০৮৩. ধৃষ্টদ্যৃম্ন ও দ্রৌপদীর উৎপত্তি

হেনমতে দ্বিজগৃহে কত দিন যায়।
আচম্বিতে এক দ্বিজ আইল তথায়।।
বিবিধ দেশের কথা কহে তপোধন।
পঞ্চ পুত্র সহ কুন্তী করেন শ্রবণ।।
দ্বিজ বলে, করিলাম দেশ পর্য্যটন।
বহু নদী তীর্থক্ষেত্র না যায় গণন।।
দেখিলাম আশ্চর্য্য যে পাঞ্চাল নগরে।
মহোৎসব দ্রুপদ-কন্যার স্বয়ম্বরে।।
দ্রুপদ-রাজার কন্যা কৃষ্ণা নাম ধরে।
রূপে গুণে তুল্য নাহি পৃথিবী ভিতরে।।
অযোনি-সম্ভবা কন্যা জন্ম যজ্ঞ হৈতে।
যাজ্ঞসেনী নাম তাই বিখ্যাত জগতে।।
দ্রুপদের পুত্র এক রূপ গুণধাম।
দ্রোণে বিনাশিতে জন্ম, ধৃষ্টদ্যুন্ন নাম।।
এত শুনি জিজ্ঞাসেন পাণ্ডু-পুত্রগণ।
কহ শুনি দ্বিজবর ইহার কারণ।।
দ্বিজ বলে, পূর্ব্বে দ্রোণ দ্রুপদের মিত।
কত দিনে কলহ হইল আচম্বিত।।
অভিমানে গেল দ্রোণ হস্তিনা-নগরে।
অস্ত্র-শিক্ষা করালেন কৌরব-কোঙরে।।
শিক্ষা-অন্তে শিষ্যগণে দক্ষিনা মাগিল।
দ্রুপদ-রাজার বান্ধি আনিতে কহিল।।
কুন্তীপুত্র অর্জ্জুন গুরু-আজ্ঞা পাইয়া।
দ্রুপদ রাজারে বান্ধি দিলেন আনিয়া।।
অর্দ্ধরাজ্য দিয়া দ্রোণ হইলেন মিত।
মুক্ত করি দ্রুপদেরে দিলেন ত্বরিত।।
অভিমানে দ্রুপদে না রুচে অন্ন জল।
কেমনে মারিব চিন্তে দ্রোণ মহাবল।।
এই ত ভাবনা বিনা অন্য নাহি মন।
সদা গঙ্গাতীরে রাজা করেন ভ্রমণ।।
যাজ উপযাজ নামে দুই সহোদর।
বেদেতে বিখ্যাত দোঁহে ব্রাহ্মণ কোঙর।।
উপযাজে দ্রুপদ দেখিল এক দিনে।
বহু পূজা ভক্তি কৈল তাঁহার চরণে।।
বিনয়-মধুর ভাষে যুড়ি দুই কর।
উপযাজ প্রতি বলে পাঞ্চাল-ঈশ্বর।।
দশ কোটি ধেনু দিব অসংখ্য সুবর্ণ।
যাহা চাহ দিব আমি করি মনঃপূর্ণ।।
মম ইষ্টকর্ম্ম এই শুন মহাশয়।
দ্রোণ নামে আছে ভরদ্বাজের তনয়।।
অস্ত্রধারী তার তুল্য নাহি ক্ষিতিমাঝে।
পৃথিবীতে নাহি হেন তার সনে যুঝে।।
দ্বিতীয় পরশুরাম সম পরাক্রমে।
হেন বুদ্ধি কর, তারে জিনি যে সংগ্রামে।।
ক্ষত্রের অজেয় শক্তি হৈয়াছে তাহার।
তপ মন্ত্রবলে তার কর প্রতিকার।।
হেন যজ্ঞ কর, হয় আমার নন্দন।
তার ভুজবলে দ্রোণ হইবে নিধন।।
উপযাজ বলে মম এই যুক্তি লয়।
ব্রাহ্মণের বধ-কর্ম্ম উচিত না হয়।।
দ্বিজের এতেক বাক্য শুনিয়া রাজন।
পুনঃ বহু স্তুতি করি বলিল বচন।।
