০৬৩. যুধিষ্ঠিরাদির জন্ম

মুনি বলে, শুন কুরুকল-অধিকারী।
বৎসরেক গর্ভ যবে ধরিল গান্ধারী।।
সেই ত সময়ে তবে ভোজের নন্দিনী।
পূর্ব্বে মন্ত্র বর দিল যে দুর্ব্বাসা মুনি।।
সেই মন্ত্র জপি ধর্ম্মে করিল আহ্বান।
তৎক্ষণে আইল ধর্ম্ম কুন্তী বিদ্যমান।।
ধর্ম্মের সঙ্গমে হৈল গর্ভের উৎপত্তি।
পরম-সুন্দর পুত্র প্রসবিলা সতী।।
ইন্দ্র-চন্দ্র-সম কান্তি, তেজে দিবাকর।
উজ্জ্বল করিল শতশৃঙ্গ গিরিবর।।
দিন দুই প্রহরেতে পুণ্য-তিথি-যুত।
অতি শুভক্ষণেতে জন্মিলা কুন্তীসুত।।
সেই ক্ষণে ধ্বনি হইল আকাশ উপর।
সকল ধার্ম্মিক-শ্রেষ্ঠ এই পুত্রবর।।
সত্যবাদী জিতেন্দ্রিয় হবে মহারাজা।
জগতের লোকে তাঁরে করিবেক পূজা।।
এতেক আকাশবাণী শুনিয়া রাজন।
কুন্তীরে ডাকিয়া পুনঃ বলেন বচন।।
শুনিলা আকাশবাণী বলে দেবগণ।
ধার্ম্মিক সুবুদ্ধি শান্ত হইবে নন্দন।।
ক্ষত্রিয়ে প্রধান গণি বলিষ্ঠ কোঙর।
ধার্ম্মিক গণি যে শ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণ ভিতর।।
সে কারণে অন্য দেবে ভজ পুনর্ব্বার।
যাঁহা হৈতে হইবেক বলিষ্ঠ কুমার।।
রাজার বচনে কুন্তী ভাবে মনে মনে।
দেবগণ মধ্যে দেখি বলিষ্ঠ পবনে।।
মন্ত্র জপে কুন্তী করি বায়ুর উদ্দেশ।
সেইক্ষণে বায়ু তথা করিল প্রবেশ।।
বায়ুর সঙ্গমে পুত্র লভিল জনমে।
জন্মমাত্র তাহার যে শুনহ বিক্রম।।
পুত্র প্রসবিয়া কুন্তী কোলে লইতে চায়।
তুলিতে নারিল ভারি পর্ব্বতের প্রায়।।
কিছুমাত্র ভূমি হৈতে তুলিল যতনে।
সহিতে না পারি ভার ফেলে ততক্ষণে।।
অশক্তা হইয়া ফেলে পর্ব্বত উপর।
শতশৃঙ্গ-পর্ব্বত কাঁপিল থরথর।।
শিলা বৃক্ষ গিরিশৃঙ্গ হৈল চূর্ণময়।
বালকের শব্দে পায় গিরিবাসী ভয়।।
সিংহ ব্যাঘ্র মহিষাদি যত পশুগণ।
পর্ব্বত ত্যজিয়া সবে গেল অন্য বন।।
হেনকালে শূন্যবাণী হৈল ততক্ষণ।
শুন কুন্তী পাণ্ডু এই তোমার নন্দন।।
যতেক বলিষ্ঠ আছে পৃথিবী-ভিতর।
সবা হৈতে শ্রেষ্ঠ এই মহা-বলধর।।
নির্দ্দয় নিষ্ঠুর এই দুষ্টজন-রিপু।
অস্ত্রেতে অভেদ্য এই, বজ্রসম বপু।।
দেখিয়া শুনিয়া পাণ্ডু হইল বিস্ময়।
আশ্চর্য্য মানিল কুন্তী দেখিয়া তনয়।।
পুনরপি কুন্তীরে বলেন নৃপবর।
দুই মত জন্ম হৈল যুগল-কোঙর।।
এক হৈল ধার্ম্মিক, র্নিদ্দয় আর জন।
সর্ব্ব-গুণ-যুত এক জন্মাহ নন্দন।।
কুন্তী বলে হেন পুত্র হইবে কেমনে।
সর্ব্বগুণী পুত্র পাব কার আরাধনে।।
ইহা শুনি পাণ্ডু জিজ্ঞাসিল মুণিগণে।
সর্ব্ব-গুণ-যুত দেব আছে কোন জনে।।
তাঁরে আরাধিয়া আমি লভিব নন্দন।
এত শুনি বলিল যতেক মুনিগণ।।
সর্ব্ব-গুণ-যুত দেখ ইন্দ্র দেবরাজ।
তাঁহারে সেবিলে রাজা সিদ্ধ হবে কাজ।।
ইন্দ্রের উদ্দেশে তপ কর নৃপবর।
