রক।
লিখনে না যায় যত চলিল গুহ্যক।।
ঘৃতাচী ঊর্ব্বশী চিত্রা রম্ভা চিত্রসেনী।
চারুনেত্রা মিশ্রকেশী বুদবুদা মোহিনী।।
চিত্ররেখা অলম্বুষা সুরভি সমাচী।
পোণিকা কদম্বা অর্ম্মা শূদ্রা রুচি শুচি।।
লক্ষ লক্ষ বিদ্যাধরী নৃত্য-গীত-নাদে।
কুবেরের সহ সবে চলিল আহ্লাদে।।
যজ্ঞ দেখিবারে চলে যত মহীধর।
হিমাদ্রি কৈলাস শ্বেত নীল গিরিবর।।
কালগিরি রামগিরি গোবর্দ্ধন শাখ।।
চিত্রকূট বিন্ধ্যা গন্ধমাদন সুবল।
ঋষ্যশৃঙ্গ শতশৃঙ্গ মহেন্দ্র ধবল।।
রৈবতক যত গিরি গিরি মুনিশিল।
কামগিরি খণ্ডগিরি গিরিরাজ নীল।।
লক্ষ লক্ষ গিরিবর দেবরূপ ধরি।
যক্ষরাজ সহ গেল যজ্ঞ-অনুসরি।।
বরুণ চলিল নিজ অমাত্য সহিত।
মূর্ত্তিমন্ত সপ্তসিন্ধু যতেক সরিত।।
গঙ্গা সরস্বতী শোণ দিনকরসুতা।
চিত্রোৎপলা প্রেতা বৈতরণী পুণ্যযুতা।।
চন্দ্রভাগা গোদাবরী সরযূ লোহিতা।
দেবনদী মহানদী মহাশ্বী সবিতা।।
ভৈরবী ভার্গবী নদী ভদ্রা বসুমতী।
মেঘবতী গোমতী আরো সৌরবতী।।
নর্ম্মদা অজয় ব্রাহ্মী ব্রহ্মপুত্র কংস।
তমল কমলা শিবা কোলামুখ বংশ।।
গণ্ডকী নর্ম্মদা ফল্গু সিন্ধু করতোয়া।
স্বর্ণরেখা পদ্মাবতী শতনেত্রা জয়া।।
ঝুমঝুমি কালিন্দী দামোদর গিরিপুরী।
সিন্ধুকা কাবেরী ভদ্রা নদা গোদাবরী।।
ইত্যাদি অনেক নদী নদ সরোবর।
বাপী হ্রদ তড়াগাদি ধরি কলেবর।।
যজ্ঞস্থানে গেল সবে বরুণ সংহতি।
মহিষ-বাহনে চড়ি যান প্রেতপতি।।
পিতৃগণ দূতগণ দণ্ড মৃত্যুপাশ।
আইল অমর-বৃন্দ জুড়িয়া আকাশ।।
অদ্ভুত দ্বাপর-যুগে হৈল যজ্ঞরাজ।
না হইলু কভু যাহা অবনীর মাঝ।।
মনু আদি করি রাজা না যায় লিখন।
যযাতি নহুষ রঘু মান্ধাতা ভুবন।।
দিলীপ সগর ভগীরথ দশরথ।
কৃতবীর্য্য কার্ত্তবীর্য্য সুরথ ভরত।।
ইত্যাদি অনেক হৈল চন্দ্র-সূর্য্য-কুলে।
রাজসূয় অশ্বমেধ করিল বহুলে।।
উদ্দেশেতে যেই দেবে করে আরাধন।
কর লৈয়ে আইলেন সেই দেবগণ।।
মহেশ পার্ব্বতী দোঁহে করেন গমন।
অলক্ষিতে রূপ নাহি দেখে কোন জন।।
দক্ষিণে ত্রিশূল শোভে জটাভার শিরে।
চরণ পরশে দাড়ি শিঙ্কা বাম করে।।
এইরূপে সদাশির সবাকারে রাখে।
যতদূর যজ্ঞস্থল সব ঠাঁই থাকে।।
যত যত জন আসে যজ্ঞের সদনে।
ছায়ারূপে অন্নদা তোষেন সর্ব্বজনে।।
যার যেই বাঞ্ছা তারে আপনি যোগায়।
যে দ্রব্য যে ইচ্ছে তাহা সেইক্ষণে পায়।।
অশ্ব-আরোহণে, করে খর করবাল।
ঊনকোটি দানা লৈয়ে আসে ক্ষেত্রপাল।।
শতকোটি দৈত্য লয়ে আসে দৈত্য ময়।
ছয় সহোদর আসে বিনতা-তনয়।।
দেব দৈত্য নাগ যক্ষ আসে সর্ব্বজনে।
প্রজাপতি আসিলেন হংস-আরোহণে।।
অন্তরীক্ষে থাকিয়া দেখেন চতুর্ম্মুখ।
প্রজাপতিগণ সহ যজ্ঞের কৌতুক।।
মহাভারতের কথা অমৃত-সমান।
কাশীরাম দাস কহে, শুনে পুণ্যবাণ।।