০৯. মহীরাবণ বধ

জন্মেজয় বলে, মুনি করি নিবেদন।
তার পর কিবা হৈল কহ তপোধন।।
মুনি বলে, শুন পরীক্ষিতের নন্দন।
তদন্তরে যেই হৈল শুনহ কারণ।।
মহীরাবণ বীর তবে করিল গমন।
দেখিলা রামের সৈন্য বহু বীরগণ।।
বড় বড় বীর দেখে পর্ব্বত আকার।
দেখিয়া ত মহীরাবণের চমৎকার।।
কিরূপে করিব রণ না দেখি উপায়।
কোনরূপে জিনি রণ চিন্তিল তথায়।।
তবে মহী ভাবিলেন আপন অন্তরে।
যুদ্ধে কার্য্য নাহি মোর এই কার্য্য সারে।।
যুদ্ধ না করিব, না হইব প্রচারণ।
নিশিতে লইয়া যাব শ্রীরাম লক্ষ্মণ।।
এত ভাবি নিশিতে ধরিয়া বেশান্তর।
বানর হইয়া রহে বানর ভিতর।।
তবে আসি মহী দশরথ রূপ ধরি।
দেখে গিয়া দ্বারে হনুমানেরে প্রহরী।।
মায়া করি বলে হনুমান বিদ্যমান।
শ্রীরামের পিতা আমি দশরথ নাম।।
বহুদিন দেখি নাই শ্রীরাম লক্ষ্মণ।
দ্বার ছাড়ি দেহ করি রাম দরশন।।
এত শুনি হনূমান বলেন বচন।
হেথা এস করাইব রাম-দরশন।।
রাম জয় করিয়া আইসে বিভীষণ।
দেখি ভয়ে পলাইল রাবণ-নন্দন।।
এইমত আসে যায় নানা বেশ ধরি।
গড়ে প্রবেশিতে নারে হনূ ত প্রহরী।।
তার পরে বিভীষণের মূর্ত্তি ধরি আসি।
গড়ে প্রবেশিতে সেই মনে অভিলাষী।।
দুই ভাই লয়ে তবে প্রবেশে পাতাল।
রাম-লক্ষ্মণেরে লয়ে চলিল ভূপাল।।
নিগড়ে বন্ধন করি রাখিল নির্জ্জনে।
পাথর চাপায়ে বুকে রাখে দুইজনে।।
রামে না দেখিয়া হেথা কান্দে কপিগণ।
হনূমান নল নীল কান্দে বিভীষণ।।
এইমত কান্দয়ে যতেক কপিগণ।
সবাকারে চাহি বলে রাজা বিভীষণ।।
বিভীষণ বলে, শুন পবন-নন্দন।
মহী হরি লৈয়া গেল শ্রীরাম-লক্ষ্মণ।।
তারপর কহি কথা কর অবধান।
সুড়ঙ্গের দ্বার তবে দেখে হনূমান।।
সেই দ্বারে হনূমান প্রবেশ করিল।
রাম রাম জপিয়া পাতালে চলি গেল।।
প্রবেশিয়া পাতালে দেখিল আদি গড়।
লম্ফ দিয়া ছাড়াইল পবন-কোঙর।।
তবে উত্তরিল গিয়া পুরীর ভিতর।
মায়া করি ফিরে হনূ পুরীর মাঝার।।
সরোবর তীরে এক দেখে তরুবর।
চড়িয়া বসিল বীর তাহার উপর।।
মরকট-বেশে হনূ রহেন তথায়।
নারীগণ জল নিতে তথাকারে যায়।।
হণূমানে দেখে তবে যত নারীগণ।
পাতালে বানর আইল কিসের কারণ।।
সেই সঙ্গে বুড়ী এক ছিল তার মাঝ।
সেই বুড়ি বলে হৈল বড়ই অকাজ।।
নর-বানর যবে এথা একত্র হইবে।
নিশ্চয় জানিহ মহী অবশ্য মরিবে।।
নররূপ দুই শিশু ধরিয়া আনিল।
তারপর দেখ এই বানর আইল।।
নর-বানর দুই দেখ হৈল এক ঠাঁই।
বুঝিলাম মহীর নিস্তার আর নাই।।
বুড়ীর বচন শুনি হনূ আনন্দিত।
গাছ হৈতে নামি বীর চলিল ত্বরিত।।
শ্বেত মাছি হৈয়া বৈসে কলসী-উপর।
তবে হনূমান গেল দেবীর গোচর।।
দেবীকে দেখিয়া হনূ বলয়ে বচন।
তুমি বলি লবে বুঝি শ্রীরাম-লক্ষ্মণ।।
