১৪. ভীম কর্ত্তৃক সুশর্ম্মার পরাজয় ও বিরাটের বন্ধন মোচন

হেথায় ত্রিগর্ত্ত রাজা সংগ্রামে জিনিয়া।
কৃষ্ণানামে নদীতীরে উত্তরলি গিয়া।।
যুদ্ধশ্রমে সর্ব্বসৈন্য ক্ষুধায় আকুল।
রন্ধন ভোজন করে নদীর দুকূল।।
বসন-গৃহেতে কেহ করিল শয়ন।
কেহ স্নানে, কেহ পানে আসন ভোজন।।
বিরাটে করিয়া বন্দী সুশর্ম্মা হরিষে।
বসিয়া সভার মধ্যে কহে পরিহাসে।।
কোথায় শ্যালক তব বিরাট নৃপতি।
যার ভুজবলে ভোগ কৈলি মোর ক্ষিতি।।
ভাগ্যবলে শ্যালকেরে পেয়েছিলে তুমি।
যার তেজে কাড়িয়া লইয়া মোর ভূমি।।
এক্ষণে তোমার কিবা আছে হে উপায়।
নাহি দেখি কেহ আছে তোমার সহায়।।
নিশ্চয় তোমার মৃত্যু হৈল মম হাতে।
শৃগাল হইয়া বাদ সিংহের সহিতে।।
কেহ বলে, ইহারে না রাখ এক দণ্ড।
কেহ বলে, খড়্গে কাটি কর খণ্ড খণ্ড।।
কেহ বলে, নিগড়েতে করহ বন্ধন।
দুর্য্যোধন আগে লয়ে করিব নিধন।।
এমত বিচারে আছে তথা সর্ব্ব জন।
হেনকালে উপনীত পবন-নন্দন।।
দুই ভিতে বৃক্ষে ভাঙ্গে, শুনি মড় মড়।
নাসায় নিশ্বাস বহে প্রলয়ের ঝড়।।
মার মার শব্দ করি, আসি উপনীত।
দেখিয়া ত্রিগর্ত্ত সৈন্য হৈল মহাভীত।।
কেহ বলে, রাক্ষস কি যক্ষ বিদ্যাধর।
হিমগিরি শৃঙ্গ সম ভীম কলেবর।।
পলায় সকল সৈন্য গণিয়া প্রমাদ।
হস্তিগণ ধায় সবে করি ঘোর নাদ।।
শীঘ্রগতি হস্তী পৃষ্ঠে চড়িয়া মাহুত।
বৃকোদরে বেড়িল যে হস্তী যূথ যূথ।।
রথিগণ রথ সাজি আরূঢ় হইয়া।
লক্ষ লক্ষ চতুর্দিকে বেড়িল আসিয়া।।
শেল শূল শক্তি জাঠি ভূষণ্ডী তোমর।
চতুর্দ্দিকে মারে সবে ভীমের উপর।।
মহাবল ভীমসেন ভীম-পরাক্রম।
রণস্থল মধ্যে যেন যুগান্তের যম।।
ধরিয়া কুঞ্জর শুণ্ড শুণ্ডে বুলাইয়া।
মারিল কুঞ্জরবৃন্দ প্রহার করিয়া।।
রথধ্বজ ধরি বীর মারে রথোপরে।
সহস্র সহস্র রথ ভাঙ্গে একেবারে।।
অশ্বগণ ধরি বীর মারে অশ্বগণে।
পদাতি পদাতি মারে ধরিয়া চরণে।।
তাহারে ধরিয়া মারে যে পড়ে সম্মূখে।
রথ অশ্ব হস্তী পত্তি পড়ে লাখে লাখে।।
পলায় সকল সৈন্য, পাছু নাহি চায়।
সিংহের গর্জ্জনে যথা শৃগাল পলায়।।
পলাহ পলাহ বলি, হৈল মহাধ্বনি।
আইল আইল সৈন্যে, এইমাত্র শুনি।।
ঊর্দ্ধশ্বাসে দূত গিয়া কহে সুশর্ম্মারে।
বসিয়া কি কর রাজা পলাহ সত্বরে।।
আচম্বিতে সৈন্যমধ্যে আসে একজন।
রাক্ষস গন্ধর্ব্ব কিবা, না জানি কারণ।।
মহাভয়ঙ্কর মূর্ত্তি, না জানি কি রঙ্গ।
প্রকাণ্ড শরীর, যেন হিমালয় শৃঙ্গ।।
মারিল অনেক সৈন্য, যে পড়ে সম্মুখে।
সুশর্ম্মা সুশর্ম্মা বলি, ঘন ঘন ডাকে।।
বুঝিয়া করহ কার্য্য, যে হয় বিচার।