দ্রুপদের বিনয় দেখিয়া দ্বিজবর।
প্রসন্ন হইয়া বলে, শুন দণ্ডধর।।
মম জ্যেষ্ঠ ভাই যাজ পরম তপস্বী।
বেদেতে পারগ, সদা অরণ্য-নিবাসী।।
প্রার্থনা তাঁহার স্থানে করহ রাজন।
তিনি করিবেন তব দুঃখ-বিমোচন।।
উপযাজ-বাক্যে গেল যাজের সদন।
প্রণমিয়া সকল করিল নিবেদন।।
সদয় হইয়া যাজ করিল স্বীকার।
যজ্ঞ আরম্ভিল তবে পৃষত ‍কুমার।।
রাণী সহ ব্রত আচরিল নরবর।
যজ্ঞ-পূর্ণ দিতে জন্ম হইল কোঙর।।
অগ্নিবর্ণ হৈল বীর, হাতে ধনুঃশর।
অঙ্গেতে কবচন ধরে, মাথায় টোপর।।
সব্যহস্তে ধরে খড়্গ লোকে ভয়ঙ্কর।
পুত্র দেখি আনন্দিত পাঞ্চাল-ঈশ্বর।।
তবে সেই যজ্ঞমধ্যে কন্যার উৎপত্তি।
জন্মমাত্রে দশদিক করে মহাদ্যুতি।।
নীলোৎপল-আভা অঙ্গে অমর-বর্ণিনী।
নিষ্কলঙ্ক ইন্দু- জ্যোতি পীনঘনস্তনী।।
অঙ্গের সৌরভ এক যোজন ব্যাপিত।
সুরাসুর যক্ষ রক্ষ গন্ধর্ব্ব-বাঞ্ছিত।।
পুত্র কণ্যা দুই জনে যজ্ঞেতে জন্মিল।
হেনকালে আকাশে আকাশবাণী হৈল।।
এ কন্যার জন্ম হৈল ভার নিবারণে।
ইহা হৈতে ক্ষত্র সব হইবে নিধনে।।
কুরুবংশ ক্ষয় হবে এই কন্যা হৈতে।
এই পুত্র জন্ম হৈল দ্রোণ বিনাশিতে।।
এতেক আকাশবাণী শুনি সর্ব্বজন।
জয় জয় শব্দ কৈল পাঞ্চালের গণ।।
যত বীর যোদ্ধাগণ ছাড়ে সিংহনাদ।
আনন্দে দ্রুপদ রাজ ত্যজিল বিষাদ।।
কন্যা তনয়ের নাম থুইল তখন।
ধৃষ্টদ্যুন্ন বলিয়া ডাকিল সর্ব্বজন।।
কৃষ্ণ অঙ্গে কৃষ্ণা নাম থুইল নন্দিনী।
পিতৃনামে দ্রৌপদী, যজ্ঞের যাজ্ঞসেনী।।
সম্প্রতি হইবে সে কন্যার স্বয়ম্বর।
দেখিতে আইল যত রাজ-রাজ্যেশ্বর।।
দ্বিজমুখে শুনিয়া এতেক সমাচার।
যাইতে হইল চেষ্টা তথা সবাকার।।
পুত্রগণ-চিত্ত জানি ভোজের নন্দিনী।
সবাকার প্রতি দেবী কহেন আপনি।।
বহুদিন করিলাম এস্থানে বসতি।
একস্থানে বহুদিন নাহি শোভে স্থিতি।।
পূর্ব্বমত ভিক্ষা ইথে না মিলে এখন।
বড় দয়াবন্ত শুনি পাঞ্চাল রাজন।।
চল যাব তথাকারে যদি লয় মন।
শুনিয়া স্বীকার করিলেন ভ্রাতৃগণ।।
পুত্র সহ কুন্তীদেবী করেন বিচার।
হেনকালে আইলেন ব্যাস সদাচার।।
প্রণাম করেন তাঁরে ভোজের নন্দিনী।
পঞ্চ ভাই প্রণমেন লোটায়ে ধরণী।।
আশীর্ব্বাদ করিলেন মুনি সবাকারে।
পরস্পর মিষ্টবাক্য হৈল শিষ্টাচারে।।