১২. অর্জ্জুন কর্ত্তৃক যুধিষ্ঠিরের নিকট যদুবংশ ধ্বংস কীর্ত্তন

জন্মেজয় কহে তবে শুন তপোধন।
অতঃপর কি হইল কহ বিবরণ।।
পাণ্ডুপুত্র পঞ্চভাই শ্রীকৃষ্ণ বিয়োগে।
কিমতে ধরিল প্রাণ এত শোক ভোগে।।
বিশেষিয়া কহ মুনি মহাশয় মোরে।
এ তাপ খণ্ডাও মম মনের ভিতরে।।
তব মুখে শ্রুতবাক্য সুধা হৈতে সুধা।
শ্রবণেতে আমার খণ্ডিল সব ক্ষুধা।।
পিতামহ উপাখ্যান অপূর্ব্ব আখ্যান।
তব মুখে শুনিলে জন্ময়ে দিব্যজ্ঞান।।
বিখ্যাত বৈশম্পায়ন মহাতপোধন।
ব্যাস উপদেশ শাস্ত্রে অতি বিচক্ষণ।।
নৃপতির বাক্য শুনি আনন্দিত মনে।
কহিতে লাগিল মুনি জন্মেজয় স্থানে।।
মুনি বলে শুন কুরুবংশ চূড়ামণি।
অনন্তরে শুন পিতামহের কাহিনী।।
বসিলেন ধর্ম্মরাজ রত্ন সিংহাসনে।
শিরেতে ধরিল ছত্র পবন-নন্দনে।।
চামর ঢুলায় দুই মদ্রবতী-সুত।
পাত্র মিত্র অমাত্য সংযুত গুণযুত।
সভায় বসিয়া রাজা ধর্ম্ম অবতার।
হরষিতে বসি সবে করেন বিচার।।
হেনকালে অমঙ্গল দেখি বিপরীত।
দিবসেতে শিবাগণ ডাকে চারিভিত।
অন্তরীক্ষে গৃধ্রপক্ষী উড়ে ঝাঁকে ঝাঁকে।
বিপরীত শব্দ করি ঘন ডাকে কাকে।।
বিনা মেঘে ঘোর ডাকে ভীষণ গর্জ্জন।
বিপরীত বাত বহে ভস্ম বরিষণ।।
প্রলয় প্রলয়ে যেন অগ্নি বরিরণ।
ঘোরতর শব্দে ডাকে পশু-পক্ষীগণ।।
ঘরে ঘরে নগরে লোকের কলরব।
অন্যে অন্যে কোন্দল করযে লোক সব।।
পিতাপুত্রে বিবাদ শাশুড়ী বধূ সনে।
ব্রাহ্মণ সহিত দ্বন্দ্ব করে শূদ্রগণে।।
জনকের কেশে ধরি মারয়ে তনয়।
ভাল মন্দ নাহি মুখে যাহা আসে কয়।।
দেউল প্রাচীর ভাঙে দেবের দেহর।
প্রতিমা সকল নাচে গায় মনোহর।।
অবিশ্রান্ত ক্ষণে ক্ষনে নাচে বসুমতী।
বিধিধ উৎপাত বহু হইল অনীতি।।
দেখিয়া বিস্ময় চিত্ত ধর্ম্মের নন্দন।
চিন্তাযুক্ত হ’য়ে মনে করেন ভাবন।।
না জানি কি হেতু হয় এত অমঙ্গল।
মন স্থির নহে মম হৃদয় বিকল।।
দ্বারকানগরে গেল পার্থ মহারথা।
তার ভদ্রাভদ্র কিছু না পাই বারতা।।
না জানি কি বিরোধ করিল কার সনে।
নাহি জানি কি কর্ম্ম করিল সেইখানে।।
কিবা পার্থ সমরে পাইল পরাজয়।
এত অমঙ্গল দেখি অকারণ নয়।।
কিরূপে ত্বরিতে পাই পার্থের বারতা।
শীঘ্রগতি দূত পাঠাইয়া দেহ তথা।।
কি কারণে আজ মম আকুল পরাণ।
বাম আঁখি নাচে এই বড় অলক্ষণ।।
এইরূপে যুধিষ্ঠির করেন ভাবন।
বিষাদ করেন রাজা চিন্তাকুল মন।।
পার্থ আইলেন তবে দ্বারকা হইতে।
হস্তিনায় প্রবেশিল কান্দিতে কান্দিতে।।
হায় কৃষ্ণ বলিয়া কান্দেন ঘনে ঘন।
কিমতে যাইব আমি হস্তিনা ভুবন।।
কি বলিব গিয়া আমি ধর্ম্ম নৃপবরে।
হায় প্রভু তোমা বিনা কি হবে আমারে।।
নয়নযুগলে বারি বহে অনিবার।
শুষ্কমুখে কৃষ্ণ কৃষ্ণ বলি হাহাকার।।
গাণ্ডীব ধরিতে নাহি হইলেন ক্ষম।
কৃষ্ণের সহিত গেলে বীরত্ব বিক্রম।।
রথেতে গাণ্ডীব রাখি বীর ধনঞ্জয়।
পদব্রজে চলিলেন অতি দীন প্রায়।।
দূরে দেখি ধর্ম্ম জিজ্ঞাসেন বৃকোদরে।
