০৭. শ্রীকৃষ্ণের দেহত্যাগ

যদুবংশে অবতরি,     বাসুদেব নাম ধরি,
কৌতুকেতে অবনীবিহারী।
যাঁহার কটাক্ষে হয়,     সৃজন পালন লয়,
ভকত-বৎসল চক্রধারী॥
যাঁর নাম গুণ গাই,     সর্ব্বপাপে ত্রাণ পাই,
নাহি রহে ‘শমনের ভয়।
ব্রহ্মশাপ লক্ষ্য করি,     ক্ষিতিভার ত্রাণ করি,
নিজ বংশ সব করি ক্ষয়॥
এক জন নাহি শেষ,     হৃদে চিন্তি হৃষীকেশ,
নিজ দেহ ত্যজিতে বিচারি।
প্রভাস তীর্থের তীরে,     উঠিলেন শাখী পরে,
বসিলেন শাখায় মুরারি॥
বসিয়া বৃক্ষের পর,     চিন্তিলেন চক্রধর,
নিজ দেহ ত্যাগের কারণ।
এক পদ তরু পর,     আরোহিয়া গদাধর,
নম্র করি দ্বিতীয় চরণ॥
আপনা চিন্তিয়া মনে,     বসি প্রভু শাখাসনে
মৌনেতে আছেন গদাধর।
নম্রকায় মন্দগতি,     ব্যাধ এল এক তথি,
মৃগয়ার ছলে একেশ্বর॥
জ্বরা ব্যাধ ধরে নাম,     ধনুর্ব্বেদে অনুপম,
হাতে ধরি দিব্য শরাসন।
মৃগ মারিবার ছলে,     ব্যাধ আসি সেই স্থলে,
দেখিলেক কৃষ্ণের চরণ॥
ধ্বজবজ্রাঙ্কুশপদ,     রবিবিম্ব কোকনদ,
শত পদ্ম যেন সুশোভন।
রাতুল চরণ দেখি,     ব্যাধসুত হৈল সুখী,
মৃগকর্ণ হেন নিল মন।
মুষলের শেষে পাই,     যেন বাণ নিরামাই,
দৈবে সেই বাণ নিল হাতে।
টানিয়া ধনুকখান,     সন্ধানিয়া মারে বাণ,
চরণ ভেদিল জগন্নাথে॥
বাণ মারি ব্যাধসুত,     বৃক্ষতলে এল দ্রুত,
অপূর্ব্ব দেখিয়া হৈল ভীত।
কিরীট কুণ্ডল হার,     নানা রত্ন অলঙ্কার,
হৃদয়ে কৌস্তুভ সুশোভিত॥
পাঞ্চজন্য সুদর্শন,     পাদপদ্ম সুশোভন,
চতুর্ভুজ গলে বনমালা।
শ্রীবৎসলাঞ্ছন দেহে,     মণি বিভূষণ তাহে,
নবমেঘে যেমন চপলা॥
অম্লান তুলসী-মাল,     আকর্ণ-লোচন ভাল,
অলকা তিলকা ভালে সাজে।
পরিধান পীতবাস,     মুখচন্দ্র সুপ্রকাশ,
কত শোভা কত দ্বিজরাজে॥
ভয়ার্ত্ত হইয়া ব্যাধ,     মাগি নিজ অপরাধ,
প্রণমিয়া প্রভুর চরণে।
কৃপাময় অবতরি,     অনাদি পুরুষ হরি,
তুমি সার এ তিন ভুবনে॥
আমি পাপী দুরাশয়,     অজ্ঞানেতে মূর্ত্তিময়,
অপরাধ করিনু গোঁসাই।
শুন প্রভু চক্রপাণি,     যে কর্ম্ম করিনু আমি,
আমার নিষ্কৃতি কভু নাই॥
শুনিয়া ব্যাধের বাণী,     আশ্বাসেন চক্রপাণি,
শুন ব্যাধ না করিহ ভয়।
মম দেহ ত্যাগকালে,     নয়নেতে নিরখিলে,
স্বর্গে যাবে কহিনু নিশ্চয়॥
রামচন্দ্র অবতারে,     পিতৃসত্য পালিবারে,
প্রবেশিনু অরণ্য ভিতর।
সীতা নামে মম নারী,     রাবণ লইল হরি,
অন্বেষিতে দুই সহোদর॥
সাক্ষৎ হইল বনে,     আর চারি কপিসনে,
সখা হৈল সহিত আমার।
বধ করি বলিরাজা,     সুগ্রীবে করিনু রাজা,
ছিলে তুমি বালির কোঙর॥
মারিয়া লঙ্কার পতি,     উদ্ধারিনু সীতাসতী,
দিতে বর যাচিনু তোমারে।
পিতৃবৈরি মারিবারে,     বর মাগি নিলা মোরে,
আমিও ছিলাম অঙ্গীকার॥
সেই প্রয়োজন ফলে,     জন্ম হৈল ব্যাধকুলে,
মুক্ত হ’য়ে যাহ স্বর্গপুরে।
হেনকালে আচম্বিত,     পুষ্পবৃষ্টি অপ্রমিত,
রথ এল ব্যাধের গোচরে॥
চাহিয়া গোবিন্দপদ,     রথ আরোহিয়া ব্যাধ,
স্বর্গপুরে করিল গমন।
শ্রীমধুসূদন হরি,     হৃদয়ে ভাবনা করি,
নিজ দেহ ত্যাজেন তখন॥
জ্যোতির্ম্ময় নিজ অঙ্গে,     প্রবেশি পরম রঙ্গে,
দেবগণ করে স্তুতিবাণী।
দুন্দূভি-নিনাদ বাজে,     অপ্সরী কিন্নরী নাচে,
হুলাহুলি অমর রমণী॥
পুষ্পবৃষ্টি করে সবে,     পারিষদগণ সেবে,
স্তুতি করে সুর মুনিগণ।
চতুর্ম্মুখে বিধিবর,     পঞ্চমুখে মহেশ্বর,
করপুটে করয়ে স্তবন॥
অখিল হইল দীপ্ত,     ভুবন হইল তৃপ্ত,
আনন্দিত যত দেবগণ।
শুনরে ভকত ভাই,     স্মরণেতে মুক্তি পাই,
এড়াই শমন দরশন॥
ভক্তবশ গুণনিধি,     ভক্তবাঞ্ছা করে সিদ্ধি,
নাহি আর ভক্তির সমান।
কাশীদাস বলে যদি,     পার হবে ভব-নদী,
ভজ সেই দেব ভগবান॥