০৮৭. দ্রৌপদীর স্বয়ম্বর

পাঞ্চাল-নগরে পঞ্চ পাণ্ডুর তনয়।
কুম্ভকার-গৃহ মধ্যে করেন আশ্রয়।।
ভিক্ষা করি আনি তথা ব্রাহ্মণের বেশে।
হেনমতে কত দিন থাকেন সে দেশে।।
স্বয়ম্বর-সজ্জা করে পাঞ্চাল-ঈশ্বর।
অদ্ভুত করিল লক্ষ্য লোকে অগোচর।।
যখন জন্মিল কন্যা দ্রৌপদী সুন্দরী।
তখন করিল চিত্তে পাঞ্চালাধিকারী।।
এ কন্যার যোগ্য বর বীর ধনঞ্জয়।
এ কন্যার যোগ্য পাত্র আর কেহ নয়।।
জতুগৃহে মরিল যে পাণ্ডুর নন্দন।
হেনমতে ধ্বনি হৈল, ঘোষে সর্ব্ব জন।।
দ্রুপদ বলিল, ইহা চিত্তে নাহি লয়।
দেব হইতে জন্মে পঞ্চ পাণ্ডুর তনয়।।
বহুদেশে দূত গিয়া কৈল অন্বেষণ।
না পাইল পাণ্ডবেরে, চিন্তিত রাজন।।
হেন ধনু কৈল, যাহা কেহ নাহি দেখে।
শূন্যেতে রাখিল লক্ষ্য অসম্ভব লোকে।।
মধ্যপথে যন্ত্র রাখে মন্ত্র-বিরচিতে।
পঞ্চশর সহ ধনু থুইল সভাতে।।
এই ধনুঃশর এই যন্ত্র-রন্ধ্র-পথে।
যে বিন্ধিবে লক্ষ্য, কন্যা ভজিবে তাহাতে।।
করিল দ্রুপদ-রাজা এইমত পণ।
রাজগণে সর্ব্বত্র করিল নিমন্ত্রণ।।
সাগর-অবধি যত রাজগণ বৈসে।
সসৈন্যে আইল সবে পাঞ্চালের দেশে।।
রথ অশ্ব পদাতিক না যায় গণনা।
চতুর্দ্দিকে মহাশব্দ বিবিধ বাজনা।।
জল স্থল পর্ব্বত কানন নদ নদী।
দশদিক যুড়িয়া আইসে নিরবধি।।
ধ্বজ-ছত্র পতাকায় ঢাকিল মেদিনী।
লোকমুখে কলরব কিছুই না শুনি।।
নগর ঈশানভাগে পাঞ্চাল-ঈশ্বর।
রচিল বিচিত্র সভা লোকে মনোহর।।
চতুর্দ্দিকে পরিসর মঞ্চ বিরচিল।
বিবিধ বসন মণি রতনে মণ্ডিল।।
কৈলাস-শিখর যেন দেখিতে সুন্দর।
রাজগণ রহিবারে বিরচিল ঘর।।
সুবর্ণ রজত মণি মুকুতা প্রবাল।
মঞ্চ বেষ্টি বিরচিল সুবর্ণের জাল।।
গুবাক কদলী রোপিলেক স্থানে স্থানে।
উচ্চ নীচ কাটি একই সমানে।।
চন্দনের ছড়াতে নাশিল সব ধূলি।
সুগন্ধি-কুসুম-গন্ধে মত্ত সব অলি।।
স্থানে স্থানে রাখিল বিচিত্র সিংহাসন।
বিচিত্র উত্তম শয্যা, বিচিত্র বসন।।
চর্ব্ব চুষ্য লেহ্য পেয় লিখনে না যায়।
বহুদিনে করিল সঞ্চয় তাহা রায়।।
বসিল যতেক রাজা যথাযোগ্য স্থানে।
পুরন্দর-সভা যেন অমর ভুবনে।।
মঞ্চের উপরে বসি যত রাজগণ।
নানাচিত্র-বিচিত্র বিবিধ বিভূষণ।।
শ্রবণে কুণ্ডল-মণি, গলে মুক্তাহার।
মাথায় মুকুট, অঙ্গে নানা অলঙ্কার।।
রূপবন্ত কুলবন্ত বলে মহাবলী।
