০৮১. হিড়িম্ব রাক্ষস বধ

ভীম-হিড়িম্বাতে হয় কথোপকথন।
দূরে থাকি হিড়িম্ব করয়ে নিরীক্ষণ।।
বসিয়াছে হিড়িম্বা ভীমের বাম দিকে।
ভুবন-মোহন রূপ বিদ্যুৎ ঝলকে।।
কবরী বেড়িয়া দিব্য কুসুমের মালে।
মাণিক প্রবাল মুক্তাহার শোভে গলে।।
বসন ভূষণ দিব্য নূপুর কঙ্কণ।
স্বর্গ-বিদ্যাধরী মোহে নবীন যৌবন।।
প্রিয়ভাষে যেমন দম্পতি কথা কয়।
দেখিয়া হিড়িম্ব ক্রোধে জ্বলে অতিশয়।।
ভগিনীরে ডাক দিয়া বলয়ে হিড়িম্ব।
এই হেতু এতক্ষণ তোমার বিলম্ব।।
ধিক্ তোর জীবনে কুলের কলঙ্কিনী।
মনুষ্য-স্বামীতে লোভ করিলি পাপিনি।।
মম ক্রোধ তোমার হইল পাসরণ।
মম ভক্ষ্যে ব্যাঘাত করিলি সে কারণ।।
এই হেতু আগে তোরে করিব সংহার।
পশ্চাতে এ সব জনে করিব আহার।।
এত বলি যায় হিড়িম্বারে মারিবারে।
নয়ন লোহিত, দন্তকড়মড় করে।।
ভীম বলে, রাক্ষস রে তোর লাজ নাই।
ভাগিনীকে পাঠাইলি পুরুষের ঠাঁই।।
তুই পাঠাইলি, তেঁই আইল হেথায়।
মদনের বশ হৈয়া ভজিল আমায়।।
কামপত্নী আমার হইল তোর স্বসা।
মোর বিদ্যমানে দুষ্ট বলিস দুর্ভাসা।।
মরিবারে চাহ রে করিস্ অহঙ্কার।
এইক্ষণে পাঠাইব যমের দুয়ার।।
মাতা ভ্রাতা শুইয়া নিদ্রায় যে বিহ্বল।
নিদ্রাভঙ্গ হইবেক না করিস্ গোল।।
ভীমের বচনেতে রাক্ষস নাহি থাকে।
ঊর্দ্ধবাহু যায় মারিবারে হিড়িম্বাকে।।
হাসিয়া কুন্তীর পুত্র দুই হাতে ধরে।
এক টানে লয় অষ্ট-ধনুক অন্তরে।।
মহাবল রাক্ষস আপন হাতে কাড়ি।
বৃকোদরে ধরিলেক করিয়া আঁকাড়ি।।
বায়ুর নন্দন ভীম অতি ভয়ঙ্কর।
পরম আনন্দ যার পাইলে সমর।।
মত্ত মৃগপতি যেন ক্ষুদ্র মৃগে ধরে।
পুনরপি টানিয়া লইল কতদূরে।।
দুই জনে টানাটানি ধরি ভূজে ভূজে।
শুণ্ডে শুণ্ডে টানাটানি যেন গজে গজে।।
দুই মেষ যেন মুণ্ডে মুণ্ডে তাড়াতাড়ি।
সঘনে নিশ্বাস ছাড়ে দন্ত কড়মড়ি।।
দুই মত্ত সিংহ যেন করে সিংহনাদ।
মেঘের নিঃস্বন যেন বজ্রের নিনাদ।।
দোঁহাকার আস্ফালনে ভাঙ্গে ‍বৃক্ষগণ।
পলায় কাননবাসী ত্যজিয়া কানন।।
কাননে পূরিল শব্দ দোঁহার গর্জ্জনে।
নিদ্রাভঙ্গ হইয়া উঠিল পঞ্চজনে।।
বসিয়াছে হিড়িম্বা নিন্দিতা বিদ্যাধরী।
দেখিয়া বিস্মিত হৈল ভোজের কুমারী।।
আশ্চর্য্য দেখিয়া কুন্তী উঠি শীঘ্রগতি।
মৃদুভাষে জিজ্ঞাসেন হিড়িম্বার প্রতি।।
কে তুমি, কোথা হৈতে আইলা গো হেথা।
অপ্সরী নাগিনী কিবা বনের দেবতা।।
হিড়িম্বা প্রণাম করি কুন্তী প্রতি বলে।
জাতিতে রাক্ষসী আমি, নিবাস এস্থলে।।
এই বন-নিবাসী হিড়িম্ব নিশাচর।
মহাযোদ্ধা বীর সে আমার সহোদর।।
পঞ্চ পুত্র সহ তোমা ধরি লইবারে।
ভাই মোরে পাঠাইয়া দিল হেথাকারে।।
পরম সুন্দর দেখি তোমার তনয়।
কামে বশ হৈয়া আমি ভজিনু তাহায়।।
বিলম্ব দেখিয়া হেথা আসে মোর ভাই।
তোমার পুত্রের সহ যুঝে দেখ তাই।।
হিড়িম্বার মুখে শুনি এতেক উত্তর।
