১৩. শ্রীকৃষ্ণের নিকট দুর্য্যোধন কর্ত্তৃক উলূককে দূতরূপে প্রেরণের মন্ত্রণা

মুনি বলে, শুন শুন রাজা জন্মেজয়।
তবে দুর্য্যোধন রাজা চিন্তিল হৃদয়।।
দ্বারকা গেলেন কৃষ্ণ, পেয়ে সমাচার।
বরিবারে দূত পাঠাইল আগুসার।।
গোবিন্দেরে লিখিলেন সব বিবরণ।
কৌরব পাণ্ডবে হবে ঘোরতর রণ।।
উভয় কুলের হিত কুটুম্ব আপনি।
সে কারণে অগ্রে তোমা বরিলাম আমি।।
মহারণে হবে তুমি আমার সারথি।
এত বলি দূত পাঠাইল শীঘ্রগতি।।
তবে মন্ত্রিগণ লয়ে কৌরবের পতি।
নিভৃতে বসিয়া যুক্তি করে মহামতি।।
ভীষ্ম দ্রোণ কৃপ আর সুবল-নন্দন।
দুঃশাসন কর্ণ আদি যত মন্ত্রিগণ।।
রাজা বলে, একমনে শুন সভাজন।
দুই কুল হিত হন দেব নারায়ণ।।
হইবে ভারত যুদ্ধ, না হবে খণ্ডন।
সম্বন্ধে সমান হন দেব জনার্দ্দন।।
দূত পাঠাইনু আমি বুঝিতে রহস্য।
দুই কুল হিত কৃষ্ণ করিবে অবশ্য।।
সে হেতু বুঝিব আমি কৃষ্ণ বলাবল।
পাণ্ডবের প্রিয় কিবা জানিব সকল।।
মম হিতাহিত কৃষ্ণ করে বা না করে।
পাঠাইনু দূত তাহা বুঝিবার তরে।।
ইহা শুনি কহে ভীষ্ম গঙ্গার নন্দন।
না বুঝিয়া দুত পাঠাইলে অকারণ।।
ত্রিভুবন জ্ঞাত, কৃষ্ণ পাণ্ডবের হিত।
তোমার স্বপক্ষ নাহি হবে কদাচিত।।
কর্ণ বলে, মম চিত্তে না লয় এ কথা।
পাণ্ডবের হিত কৃষ্ণ, জানি যে সর্ব্বথা।।
তোমার অহিত কৃষ্ণ, জানি নিজ মনে।
কি বুঝিয়া দূত পাঠাইলে তার স্থানে।।
যদি বা স্বপক্ষ তব হয় কদাচন।
কপট করিয়া নাশিবেক সর্ব্বজন।।
মুখেতে সুতৃপ্ত ভাষা, অন্তরেতে আন।
তোমার পরম শত্রু দেব ভগবান।।
কিন্তু বলভদ্র হয় তব প্রতি প্রীত।
তাঁহারে বরিতে যুদ্ধে হয়সমুচিত।।
তীর্থ যাত্রা করি ভ্রমে সেই বলরাম।
দূত পাঠাইয়া রাজা দেহ তাঁর স্থান।।
তোমার সহায় হবে দেব সঙ্কর্ষণ।
হেন মম চিত্তে লয় শুনহ রাজন।।
শকুনি বলিল, ভাল বলিলে যুকতি।
তোমার সহায় হবে রেবতীর পতি।।
মহাবলবন্ত রাম সংগ্রামে প্রচণ্ড।
দৃষ্টিমাত্রে পাণ্ডবের করিবেক খণ্ড।।
রাজা বলে, যা কহিলে সখে সারোদ্ধার।
মম হিতকারী সেই রোহিণী-কুমার।।
কিন্তু তীর্থযাত্রা হেতু গেলা সঙ্কর্ষণ।
গোবিন্দেরে দূত পাঠাইনু সে কারণ।।
সম্বন্ধে বেহাই হয় দেব জগৎপতি।
মনে লয়, মম সঙ্গে করিবেন প্রীতি।।
দুঃশাসন বলে, মম মনে নাহি লয়।
পাণ্ডবের বড় প্রিয় দেবকী তনয়।।
তোমার সহায় নাহি হবে কদাচন।
না বুঝিয়া দূত পাঠাইলে কি কারণ।।
ইহা শুনি কহিল, শকুনি দুরাশয়।
উভয় কুলের হিত দেবকী-তনয়।।
আপনি সহায় যদি না হন তোমার।
নারায়ণী সেনা তাঁর আছয়ে অপার।।
সেই সৈন্য হয় যদি তোমার স্বপক্ষ।
চিত্তে হেন লয়, জয় হইবে প্রত্যক্ষ।।
নারায়ণী সেনা তাঁর মহাবলবান।
সমরে অজেয় তারা দেবের সমান।।
সেই সৈন্য হয় যদি তোমার স্বপক্ষ।
চিত্তে হেন লয়ম জয় হইবে প্রত্যক্ষ।।
নারায়ণী সেনা তাঁর মহাবলবান।
সমরে অজেয় তারা দেবের সমান।।
সেই সৈন্য দেন যদি দেবকী কুমার।
কিবা প্রয়োজন কৃষ্ণে আছয়ে তোমার।।
এতেক সহায় হৈলে কি করিবে রণে।
জগতে বিখ্যাত আছে তার বীরপণে।।
জরাসন্ধ-ভয়ে যান মথুরা ত্যজিয়া।
সমুদ্রের কূলে গিয়া রহে লুকাইয়া।।
তারে রবি কোন্ কর্ম্ম হইবে তোমার।
তারে বারিবারে যুক্তি নহে মো সবার।।