তার আগে পড়িল না দেখি রক্ষা কার।।
কত সৈন্য পড়িয়াছে নাহি তার অন্ত।
নাহি জানি হেথা আছে এমন দুরন্ত।।
পলাহ নৃপতি শীঘ্র প্রাণ বড় ধন।
ওই দেখ আসিতেছে ভীষণ-দর্শন।।
এত বলি ধায় দূত পাছু ‍নাহি চায়।
হেনকালে উপনীত ভীম মহাকায়।।
ভীমের শরীর দেখি অতি ভয়ঙ্কর।
ভয়েতে কম্পিত সুশর্ম্মার কলেবর।।
পলাইল সর্ব্বসৈন্য, রাজা মাত্র আছে।
ভয়েতে বিহ্বল হৈল ভীমে দেখি কাছে।।
শীঘ্রগতি উঠি রাজা ভয়ে রড় দিল।
কেশে ধরি বৃকোদর ভূমিতে পাড়িল।।
দৃঢ়মুষ্টি করি কেশ ধরি বাম হাতে।
দক্ষিণ করেতে ধরি নিল মৎস্যনাথে।।
দুই করে ধরি দুই নৃপতির কেশে।
বায়ুবেগে ধায় বীর ভয়ঙ্কর বেশে।।
মুহূর্ত্তেকে উপনীত যথা ধর্ম্মরায়।
চরণে ফেলিয়া ভীম অন্তরে দাঁড়ায়।।
কেশ আকর্ষণে দোঁহে ছিল অচেতন।
কতক্ষণে সচেতন হয় দুই জন।।
মাথা তুলি মৎস্যরাজ দেখি সভাসদে।
কতক আশ্বস্ত চিত্তে কহে সে বিপদে।।
কহ ভট্ট কঙ্ক, ভাগ্যে দেখিনু তোমায়।
আমা দোঁহে ফেলি গেল গন্ধর্ব্ব কোথায়।।
ভাগ্যেতে রহিল প্রাণ গন্ধর্ব্বের হাতে।
চল যাব শীঘ্রগতি, পশিব সৈন্যেতে।।
পুনর্ব্বর আসি যদি গন্ধর্ব্বেতে ধরে।
এবার না জীব আমি দেখিলে তাহারে।।
ধর্ম্ম বলিলেন, ভয় না কর নৃপতি।
গন্ধর্ব্ব ‍রাজার বড় স্নেহ তোমা প্রতি।।
সে কারণে শত্রু তব আনিলেক ধরি।
শত্রু হৈতে তোমাকে যে দিল মুক্ত করি।।
গন্ধর্ব্বের ভয় নাহি করিও কখন।
কার্য্য করি নিজস্থানে করিল গমন।।
সুশর্ম্মার ডাকি তবে কহে ধর্ম্মরায়।
হেথায় আসিতে বুদ্ধি কে দিল তোমায়।।
কীচক মরিল, বলি পাইলে ভরসা।
না জান গন্ধর্ব্ব হেথা করিয়াছে বাসা।।
ভাগ্যেতে গন্ধর্ব্ব তোমা না মারিল প্রাণে।
পূর্ব্ব পুণ্যফলে প্রাণ পেলে তার স্থানে।।
আজ্ঞা কর মৎস্যরাজ সুশর্ম্মার প্রতি।
ক্ষমহ সকল দোষ, ছাড় শীঘ্রগতি।।
সংগ্রামে হারিয়া তবে ত্রিগর্ত্ত নৃপতি।
ভগ্নসৈন্য নিরুৎসাহ অতি দীনমতি।।
সৈন্যগণ পলাইল একামাত্র আছে।
করহ প্রসাদ রাজা, যদি মনে ইচ্ছে।।
বিরাটী কহিল, যাহা তব অনুমতি।
যাউক আপন রাজ্যে সুশর্ম্মা নৃপতি।।
দিব্য রথ দিল এক করিয়া সাজন।
সুশর্ম্মা চড়িয়া তাহে করিল গমন।।
ধর্ম্মরাজ বলিলেন বিরাটের প্রতি।
নগরেতে দূত রাজা যাক্ শীঘ্রগতি।।
তোমারে শুনিলে বন্দী রাজ্যে হবে ভয়।
রাণীগণ দুঃখী হবে, ভাল কর্ম্ম নয়।।
শীঘ্রগতি বার্ত্তা দূত দিউক অন্দরে।
বিজয় ঘোষণা হোক রাজ্যের ভিতরে।।
ধর্ম্মের বচনে আজ্ঞা দেন মৎস্যরাজ।
শীঘ্রগতি দূত পাঠাইল পুরীমাঝ।।
মহাভারতের কথা অমৃত-সমান।
কাশীরাম দাস কহে, শুনে পুণ্যবান।।