চারি ভাই ভীম-স্থানে চলিল সত্বর।।
ভীম-হিড়িম্বের যুদ্ধ না যায় বর্ণনা।
যুগল পর্ব্বত-প্রায় দেখি দুই জনা।।
যুদ্ধ-ধূলি-ধূসর দোঁহার কলেবর।
কুজ্ঝাটিতে আচ্ছাদিল যেন গিরিবর।।
দুই ভিতে দোঁহাকারে টানে দুইজন।
নিশ্বাস-পবন ঝড়ে উড়ে বৃক্ষগণ।।
ডাক দিয়া যুধিষ্ঠির বলেন বচন।
রাক্ষসের ভয় ভাই না কর এখন।।
তোমা সহ রাক্ষসের হৈয়াছে বিবাদ।
নিদ্রায় ছিলাম, এত না জানি প্রমাদ।।
সবে মিলি রাক্ষসেরে করিব সংহার।
এত শুনি বলে ভীম পবন-কুমার।।
কি কারণে সন্দেহ করহ মহাশয়।
এইক্ষণে বিনাশিব রাক্ষস দুর্জ্জয়।।
পথিক লোকের প্রায় দেখ দাণ্ডাইয়া।
এত বলি দিল লাফ ভুজ প্রসারিয়া।।
অর্জ্জুন বলেন, বহু করিলে বিক্রম।
রাক্ষসের ‍যুদ্ধে বহু হৈল পরিশ্রম।।
বিশ্রাম করহ তুমি থাকিয়া অন্তরে।
আমি বিনাশিব ভাই দুষ্ট নিশাচরে।।
অর্জ্জুন-বচনে ভীম অধিক কুপিল।
চুলে ধরি হিড়িম্বেরে ভূমিতে ফেলিল।।
চড় আর চাপড় মুষ্টিক পদাঘাত।
পশুবৎ করি তারে করিল নিপাত।।
মধ্যদেশ ভাঙ্গিয়া করিল দুইখান।
দেখাইল নিয়া সব ভ্রাতৃ-বিদ্যমান।।
পরস্পর আলিঙ্গন পঞ্চ সহোদরে।
প্রশংসিল ভ্রাতৃ-সব বীর বৃকোদরে।।
অর্জ্জুন বলিলেন, চাহিয়া যুধিষ্ঠিরে।
এই ত নিকটে গ্রাম আছে নহে দূরে।।
এই সমাচার যদি শুনে কোন জন।
লোক-মুখে বার্ত্তা তবে পাবে দুর্য্যোধন।।
সে কারণে ক্ষণেক না রহিতে যুয়ায়।
শীঘ্র চল অন্য স্থান ত্যজিয়া হেথায়।।
এই বিবেচনাতে পাণ্ডব পঞ্চজন।
মাতা সহ শীঘ্রগতি করয়ে গমন।।
হিড়িম্বা চলিল তবে কুন্তীর সংহতি।
হিড়িম্বা দেখিয়া ক্রোধে বলয়ে মারুতি।।
সহজে রাক্ষস-জাতি নানা মায়া ধরে।
ধরিয়া মোহিনী বেশ ভাণ্ডে সবাকারে।।
আপন স্বভাব কভা ছাড়িতে না পারে।
সময় পাইলে আমা পারে মারিবারে।।
সহজে ভ্রাতার বৈরী সাধিবার মনে।
আমার সংহতি এ চলিল সে কারণে।।
এক চড়ে করি তোরে ভ্রাতার সংহতি।
এত বলি মারিবারে যায় মহামতি।।
যুধিষ্ঠির বলে ভীম নহে ধর্ম্মাচার।
অবধ্যা স্ত্রীজাতি, কেন করিবা সংহার।।
মহাবল হিড়িম্বেরে করিলা সংহার।
তোমা বধিবারে শক্তি কি আছে ইহার।।
যুধিষ্ঠির বচনে রহিল বৃকোদর।
হিরিম্বা কুন্তীরে কহে হইয়া কাতর।।
কায়মনোবাক্যে মোর সত্য অঙ্গীকার।
তোমা বিনা গুরু মোর গতি নাহি আর।।
তোমারে না ভুলাইব প্রপঞ্চ বচনে।
স্ত্রীলোকের কর্ম্মপীড়া জানহ আপনে।।
কামবশ হৈয়া আমি অজ্ঞান হইনু।
আপন কুলের ধর্ম্ম ভ্রাতৃ ত্যাগ কৈনু।।
সব ত্যজি ভজিলাম তোমার নন্দনে।
এক্ষণে অনাথা আমি নিলাম শরণে।।
শরণাগতেরে ক্রোধ না হয় উচিত।
আপনি করহ দয়া দেখিয়া দুঃখিত।।
সদাই সেবিব আমি তোমার চরণে।
বহু সঙ্কটেতে আমি উদ্ধারিব বনে।।
আজ্ঞা কর আমা ভজিবারে বৃকোদরে।
নহিলে ত্যজিবে প্রাণ তোমার গোচরে।।
কৃতাঞ্জলি করি আমি করি যে বিনয়।
