০৬২. পুত্রোৎপাদনে কুন্তীর প্রতি পাণ্ডুর অনুমতি

কুন্তীরে বলেন তবে পাণ্ডু নৃপবর।
আপনি শুনিলা মুনিগণের উত্তর।।
দেবহৈতে পুত্র হবে, বলে মুনিগণ।
আপনি করহ কুন্তী ইহার বিধান।।
মৃগ-ঋষি শাপে শক্তি নাহিক আমার।
উপায় করিয়া পিতৃ-ঋণে কর পার।।
আর হেন আছে পূর্ব্বশাস্ত্রের বিধান।
বিবরিয়া কহি তাহা কর অবধান।।
স্বংমুৎপাদিত কেহ সহজে নন্দন।
নতুবা কাহারে পুত্র দেয় কোন্ জন।।
মূল্য লৈয়া পৌষ্য করে পুত্রবৎ করি।
আপনি প্রবেশে কেহ অন্নহেতু মরি।।
পুত্রহীনে কোন্ জন কন্যা করে দান।
তার পুত্র হইলে সে হয় পুত্রবান।।
নতুবা স্বামীর আজ্ঞা লৈয়া কোন জনে।
আপন সদৃশ কিম্বা উচ্চজন স্থানে।।
তাহাতে জন্মিলে হয় আপন নন্দন।
পূর্ব্বাপর আছে হেন ব্রহ্মার বচন।।
সেই অনুসারে কহি বংশের কারণ।
শ্রেষ্ঠ জন হৈতে কর বংশের রক্ষণ।।
কুন্তী বলে, রাজা তুমি পরম পণ্ডিত।
কি কারণে কহ তুমি বচন কুৎসিত।।
আমি ধর্ম্মপত্নী তুমি ধর্ম্মজ্ঞ আপনে।
তোমা বিনা অন্যজন না দেখি নয়নে।।
তুমি বল, শ্রেষ্ঠ হৈতে জন্মাহ নন্দনে।
তোমা হৈতে শ্রেষ্ঠ কেবা আছে ত্রিভুবনে।।
পূর্ব্বে শুনিয়াছি রাজা কহে মুনিগণ।
ব্যুষিতাশ্ব রাজা ছিল পৌরব-নন্দন।।
মহারাজ ব্যুষিলেক ধর্ম্মেতে তৎপর।
যজ্ঞ করি তুষিলেক যতেক অমর।।
তাঁর দক্ষিণায় তুষ্ট হৈল দ্বিজগণ।
বাহুবলে জিনিল সকল রাজগণ।।
ভদ্রা যে তাঁহার ভার্য্যা পরমা সুন্দরী।
রাজারে সেবয়ে সদা পুতকাম করি।।
পত্নীতে আশক্ত সদা স্ত্রৈণ নরবর।
অকাল হৈল ব্যাধিযুক্ত কলেবর।।
যক্ষ্মা-কাশ-রোগে রাজার হইল মরণ।
ভদ্রা হৈল শোকের সাগরে নিগমন।।
স্বামী বিনা ভার্য্যা জীয়ে, ধিক তার প্রাণ।
স্বামী বিনা ঘর দ্বার শ্মশান সমান।।
স্বামীর বিহনে নারী জীয়ে যেই জনা।
নিত্য নিত্য ভুঞ্জে সেই বিবিধ যন্ত্রণা।।
স্বামীপুত্রহীনা নারী লোকে অনাদর।
গণনা না করে কেহ মনুষ্য ভিতর।।
হেন মতে ভদ্রা বহু করিছে ক্রন্দন।
ডাকিয়া তাহারে শব বলে ততক্ষণ।।
না কান্দহ ভদ্রা তুমি উঠি যাহ ঘরে।
আমি জন্মাইব পুত্র তোমার উদরে।।
শবের বচনে ভদ্রা গেল নিজ স্থান।
শবেরে রাখিল করি যতন বিধান।।
ঋতু যোগে ভদ্রা তবে শবের সঙ্গমে।
সপ্ত পুত্র উদরে ধরিল ক্রমে ক্রমে।।
শব-স্বামী হৈতে ভদ্রা পুত্র জন্মাইল।
হেনমত আছ পূর্ব্ব মুনিরা কহিল।।
তুমিও এখন রাজা যোগ কর বনে।
আমার উদরে জন্ম করাহ নন্দনে।।
পাণ্ডু বলিলেন, সে মানুষে না সম্ভব।
দৈববলে শব হৈতে পুত্রের উদ্ভব।।
সেইরূপ শক্তি কুন্তী নাহিক আমার।
পূর্ব্ব-ধর্ম্ম-উক্তি কুন্তী কহি শুন আর।।
পূর্ব্বেতে না ছিল কুন্তী এ সব নিয়ম।
যারে ইচ্ছা তার হয় করিত সঙ্গম।।
ইচ্ছামত স্ত্রীগণ যাইত যথাস্থানে।
নাহিক বিরোধ পূর্ব্বে ব্রহ্মার সৃজনে।।
নিয়ম করিল ঋষিপুত্র একজন।
তাহার বৃত্তান্ত কহি শুন দিয়া মন।।
উদ্দালক নামে এক মহা-তপোধন।
শ্বেতকেতু নামে ধরে তাঁহার নন্দন।।
পিতৃমাতৃকোলে ক্রীড়া করে অনুক্ষণ।
হেনকালে আসে তথা মুনি একজন।।
বিমোহিত হৈয়া মুনি ধরে তার মায়।
স্বামী-পুত্র কোলে হৈতে ধরি লয়ে যায়।।
বিস্ময় হইয়া শিশু চাহে পিতৃপানে।
ক্রোধ-মুখে জিজ্ঞাসিল জনকের স্থানে।।