রণে পলাইয়া যায় শৃগালের প্রায়।
হেন জনে বরিবারে মনে নাহি লয়।।
যেই জরাসন্ধ ভয়ে পলাইয়া গেল।
কর্ণ মহাবীর তারে সমরে জিনিল।।
কর্ণের সমান বীর নাহি ত্রিভুবনে।
মুহূর্ত্তেকে সংহারিবে পাণ্ডুর নন্দনে।।
ইন্দ্র আদি সখা যদি করিবে পাণ্ডব।
তথাপি কর্ণের হাতে পাবে পরাভব।।
প্রতাপেতে কার্ত্তবীর্য্যার্জ্জুনের সমান।
ইন্দ্র আদি দেব করে যাহার বাখান।।
ধনুর্দ্ধরগণে গণি ভৃগু-বংশপতি।
জগতে বিখ্যাত আর কর্ণ মহামতি।।
কর্ণের শতাংশ নাহি গণি নারায়ণে।
তারে তবে যুদ্ধে বরি কোন্ প্রয়োজনে।।
রাজা বলে, যুদ্ধ হেতু না বরিনু তারে।
আমার সারথি যেন হয় যে সমরে।।
সারথির যোগ্য হয় দেব নারায়ণ।
সারথি করিয়া তবে করিব বরণ।।
এত শুনি দ্রোণ কৃপ বলেন হাসিয়া।
হেন বাক্য মুখে রাজা আন কি বুঝিয়া।।
তোমার সারথি হবে দেব নারায়ণ।
অসম্ভব কথা এই নাহি লয় মন।।
পাণ্ডব-সহায় সেই দেব জগৎপতি।
কিমতে হবেন কৃষ্ণ তোমার সারথি।।
ধৃতরাষ্ট্র বলে, ইহা দূতকর্ম্ম নয়।
আপনি বরহ গিয়া দেবকী তনয়।।
সসৈন্যে দ্বারকাপুরী যাহ দুর্য্যোধন।
সাক্ষাতে বরিলে সেই মানিবে বচন।।
দুর্য্যোধন বলে, আগে শুনি দূতস্থানে।
কি বলয়ে আগে শুনি দেব নারায়ণে।।
হয় বা না হয় কৃষ্ণ আমার সারথি।
দূতমুখে পাইব যে ইহার ভারতী।।
বলাবল বুঝি কার্য্য করিব তখন।
নহে বা আপনি গিয়া করিব বরণ।।
ধৃতরাষ্ট্র বলে, ভাল কৈলে যুক্তি সার।
আপনি বরহ গিয়া দেবকী-কুমার।।
যাবৎ না বরে পঞ্চ পাণ্ডুর কুমার।
সসৈন্যে দ্বারকা তুমি হও আগুসার।।
উভয় কুলের হিত দেব জগৎপতি।
সম্প্রীতি করিবে কৃষ্ণ বুঝি কার্য্যগতি।।
পিতার বচনে ক্রোধে বলে দুর্য্যোধন।
সম্প্রীতি করিতে চাহ কোন্ প্রয়োজন।।
জীবন্তে পাণ্ডব সহ নাহি মোর প্রীত।
উচিত যে হয় তাহা, করহ বিহিত।।
বিদুর এতেক শুনি কহেন তখন।
বিপদ সময় জ্ঞান হারায় সুজন।।
আরে দুর্য্যোধন তোর হেন লয় মন।
তোমার সারথি হইবেন নারায়ণ।।
ব্রহ্মা শিব ইন্দ্র আদি দেব যত জন।
উদ্দেশে যাঁহার করে চরণ সেবন।।
বার বার অবতার হয়ে জগন্নাথ।
করিলেন কোটি কোটি অসুর নিপাত।।
মৎস্য কলেবর ধরি দেব নারায়ণ।
দৈত্য মারি করিলেন বেদ উদ্ধারণ।।
কূর্ম্ম অবতার হয়ে শ্রীমধুসূদন।
করিলেন পৃষ্ঠদেশে ধরণী ধারণ।।
অনন্তর ধরি কৃষ্ণ বরাহ আকৃতি।
হিরণ্যাক্ষে বধি উদ্ধারিলা বসুমতী।।
ধরিয়া নৃসিংহরূপ হইয়া প্রকাশ।
হিরণ্যকশিপু দৈত্য করিলা বিনাশ।।
ধরিয়া বামনরূপ দেব নারায়ণ।
পাতালে নিলেন বলি করিয়া ছলন।।
ভৃগুবংশে রামরূপে হয়ে অবতার।
নিঃক্ষত্রা করেন ক্ষিতি তিন সপ্ত বার।।
রামরূপে বধিলেন লঙ্কার রাবণ।
হলধর বেশধারী আছেন এখন।।
পূর্ণব্রহ্ম অবতার কৃষ্ণ যদুমণি।
আগম পুরাণে যাঁর মহিমা বাখানি।।
হেন কৃষ্ণ সূতবৃত্তি করিবে তোমার।
হেন বাক্য না বুঝিয়া বল বারে বার।।
কিন্তু ভক্তিবশ হন দেব হৃষীকেশ।
ভক্তের কামনা পূর্ণ করেন অশেষ।।
অভক্ত গোবিন্দে তুমি, বিখ্যাত জগতে।
তোমার সারথি কৃষ্ণ হবেন কিমতে।।
এইরূপে কহিলেন বিদুর সুমতি।
শুনি কিছু উত্তর না দিল কুরুপতি।।
সভা হৈতে উঠি রাজা গেল অন্তঃপুরে।
সব কুরুগণ গেল যে যাহার ঘরে।।