এই দেখ অর্জ্জুন আসিছে কতদূরে।।
অর্জ্জুনের রথ হেন পাই দরশন।
অর্জ্জুন আইসে মম হেন লয় মন।।
কিহেতু এতেক ধীরে চলে রথবর।
বিষাদ গমন হেন বুঝি যে অন্তর।।
অর্জ্জুনেরে দেখি আজি বড়ই মলিন।
কৃষ্ণবর্ণ শুষ্কমুখ যেন অতি দীন।।
দারুক আইল পূর্ব্বে কৃষ্ণের আদেশে।
অর্জ্জুনে লইয়া গেল গোবিন্দের পাশে।।
কতবার যায় পার্থ দ্বারকা ভুবন।
আনন্দসাগরে আসে নিজ নিকেতন।।
আজি কেন অমঙ্গল দেখি অপ্রমিত।
কলহ করিল কিবা কাহার সহিত।।
কিম্বা কোন অপরাধ কৈল প্রভুস্থানে।
সেই দোষে কৃষ্ণ কি করিলেন ভর্ৎসনে।।
বলভদ্র সহ কিবা করিল বিবাদ।
না জানি ঘটিল আজি কেমন-বিষাদ।।
যদি পার্থ হ’য়ে থাকে কৃষ্ণের বর্জ্জিত।
সকলে নৈরাশ হ’ল পাণ্ডব নিশ্চিত।।
কৃষ্ণ বিনা পাণ্ডবের কেবা আছে আর।
সকল সম্পদ মম চরন তাঁহার।।
তাঁহার বর্জ্জিত হ’য়ে কে ধরিবে দেহ।
কি করিব রাজ্যধন কি করিব গেহ।।
এইমত যুধিষ্ঠির করেন চিন্তিত।
নিকটে আইল পার্থ ইন্দ্রের নন্দন।।
চিত্র পুত্তলিকা প্রায় মুখে নাহি বোল।
পড়িল ধরণীতলে হইয়া বিহ্বল।
হা কৃষ্ণ বলিয়া বীর লোটায় ধরণী।
অর্জ্জুনের নেত্রজলে ভিজিল অবনী।।
রাজা জিজ্ঞাসেন কহ কুশল সংবাদ।
পাণ্ডবের তরে কিবা হইলে প্রমাদ।।
কি দোষ করিলে তুমি কৃষ্ণের চরণে।
গোবিন্দ বর্জ্জিত কি হইলে এত দিনে।।
স্বরূপেতে বলহ কুশল সমাচার।
কি কারণে এত দুঃখ হইল তোমার।।
উঠ উঠ ধনঞ্জয় কহ বিবরণ।
কি প্রকারে আছে সে শ্রীমধুসূদন।।
কি কারণে ত্বরিত সে দারুক আইল।
ভাল মন্দ সমাচার কিছু না কহিল।।
তোমাকে লইয়া গেল দ্বারকা নগরী।
কহ তুমি কিরূপে ভেটিবে দেব হরি।।
জগতের হর্ত্তা কর্ত্তা দেব নারায়ণ।
এক লোমকূপে তাঁর বৈসে কত জন।।
কত শিব ইন্দ্র যাঁর এক লোমকূপে।
তাঁহারে সম্ভাষ তুমি করিলে কি রূপে।।
মাতুল নন্দন হেন বিচারিল মনে।
সেই দোষে কৃষ্ণ নাহি চাহিল নয়নে।।
কিবা বলভদ্র সহ কৈলে অবিনয়।
কি দোষ করিলে তুমি ভাই ধনঞ্জয়।।
চারিভিতে চারি ভাই মলিন বদন।
ধূলায় লোটায় বীর ইন্দ্রের নন্দন।।
অর্জ্জুন কহেন রাজা কি কহিব আর।
এতদিনে কৃষ্ণহীন হইল সংসার।।
পাণ্ডবের বন্ধুরূপী সেই নারায়ণ।
তাহাতে বর্জ্জিত হ’লে শুনহ রাজন।।
ব্রহ্মশাপে যদুবংশ হইলেক ক্ষয়।
দ্বন্দ্ব যুদ্ধ করি সবে করিল প্রলয়।।
কামদেব আদি যেই কৃষ্ণের নন্দন।
কৃতবর্ম্মা সাত্যকি যতেক যদুগণ।।
পরস্পর যুদ্ধ করি হইল সংহার।
একজন যদুকূলে না রহিল আর।।
যোগে তনু ত্যজিলেন রেবরীরমণ।
নিম্ববৃক্ষে আরূঢ় ছিলেন নারায়ণ।।
ব্যাধ এক আছি বাণে বিন্ধিল চরণ।
তাহে ত্যজিলেন প্রাণ শ্রীমধুসূদন।।
পাণ্ডবকুলের নাথ দেব জনার্দ্দন।
তাঁহার বিয়োগে হ’ল সকল মরণ।।
কি করিব রাজ্যধন কি কাজ জীবনে।
সকল নিরাশ হ’ল গোবিন্দ বিহনে।।
গাণ্ডীব ধরিতে মম শক্তি নাহি আর।
দশদিক শূন্য দেখি সকলি অন্ধকার।।
মুষলপর্ব্বের কথা অপূর্ব্ব ঘটন।
পয়ার প্রবন্ধে কাশীদাস বিরচন।।