১৭. অর্জ্জুনের মনোদুঃখ শ্রীকৃষ্ণের প্রবোধবাক্য

নারায়ণী সেনা কৃষ্ণ দিল দুর্য্যোধনে।
দেখিয়া হইল দুঃখ অর্জ্জুনের মনে।।
অর্জ্জুনের মন বুঝি কহেন শ্রীপতি।
কি হেতু হইলে সখা তুমি দুঃখমতি।।
নারায়ণী সেনা যত দিলাম উহারে।
সবে হত হইবেক তোমার প্রহারে।।
পূর্ব্বের কাহিনী কহি শুন দিয়া মন।
এক দিন মোর পাশে কহে পিতৃগণ।।
বংশের তিলক তুমি পূর্ণ ব্রহ্মরূপে।
সকল সংসার এই তব লোমকূপে।।
তুমি বিষ্ণু, মহারূপ নর-অবতার।
আমা সবাকারে প্রভু করহ উদ্ধার।।
মগধ রাজ্যেতে জাত বরাহ আছয়।
তার মাংস আনি শ্রাদ্ধ কর মহাশয়।।
তবে তৃপ্ত হয় আমা সবাকার মন।
এইমত কহে মোরে যত পিতৃগণ।।
পিতৃগণ বাক্যে করিলাম অঙ্গীকার।
পুনরপি মোরে তাঁরা কহে আরবার।।
একাকী যাইবে তুমি বরাহ মারিতে।
এক জন সঙ্গে নাহি লবে কদাচিতে।।
যদি সেই দুষ্ট মাংস আনিবে নিশ্চয়।
আমা সবাকার তবে নহে পাপক্ষয়।।
পিতৃগণ-বাক্য শুনি অশ্বে আরোহিয়া।
মগধ রাজ্যেতে আমি প্রবেশিনু গিয়া।।
জরাসন্ধ নৃপতির রক্ষী বনে ছিল।
অনুমানে চিহ্ন দেখি আমারে চিনিল।।
জরাসন্ধে আসি তারা কহে সমাচার।
সসৈন্যে সাজিয়া সেই আসে দুরাচর।।
একেশ্বর বেড়িলেক করি শত পুর।
সৈন্য কোলাহল শব্দ গেল বহুদূর।।
উপায় না দেখি আমি ভাবিনু তখন।
একেশ্বর বলে পরাজিব কত জন।।
দুরন্ত দুষ্কর সেই মগধের সেনা।
যত মরে, তত জীয়ে, না হয় গণনা।।
ভাবিয়া চিন্তিয়া আমি যুক্তি করি সার।
অঙ্গ বাড়াইনু যেন পর্ব্বত আকার।।
অঙ্গ হৈতে সেইক্ষণে হইল সৃজন।
দেখিতে দেখিতে নারায়ণী সেনাগণ।।
দশ সহস্র মহারথী অঙ্গেতে জন্মিল।
জরাসন্ধ সঙ্গে তারা সমর করিল।।
যুদ্ধে পরাভূত হৈল মগধ-রাজন।
ভঙ্গ দিয়া পলাইল যত সৈন্যগণ।।
তবে সেই বরাহেরে চক্রেতে প্রহারি।
আসিলাম নারায়ণী সেনা সঙ্গে করি।।
তুষ্ট হয়ে বলিলাম সেই সেনাগণে।
যেই বর ইচ্ছা কর, মাগ মম স্থানে।।
এত শুনি বলে নারায়ণী সেনাগণ।
যদি বর দিবে তবে দেহ নারায়ণ।।
ইতরের হাতে ‍মৃত্যু মো সবার নয়।
তোমার সমান রূপে গুণে যেবা হয়।।
তার হাতে মৃত্যু যেন হয় সবাকার।
এই বর আজ্ঞা কর দেবকী কুমার।।
তা সবার বাক্য শুনি দিনু বরদান।
তবে আমি মনোমধ্যে করি অনুমান।।
মম সম রূপে গুণে কে আছে সংসারে।