এত শুনি মহাদেবী হৈলা চমৎকার।
দেবী বলে, শুন বাছা পবন-কুমার।।
কার শক্তি মারিবেক শ্রীরাম-লক্ষ্মণ।
এত শুনি চলি গেলা বীর হনূমান।।
কর্ম্মকার ঘরে গেলা পবন-নন্দন।
কর্ম্মকার ঘরে দেখে খড়্গ দেয় শাণ।।
তথা হৈতে উঠিয়া চলিল হনূমান।
তবে বীর উপনীত মালাকার-স্থান।।
মালা গাঁথে কান্দে আর রাম রাম বলে।
এইমত মালাকার কান্দয়ে সকলে।।
তারে তবে পুছিলেন পবন-তনয়।
কেনে বা রোদন কর কোন্ দুঃখ হয়।।
তোমার রোদনে মোর স্থির নহে হিয়া।
দেখিয়া রোদন চিত্তে ব্যাকুলিতে হৈয়া।।
মালাকার বলে, শুন বৃদ্ধ কলেবর।
দুই যে বালক আনে পাপী দুরাচার।।
তারে বলি দিবে এই মনেতে ভাবিয়া।
তার লাগি কান্দি, মোর স্থির নাহি হিয়া।।
হনূমান বলে, মহী মরিবে কিমতে।
মালী বলে, মহীমৃত্যু হনূমান হাতে।।
এত শুনি হনূমান তার তরে কয়।
তোরে রাজা করি মহ মারিব নিশ্চয়।।
পুনঃ হনূমান বীর মাছিরূপ ধরে।
প্রবেশ করিল হনূ মহী-অন্তঃপুরে।।
যেই ঘরে বান্ধা আছে ভাই দুইজন।
তথাকারে হনুমান করিল গমন।।
মহী হরি আনিয়াছে পাতাল-ভুবন।
এত শুনি মূর্চ্ছিত হৈল দুইজন।।
এখন কি করিব বলহ হনূমান।
কেমনে রাক্ষস হতে পাই পরিত্রাণ।।
তবে হনূমান বলে যোড় করি হাত।
আমি যে কহিয়ে তাহা শুন রঘুনাথ।।
তারপরে দোঁহারে শিখায় হনূমান।
যখন বলিবে তোমা করিতে প্রণাম।।
বলিবে রাজার পুত্র প্রণাম না করি।
আপনি দেখাও যদি মোরে কৃপা করি।।
ইহা বলি হনূমান শিখাইল বাণী।
তথা হৈতে গমন করিল বীরমণি।।
রামের চরণে বীর করিল প্রণাম।
দেবীর সদনে আসি রহে হনূমান।।
রজনী প্রভাত হৈল প্রত্যূষ বিহার।
আনন্দিত মহীবীর করে স্নান দান।।
বিপ্রগণ বসি পূজে দেবীর চরণ।
রাজা আসি পূজাতে বসিলা ততক্ষণ।।
সুগন্ধি চন্দন দেয় নানা উপহারে।
নানা পুষ্পগণ দেয় ঘটের উপরে।।
নহূমান ঘটে আসি অধিষ্ঠান হৈল।
ঘন ঘন ঘট নড়ে পড়ে পুষ্পজল।।
মহী বলে দেবী আসি হৈলা অধিষ্ঠান।
শীঘ্রগতি আনাইল নর-বলিদান।।
স্নান করাইয়া তবে আনে দুই ভাই।
রূপের তুলনা দিতে ত্রিভুবনে নাই।।
দিব্য বস্ত্র পরাইল মালা দিল গলে।
শত কোটী চন্দ্রোদয় বদন কমলে।।
রামের রূপেতে চক্ষু পালটিতে নারি।
ভয়ে কালী-প্রতিমা কাপঁয়ে থরথরি।।
এত দেখি মহী তবে শ্রীরামের বলে।
মনঃসিদ্ধ হয় তবে দেবীরে পূজিলে।।
শীঘ্রগতি দণ্ডবত করহ দেবীরে।
ইহারে পূজিয়া ইন্দ্র স্বর্গভোগ করে।।
এ কথা শুনিয়া রাম লক্ষ্মণেরে চাই।
লক্ষ্মণ বলেন, কভু প্রণাম না হই।।
যেমত প্রকারে লোক দণ্ডবত করে।
তেমত প্রকারে তুমি দেখাহ আমারে।।
এত শুনি মহীবীর মনে মনেহাসে।
নহে কেন দশরথ দিবে বনবাসে।।
তবে মহী মাথাপাড়ে ভূমির উপরে।