সর্ব্ব শাস্ত্রে বিশারদ সর্ব্ব-গুণশালী।।
আইল যতেক রাজা, না যায় বর্ণনা।
চতুরঙ্গ-দলাদি লইয়া নিজ সেনা।।
ধৃতরাষ্ট্র নৃপতির শতেক কুমার।
দুর্য্যোধন দুঃশাসন সহ যত আর।।
ভীষ্ম দ্রোণ দ্রোণী কর্ণ নৃপ সোমদত্ত।
কোটি কোটি রথ অশ্ব পদাতিক মত্ত।।
জরাসন্ধ জয়সেন রাজা চক্রসঙ্গ।
মৎস্যরাজ শল্য শাল্ব সিন্ধুরাজ অঙ্গ।।
শকুনি সৌবল বৃহদ্বল মহাবীর।
গান্ধার-রাজার পুত্র যুদ্ধে মহাধীর।।
অংশুমান্ চেদিপাল কাশীদণ্ডধর।
পশুপাল শেতশঙ্খ বিরাট উত্তর।।
প্রতিভূতি পুণ্ডরীক বাসুদেব রাজা।
রুক্মাঙ্গদ রুক্মরথ রুক্মী মহাতেজা।।
শত ভাই কলিঙ্গ ‍নৃপতি অনূগত।
বৃন্দ অনুবৃন্দ চিত্রসেন জয়দ্রথ।।
নীলধ্বজ শ্রীবৎস রাজা সথাজিত।
চিত্র উপজিত দূর্ব্বানন্দের সহিত।।
বৃহৎক্ষত্র উলূক কৈতব জলসন্ধ।
ভগদত্ত চক্রসেন শূরসেন চন্দ্র।।
চিত্রাঙ্গদ শুভাঙ্গদ শিরসিবাহন।
মহারাজ শল্য এল মদ্রের নন্দন।।
ভূরি ভূরিশ্রবা কেতু সুশর্ম্মা সঞ্জয়।
গোশৃঙ্গ বাহ্লীক দীর্ঘস্বর প্রাজ্ঞোদয়।।
যথাযোগ্য স্থানেতে বসিল পঞ্চোপর।
শরতের কালে যেন শোভে শশধর।।
দ্রৌপদীর স্বয়ম্বর জানিয়া অমর।
দেখিবারে ইন্দ্র সহ আইল সত্বর।।
ইন্দ্র যম কুবের বরুণ হুতাশন।
দেবতা তেত্রিশকোটি গন্ধর্ব্ব চারণ।।
সিদ্ধ বিদ্যাধর ঋষি অপ্সর অপ্সরী।
নৃত্য-গীত বাদ্যেতে যেমন স্বর্গপুরী।।
গরুড়ারোহণে আইলেন জগন্নাথ।
পাণ্ডব-বিবাহ হেতু সপ্তবংশ সাথ।।
কামপাল কামদেব কামের নন্দন।
গদ শাম্ব চারুদেষ্ণ সাত্যকি সারণ।।
বিদুরথ কৃতবর্ম্মা উদ্ধব অক্রূর।
পৃথুঝিল্লি পিণ্ডারক শঙ্কু উশীনর।।
শূন্যে রহিলেন খগপতি আরোহণে।
করিলেন শঙ্খধ্বনি স্বয়ং নারায়ণে।।
পাঞ্চজন্য-শঙ্খনাদে ত্রৈলোক্য পূরিল।
পৃথিবীর যত বাদ্য, সব লুকাইল।।
যত বিজ্ঞগণ সভামধ্যে বসে ছিল।
গোবিন্দ আগত দেখি সম্ভ্রমে উঠিল।।
ভীষ্ম দ্রোণ কৃপ সত্যসেন সত্রাজিত।
শল্য ভূরিশ্রবা ক্রথ কৌশিক সহিত।।
কৃতাঞ্জলি করি সবে কৈল দণ্ডবত।
দেখিয়া হাসিল দুষ্ট রাজগণ যত।।
শিশুপাল আর শাল্ব রুক্মী দন্তবক্র।
জরাসন্ধ সহ যত রাজা দুষ্টচক্র।।
কেহ বলে কারে সবে করিলা প্রণাম।
দেব কি পশুত্ব খণ্ডি পূরাইবে কাম।।
করতালি দিয়া হাসি বলে শিশুপাল।
সবা হৈতে ভাল শঙ্খ বাজায় গোপাল।।
তাই সে দ্রুপদ বরিয়াচেন ইহারে।
বাদ্যকারগণ সহ বাজাবার তরে।।