শুনি কুন্তীদেবী তবে দ্রবিল হৃদয়।।
কুন্তীদেবী ডাকিয়া বলিল যুধিষ্ঠিরে।
হিড়িম্বা আসক্ত হইল বৃকোদর বীরে।।
হিড়িম্বা কাতর-বাণী শুনিয়া তখন।
দয়াময় যুধিষ্ঠির কহেন তখন।।
সত্য বলে হিড়িম্বা, নাহিক ইথে আন।
শরণ লইলে জনে করি তার ত্রাণ।।
চলি যাহ হিড়িম্বা লইয়া বৃকোদরে।
যথাসুখে ক্রীড়া কর বনের ভিতরে।।
পুনরপি আমা সবা নিকটে মিলিবা।
আপনার সত্যবাক্য কভু না লঙ্ঘিবা।।
ধর্ম্মের পাইয়া আজ্ঞা অতি হৃষ্টমন।
ভীমে লয়ে হিড়িম্বা চলিল ততক্ষণ।।
শূন্যপথে লইয়া চলিল নিশাচরী।
নানা বন উপবনে ভ্রমে ক্রীড়া করি।।
যথা মন করে তথা যায় মুহূর্ত্তেকে।
নদ নদী মহাগিরি ভ্রময়ে কৌতুকে।।
নিত্য নিত্য নববেশ ধরে অনুপাম।
হেনমতে করে বহু ক্রীড়া অবিশ্রাম।।
কত দিনে ঋতুযোগ হৈল গর্ভবতী।
ভয়ঙ্কর-মূর্ত্তি পুত্র হইল উৎপত্তি।।
জন্মমাত্র যুবক হইল মহাবীর।
যক্ষ রক্ষ সুরাসুরে বিপুল শরীর।।
বিবিধ বরণ কচ ঘট স্থূলাকার।
ঘটোৎকচ নাম তেঁই ভীমের কুমার।।
মহাবলবান হৈল হিড়িম্বা নন্দন।
ইন্দ্রের একাঘ্নী শক্তির যে হবে ভাজন।।
ঘটোৎকচ মাতৃসহ মন্ত্রণা করিয়া।
কৃতাঞ্জলি কহে দোঁহে দণ্ডবৎ হৈয়া।।
আজ্ঞা কর, যাব আমি আপন আলয়।
স্মরিলে আসিব এই রহিল নিশ্চয়।।
আজ্ঞা পেয়ে মায়ে পুত্রে করিল গমন।
উত্তর দিকেতে গেল আপন ভবন।।
পাণ্ডবেরা চলিলেন সংহতি জননী।
এক স্থানে না থাকেন একই রজনী।।
পরিধান বল্কল শিরে শোভে জটাভার।
কোথাও ব্রাহ্মণ, কোথা তপস্বী-আকার।।
পথে লোকজন দেখি লুকায়েন বনে।
শীঘ্রগতি যান যথা কেহ নাহি জানে।।
ত্রিগর্ত্ত পাঞ্চাল মৎস্যাদি যত দেশ।
ভ্রমিলেন বহুক্লেশ করিয়া বিশেষ।।
হেনমতে ভ্রমেন যে পাণ্ডু- পুত্রগণ।
আচম্বিতে আইলেন ব্যাস তপোধন।।
ব্যাসে দেখি কুন্তীদেবী পুত্রের সহিতে।
কৃতাঞ্জলি প্রণমিলা দাঁড়ায়ে অগ্রেতে।।
ব্যাসের সাক্ষাতে কুন্তী করেন ক্রন্দন।
বহু বিলাপিয়া দেবী বলেন বচন।।
নিবর্ত্তিয়া তাঁরে ব্যাস কহিলেন বাণী।
আমারে কি বল ইহা, সব আমি জানি।।
অধর্ম্ম করিল ধৃতরাষ্ট্র-পুত্রগণ।
অনেক সঙ্কটেতে ভ্রমিলা বনে বন।।
যত কৈল, অগোচর নাহিক আমায়।
সে কারণে দেখিবারে এলাম হেথায়।।
দুঃখ না ভাবিহ বধূ স্থির কর মন।
অচিরে হইবে তব দুঃখ বিমোচন।।
তব পুত্রগণ গুণ না জানহ তুমি।
মম অগোচর নাহি সব জানি আমি।।
ধর্ম্মবলে বাহুবলে জিনিবে সকলে।
বিভব করিবে সাগরান্ত ভূমণ্ডলে।।
এক্ষণে যে বলি আমি শুন সাবধানে।
বহুদুঃখ পেলে বহু ভ্রমিয়া কাননে।।
নিকটে নগর এই একচক্রা নাম।
কতদিন রহি তথা করহ বিশ্রাম।।
গুপ্তবেশে এইখানে থাক ছয় জনে।
তাবৎ থাক আমি না আসি যত দিনে।।
এত বলি ব্যাস সবে লইয়া সংহতি।
নগরে ব্রাহ্মণ-গৃহে দিলেন বসতি।।
ব্রাহ্মণের গৃহে রহিলেন ছয় জন।
স্বস্থানে গেলেন ব্যাস মহা-তপোধন।।