সেইক্ষণে হনূমান নিজ মূর্ত্তি ধরে।।
যেই খড়্গ ছিল দেখ মহী বিদ্যমান।
যেই খড়্গ হাতে নিল বীর হনূমান।।
দেবীরে চাহিয়া বীর তবে বলে বাণী।
আপনার বলিদান লহত আপনি।।
খড়্গ হাতে হনূমান শুন তার কথা।
এক চোটে কাটি পাড়ে মহীবীর মাথা।।
পড়িল ত মহীবীর হইল সংহার।
শুনিয়া তাহার নারী আইল যুঝিবার।।
হাতে ধনু করি আইল হনূর গোচর।
নানাজাতি বাণ মারে হনূর উপর।।
মহাক্রোধে হনূ মারে মুষ্টিকের ঘাত।
মুষ্টিকের ঘাতে রাণীর হৈল গর্ভপাত।।
সেই গর্ভে জন্মে বীর তার অহি নাম।
হাতে ধনু করি আইল করিতে সংগ্রাম।।
ক্ষণে ক্ষণে বাণ মারে হনূর উপর।
বাণে বাণে হনূমানে কৈল জরজর।।
তবে হনূমান তারে সাপটিয়া ধরে।
ধরিতে না পারে সেই পিছলিয়া পড়ে।।
তবে বীর হনূমান ভাবে মনে মন।
পিতা পবনেরে তবে করিল স্মরণ।।
পুত্র হেতু পবন করিলা মহারোষ।
মহাক্রোধে কৈল দেব দারুণ বাতাস।।
ধূলা উড়াইয়া দিল তাহার উপরে।
তবে হনূমান তারে ধরিল সত্বরে।।
চরণে ধরিয়া তারে ঘন দেয় পাক।
পাকে পাকে ফিরে যেন কুমারের চাক।।
আছাড়িয়া ফেলে তারে ভূমির উপরে।
মরিল মহীর পুত্র গেল যমঘরে।।
তার পরে রাজ্যে রাজা হৈল দ্বিজবর।
পাত্র করি সেই রাজ্যে দিল মালাকার।।
রাম আজ্ঞা বিপ্র রাজা পাত্র মালাকার।
কর্ম্মকারে হনুমান দিল ঘমঘর।।
পাতাল হইতে তব বীর হনুমান।
রাম-লক্ষ্মণ কান্ধে করি করিল পয়াণ।।
হেনকালে ভদ্রকালী বলেন বচন।
আমারে লইয়া চল পবন-নন্দন।।
এতেক শুনিয়া হনু হাসিয়া তখন।
মাথে করি ভদ্রকালী কান্ধে দুইজন।।
লঙ্কাতে আইলা রাম-লক্ষ্মণের সহিত।
দেখিয়া সকল সৈন্য হৈল আনন্দিত।।
তবে বীর হনুমান দেবীরে লইয়া।
ক্ষীরগ্রামে রাখে তারে স্থাপন করিয়া।।
তবে হনুমান আইলা লঙ্কার ভবন।
রামজয় বলি ডাকে যত কপিগণ।।
সিংহনাদ করি সবে বলে রামজয়।
শুনিয়া রাবণ রাজা কম্পিত হৃদয়।।
এইমতে রাম-লক্ষ্মণ লঙ্কাতে আইলা।
শুনিয়া রাবণ রাজা প্রমাদ গণিলা।।
জানিল নিশ্চয় মহী ত্যজিল জীবন।
পুত্রশোকে দশানন করয়ে রোদন।।
তবে ত রাবণ রাজা ভাবে মনে মনে।
মহী পুত্র মৈল আর জয় নাহি রণে।।
যেন মহী অধর্ম্ম করিল বহুতর।
তেমতি মরিয়া গেল শমনের ঘর।।
সেই মত দুর্য্যোধন তোমারে হিংসিল।
হিংসার কারণে সেই সবংশে মরিল।।
তোমার নাহিক দোষ হিংসার কারণ।
বংশের সহিত কুরু হইল নিধন।।
চিত্ত স্থির কর রাজা না কর রোদন।
ত্যজহ সন্তাপ, শুন আমার বচন।।
মহীর আখ্যান আমি কহিনু তোমারে।
সেইমত দুর্য্যোধন অধর্ম্মেতে মরে।।
মহাভারতের কথা অমৃত-লহরী।
শুনিলে অধর্ম্ম খণ্ডে হেলে ভব তরি।।
মস্তকে বন্দিয়া দ্বিজগণ পদরজ।
কহে কাশীদাস গদাধর দাসাগ্রজ।।