নিয়ম করিয়া রাজা কর সম্বৎসর।।
বিনা তপে নহে তুষ্ট দেব পুরন্দর।
এত শুনি তপ আরম্ভিল নৃপবর।।
ঊর্দ্ধবাহু একপদে রহে দাঁড়াইয়া।
সম্বৎসর করে তপ বায়ু আহারিয়া।।
তপে তুষ্ট বাসব যে আইল তথায়।
কহিলেন পাণ্ডুরে শুনহ কুরুরায়।।
আপন বাঞ্ছিত ফল মাগ মহাশয়।
ইচ্ছা তব পূর্ণ হবে না কর সংশয়।।
বর দিয়া ইন্দ্র হইলেন অন্তর্ধান।
তপ নিবর্ত্তিয়া পাণ্ডু গেল নিজস্থান।।
কুন্তীরে কহিল পাণ্ডু হরিষ-অন্তর।
তুষ্ট হয়ে মোরে বর দিল পুরন্দর।।
স্ববাঞ্ছিত ফল রাজা হইবে তোমার।
সর্ব্ব-গুণ-যুত তুমি পাইবে কুমার।।
তপস্যায় করিলাম প্রসন্ন বাসবে।
মুনি-মন্ত্রে স্মরণ করহ তাঁরে এবে।।
স্মরণ করিল কুন্তী স্বামীর বচনে।
দেবরাজ কুন্তীপাশে আইল তৎক্ষণে।।
সঙ্গম করিয়া ইন্দ্র দিয়া গেল বর।
ইন্দ্রের ঔরসে জন্ম হইল কুমার।।
জাতমাত্র শূন্যবাণী হইল গম্ভীর।
সুরাসুরে এই পুত্র হবে মহাবীর।।
অদিতির যেমন তনয় নারায়ণ।
তেমতি তোমার কুন্তী হইবে নন্দন।।
পরাক্রমে হবে তুল্য কার্ত্তবীয্যার্জ্জুন।
তিনলোকে হৈবে খ্যাত এই পুত্র ধন।।
পৃথিবীর লক্ষ রাজা জিনি বাহুবলে।
যুধিষ্ঠিরে অভিষেক করিবে ভূতলে।।
ভ্রাতৃসহ করিবেক তিন অশ্বমেধ।
ভৃগুরাম সদৃশ শিখিবে ধনুর্ব্বেদ।।
শিখিবেক দিব্য-অস্ত্র দিব্য-মন্ত্র-মতে।
এ পুত্র না জানে, হেন নাহিক জগতে।।
পিতৃলোকে উদ্ধারিবে এই পুত্রবর।
খাণ্ডব দহিয়া এ তুষিবে বৈশ্বানর।।
এতেক আকাশ-বাণী হৈল শূন্য হৈতে।
অমর কিন্নর সব আইল দেখিতে।।
ইন্দ্র সহ আইল যতেক দেবগণ।
চন্দ্র সূর্য্য পবন শমন হুতাশন।।
দেখিতে আইল যত গন্ধর্ব্ব কিন্নর।
সিদ্ধ ঋষিগণ যত অস্পরী অপ্সর।।
একাদশ রুদ্র ঊনপঞ্চাশ পবন।
অশ্বিনী-কুমার আর বিশ্বাবসুগণ।।
যতেক অমরগণ আইল সত্বর।
মহা-কলরব হৈল শূন্যের উপর।।
দক্ষ-আদি প্রজাপতি আইল দেখিতে।
দেবাঙ্গনা যতেক আইল নৃত্য-গীতে।।
গন্ধর্ব্বেতে গীত গায় নাচে বিদ্যাধরী।
ঝাঁকে ঝাঁকে পুষ্পবৃষ্টি আচ্ছাদিল গিরি।।
দেবগণ ঋষিগণ করিলা কল্যাণ।
নিবর্ত্তিয়া সবে গেল যার যেই স্থান।।
হরষিত হৈল পাণ্ডু ভোজের নন্দিনী।
সর্ব্ব দুঃখ পাসরিল পুত্র-গুণ শুনি।।
তবে কত দিনে পাণ্ডু একান্তে বসিয়া।
কুন্তী প্রতি বলিলেন একান্ত ভাবিয়া।।
আমার পুত্রের বাঞ্ছা পূর্ণ নাহি হয়।
পুনর কহিতে তোমায় যোগ্য নয়।।
চতুর্থ পুরুষে নারী হয় যে স্বৈরিণী।
পঞ্চম পুরুষ হৈলে বেশ্যা মধ্যে গণি।।
সে কারণে তোমায় কহিতে না যুয়ায়।
পুত্র-বাঞ্ছা পূর্ণ হয় না দেখি উপায়।।
হেনমতে কুন্তী সহ কথোপকথনে।
পুত্র-চিন্তা নরবর সদা ভাবে মনে।।
মহাভারতের কথা অমৃত-সমান।
একমনে শুনিলে বাড়য়ে দিব্য-জ্ঞান।।