জরাসন্ধ বলে, ভীষ্ম তুমি জ্ঞানবান।
তোমা হেন জন কেন হইলা অজ্ঞান।।
এ সভার মধ্যেতে করহ হেন কর্ম্ম।
গোপ-সুতে প্রণাম কি ক্ষত্রিয়ের ধর্ম্ম।।
নন্দ-গোপ-গৃহেতে আছিল চিরকাল।
গোপ-অন্ন খাইয়া রাখিল গরুপাল।।
সর্ব্বলোকে-খ্যাত ইহা ভারত ভূমিতে।
জানিয়া এমন কর্ম্ম করিলা কি মতে।।
ভীষ্ম বলিলেন, এত তত্ত্ব নাহি জানি।
পুরাতন জ্ঞানী বৃদ্ধ লোকমুখে শুনি।।
গোপালের চরিত্র বেদের অগোচর।
অন্য কে কহিতে পারে ত্রৈলোক্য-ভিতর।।
ব্রহ্মাণ্ড বলি যে এক চতুর্দ্দশ লোকে।
বিরাট পুরুষ ধরে এক লোমকূপে।।
তিল অর্দ্ধকোটি যে ব্রহ্মাণ্ড ধরে গায়।
এমত বিরাট্ যার নিঃশ্বাসে প্রলয়।।
সেই প্রভু আপনি গোপাল অবতার।
মায়াতে মনুষ্যদেহ, দেব নিরাকার।।
লীলায় হইল যাঁর চরাচর জন।
নাভি-কমলেতে স্রষ্টা করিল সৃজন।।
ললাটে জন্মিল ধাতা, চক্ষুতে তপন।
মনেতে জন্মিল চন্দ্র, নিশ্বাসে পবন।।
ব্রহ্ম কীট হইতে যতেক মহীপাল।
সর্ব্বভূতে মায়ারূপে আছয়ে গোপাল।।
হর্ত্তা কর্ত্তা বিধাতা পুরুষ সনাতন।
সেই সে মস্তকে বন্দে গোপাল-চরণ।।
পঞ্চ-মুণ্ডে অনুক্ষণ প্রণমে মহেশ।
চারি-মুণ্ডে বিধাতা সহস্র-মুণ্ডে শেষ।।
হেনজনে প্রণমিতে আমি কিহে গণি।
অজ্ঞানেতে হেন কথা কহ নৃপমণি।।
ভীষ্মের বচন শুনি হাসে জরাসন্ধ।
কোন্ মূঢ়-বাক্যে তুমি পড়িয়াছ ধন্ধ।।
যখন মারিল দুষ্ট আমার জামাতা।
তখন না শুনিলাম এ দুরন্ত কথা।।
ভয়েতে মথুরা ত্যজি গেল সিন্ধুতীরে।
সেইত দিবসে মাত্র পলাইল ডরে।।
কহ ভীষ্ম এই যদি দেব নারায়ণ।
আমার ভয়েতে পলাইল কি কারণ।।
ভীষ্ম বলিলেন, সে সকল জানি আমি।
না ভাবিয়া বলি, চিত্তে না ভাবিহ তুমি।।
পূর্ব্বে ছিলে রাজা তুমি দৈত্য-অধিপতি।
কৃষ্ণ-হস্তে মরিলে পাইবে দিব্যগতি।।
সে কারণে নারায়ণ তোমা না মারিল।
না জানিয়া বলভদ্র মারিতে চাহিল।।
শূন্যবাণী শুনি তোমা না মারিল প্রাণে।
অষ্টাদশ বার হারি পলাইল রণে।।
এত শুনি জরাসন্ধ ক্রোধে রক্ত-আঁখি।
পুনশ্চ বলেন ভীষ্ম ক্রোধমুখে দেখি।।
কি হেতু করহ তাপ মগধ-প্রধান।
এই আমি হেথা হৈতে যাই অন্য স্থান।।
কৃষ্ণ-নিন্দা স্থানে আমি তিলেক না থাকি।
নিন্দুকেরে মারি কিম্বা সে স্থান উপেক্ষি।।
এত বলি তথা হৈতে যান অন্য স্থান।
কাশীদাস বিরচিল শুনে পুণ্যবান।।