বিনা ধনঞ্জয় বীর না দেখি কাহারে।।
অর্জ্জুনের হাতে হবে তোমা সবা ক্ষয়।
হইবে ভারত-যুদ্ধ, না হয় সংশয়।।
সে কারণে নারায়ণী সৈন্য যত জন।
দুর্য্যোধন প্রতি করিলাম সমর্পণ।।
তব হস্তে হত হবে যত সৈন্যগণ।
এত বলি মায়া দেখাইল নারায়ণ।।
কাহার মস্তক নাহি কবন্ধের প্রায়।
দেখিয়া অর্জ্জুন চিত্তে মানেন বিস্ময়।।
তবে কৃষ্ণে ধনঞ্জয় কহে যোড়করে।
তোমার বিষম মায়া কে বুঝিতে পারে।।
মায়ার পুত্তলী তুমি কত মায়া জান।
আদি নিরঞ্জন তুমি পূর্ণ ভগবান।।
তোমার সহায়ে কিবা মম আছে ভয়।
মারিব কৌরবগণে, নাহিক সংশয়।।
জানিলাম এখন যে ‍যুদ্ধে হবে জয়।
যখন হইলে তুমি আমার সহায়।।
তোমার সহায়ে ইন্দ্র জয়ী ত্রিভুবনে।
তোমার সহায়ে দণ্ড ধরয়ে শমনে।।
তোমার সহায়ে সৃষ্টি করে প্রজাপতি।
তোমার সহায়ে শিব সংহার-মূরতি।।
সেই প্রভু হলে তুমি আমারে সদয়।
ত্রিভুবন মধ্যে মম আর কারে ভয়।।
অর্জ্জুনের বাক্যে হাসি কন নারায়ণ।
না বুঝিয়া পার্থ আমা করিলে বরণ।।
আমি যুদ্ধ না করিব, নিবারিল রাম।
কার শক্তি রামের বচন করে আন।।
কৌরবের পক্ষে আছে বহু যোদ্ধাপতি।
একেশ্বর কি করিতে আমার শকতি।।
এত শুনি হাসি হাসি কহে ধনঞ্জয়।
না বুঝিয়া হেন বাক্য কহ মহাশয়।।
এ তিন ভুবনে ব্যাপ্ত তোমার বিভূতি।
তুমি আদি, তুমি অন্ত, তুমি জগৎপতি।।
তুমি সৃষ্টি পাল, তুমি করহ সংহার।
তোমার বিভূতি বুঝে সামর্থ্য কাহার।।
বিঞ্চৎ জানেন মাত্র দেব পঞ্চানন।
মৃত্যু বলি একরূপ ধর নারায়ণ।।
কোন অল্পমতি হয় কৌরব-তনয়।
সহস্র কৌরবে মম আর নাহি ভয়।।
এক্ষণে যে কহি, তাহা শুন দিয়া মন।
যুধিষ্ঠির-আজ্ঞা তথা যাইতে আপন।।
পাইয়া রাজার আজ্ঞা বিলম্ব না করি।
সেইক্ষণে রথে চড়ি চলিলেন হরি।।
বিরাট নগরে যান অর্জ্জুন সহিত।
কৃষ্ণেরে দেখিয়া যুধিষ্ঠির মহাপ্রীত।।
যদ্যপি গোবিন্দ বন্ধ পাণ্ডবের মনে।
তথাপি বসিতে দেন রত্ন-সিংহাসনে।।
মহাভারতের কথা অমৃত-সমান।
ব্যাসের রচিত দিব্য ভারত-আখ্যান।।
যে বা পড়ে, যে বা শুনে, করায় শ্রবণ।
তাহারে প্রসন্ন হন দেব নারায়ণ।।
এই কথা কহি আমি রচিয়া পয়ার।
অবহেলে শুনে যেন সকল সংসার।।
মস্তকে বন্দিয়া ব্রাহ্মণের পদরজ।
কহে কাশীদাস গদাধর দাসাগ্রজ।।