কোথা হৈতে আসে দ্বিজ, বড় দুরাচার।
জননীরে লয়ে যায় কোথায় আমার।।
শুনিয়া বালকে মুনি করেন প্রবোধ।
পূর্ব্বাপর আছে বাপু না করিও ক্রোধ।।
যারে যার ইচ্ছা হয় করিতে বিহার।
টানি লয়ে যায় তারে বিধি বিধাতার।।
শুনিয়া হইল শিশু অধিক কুপিত।
এ হেন কুৎসিত কর্ম্ম বিধির সৃজিত।।
সৃষ্টি করে প্রজাপতি, নিয়ম না জানে।
হেন অনুচিত কর্ম্ম করে সে কারণে।।
আজি হৈতে সৃষ্টি মধ্যে করিব নিয়ম।
দেখ পিতা আজি মম তপঃ পরাক্রম।।
নিজ নিজ স্বামী ভার্য্যা ত্যজি যেই জন।
পরনারী পরস্বামী করিবে গমন।।
সংসারে যতেক পাপে হইবেক পাপী।
নরক হইতে পার না হবে কদাপি।।
স্ত্রী হইয়া স্বামীর বচন নাহি শুনে।
স্বামী যদি নিয়োজয় বংশের রক্ষণে।।
অজজ্ঞায় স্বামী-কার্য্য করে অনাদর।
চিরকাল মজিবে সে নরক-ভিতর।।
হেনমতে মুনিপুত্র নিয়ম করিল।
পূর্ব্বমত ত্যজি তাই হেন মত হৈল।।
আর পূর্ব্বকথা, কুন্তী শুনহ বচন।
সূর্য্যবংশে ছিল নামে সৌদাস-রাজন।।
মদয়ন্তী ভার্য্যা তাঁর পরমা-সুন্দরী।
অপত্য বিহনে দোঁহে সদা চিন্তা করি।।
বশিষ্ঠের স্থানে ভার্য্যা নিযুক্ত করিল।
মুনির ঔরসে তাঁর শ্রেষ্ঠ পুত্র হৈল।।
আমা সবাকার জন্ম জানহ আপনে।
ব্যাস করিলেন যথা পিতার বিহনে।।
বংশ হেতু হেনমত আছে পূর্ব্বাপর।
বিস্ময় না কর ইথে, ধর্ম্মের উত্তর।।
সেই হেতু আজি আমি কহি যে তোমারে।
পুত্রার্থে নাহিক শক্তি কি বল আমারে।।
কৃতাঞ্জলি করি কুন্তী নিবেদি তোমায়।
পুত্র জন্মাইতে কর আপনি উপায়।।
রাজার কাতর বাক্যে কুন্তী-ভোজসুতা।
কহিতে লাগিল পূর্ব্ব আপনার কথা।।
বাল্যকালে পিতৃগৃহে ছিলাম যখন।
অতিথি সেবনে ছিল মম নিয়োজন।।
অকস্মাৎ আইল দুর্ব্বাসা মুনিবর।
মুনিরে সেবন করিলাম সুবিস্তর।।
পরম পণ্ডিত সেই মুনি মহাশয়।
সেবাবশে আমা প্রতি হইল সদয়।।
মন্ত্র দিয়া আমারে কহিল সেই মুনি।
যেই দেবে ইচ্ছা তব হবে সুবদানি।।
এই মন্ত্র জপি তারে করিবা আহ্বান।
অবিলম্বে সেই দেব আসিবে তব স্থান।।
যেই বর ইচ্ছা হয়, পাবে সেই বর।
এত বলি দুর্ব্বাসা গেলেন দেশান্তর।।
এখন যেমত আজ্ঞা কর দণ্ডধর।
আজ্ঞা কর, দেবস্থানে মাগি পুত্রবর।।
যে তোমারে কহিলাম পুত্রের বিধান।
আজ্ঞা কর কোন্ দেবে করিব আহ্বান।।
রাজা বলে, মুনি যদি দিয়া থাকে বর।
তবে কেন বৃথা চিন্তা করহ অন্তর।।
হোম যজ্ঞ পূজা করি যাঁহার উদ্দেশ্যে।
নানা ব্রতে অর্চ্চ যাঁরে অতিশয় ক্লেশে।।
তথাপি দেবের নাহি পাই দরশন।
উদ্দেশে মাগি যে বর যার যেই মন।।
হেন দেব সাক্ষাতে চাহিবা তুমি বর।
শুভকার্য্যে সুবদনি বিলম্ব না কর।।
দেবতার মধ্যে জ্যেষ্ঠ ধর্ম্ম মহাশয়।
সর্ব্বপাপ হবে যাঁর লইলে আশ্রয়।।
সেই ধর্ম্মদেবে তুমি করহ আহ্বান।
পুত্রবর কুন্তী তুমি মাগ তাঁর স্থান।।
ধর্ম্মবন্ত হইবেক তেঁই সে কুমার।
মহা-ধর্ম্মবন্ত হবে সর্ব্ব গুণাধার।।
নিয়ম করিবা ধর্ম্মে করহ স্মরণ।
আজিকার বিলম্ব না সহে একক্ষণ।।
স্বামীর বচনে কুন্তী করিল স্বাকার।
স্বামীর প্রদক্ষিণ করি করে নমস্কার।।
আদিপর্ব্ব ভারতের ব্যাসের রচিত।
পরমপবিত্র পুণ্য, শ্রবণে অমৃত।।
আয়ুর্যশ-পুণ্য বাড়ে যাহার শ্রবণে।
পাঁচালী-প্রবন্ধে কাশীরাম দাস ভণে।।