০৫. সাত্যকির সহিত শ্রীকৃষ্ণের বাদানুবাদ

সাত্যকির বচনে হাসেন নারায়ণ।
পুনরপি সাত্যকিরে বলেন বচন।।
জানি আমি সাত্যকি তোমার বীরপণা।
কুরু-পাণ্ডবের দলে জানে সর্ব্বজনা।।
কর্ণের সহিত রণ কৈলে একবার।
প্রাণ ল’য়ে পালাইলে করি পরিহার।।
দ্রোন সঙ্গে যুঝিয়া পাইলে পরাভব।
কেহ কেহ না যুঝিল করিয়া গৌরব।।
সিংহনাদ করিয়া বলিলে রনস্থলে।
হীনশক্তি জনে পায়ে সংহার করিলে।।
ভয়াম্বিত হীনশক্তি হীন অন্ধজন।
তোমার যুদ্ধের যোগ্য এই সব জন।।
সোমদত্ত-সুত ভূরিশ্রবা নরপতি।
যুঝিতে আসিয়া ছিল তোমার সংহতি।।
নিজ শক্তি না জানিয়া যুদ্ধে দিলে মন।
যে গতি করিল তোমা হয় কি স্মরণ।।
হীন অস্ত্র কৈল তোমা সংগ্রাম ভিতরে।
কেশে ধরি উদ্যম করিল কাটিবারে।।
হেনকালে কহিলাম অর্জ্জুন নিকটে।
হের দেখ শিনিপুত্র পড়িল সঙ্কটে।।
ভূরিশ্রবা কাটে দেখ সাত্যকির শির।
ত্বরিতে করহ রক্ষা ধনঞ্জয় বীর।।
আমার বচনে তবে কুন্তীর কুমার।
খড়গ সহ হস্ত কাটি পাড়িলেক তার।।
হস্ত কাটা গেল তার অর্জ্জুনের বাণে।
ভূমে লুটাইয়া বীর পড়ে সেইক্ষণে।।
ভূমিতে পড়িল প্রায় ত্যজিল জীবন।
খড়গ ল’য়ে তুমি তারে কাটিলে তখন।।
এই বীরপণা তুমি করিলে সমরে।।
দর্প করি কথা কহ সভার ভিতরে।।
কোন পরাক্রমে ভূরিশ্রবারে মারিলে।
বড় কর্ম্ম কৈলে বলি মনে বিচারিলে।।
পাপীর সংসর্গে পাপ বাড়ে নিতি নিতি।
এখানে উচিত নহে তোমার বসতি।।
মর্য্যাদা থাকিতে উঠি করহ গমন।
অন্য ঠাঁই বৈস তুমি যথা লয় মন।
শুনিয়া কৃষ্ণের মুখে এতেক বচন।
বিস্ময় মানিয়া চাহে যত যদুগণ।।
মনে মনে শিশু সব করে অনুভব।
কৃষ্ণের পরম প্রিয় সাত্যকি উদ্ধব।।
এত দিনে সাত্যকি বিচ্ছেদ হৈল প্রায়।
নহে কটুত্তর এত কহে যদুরায়।।
কৃষ্ণের উত্তর শুনি শিনির নন্দন।
মহাকোপে গর্জ্জিয়া উঠল সেইক্ষণ।।
বারুণী মদিরাপানে ঘূর্ণিত লোচন।
দীর্ঘশ্বাস ছাড়িলেন মহাকোপ মন।।
কর পদ কম্পিয়া কম্পয়ে ওষ্ঠাধর।
কড় মড় দশন মর্দ্দয়ে করে কর।।
গর্জ্জনেতে বলিলেন গোবিন্দের প্রতি।
আমায় এমন বাক্য কহরে দুর্ম্মতি।।
তোমার দুষ্কর্ম যত কেবা নাহি জানে।
কপটে মারিলে পাণ্ডবের বন্ধুগণে।।
অবোধ পাণ্ডব সব তোমার উত্তরে।
রণজয় করিয়া রহিল স্থানান্তরে।।
যদি সবে এক ঠাঁই বঞ্চিত রজনী।
তবে কেন সর্ব্বনাশ করিবেক দ্রৌণি।।
তুমি আমি পঞ্চ ভাই পাণ্ডুর নন্দন।
তব বাক্যে স্থানান্তরে রহি সর্ব্বজন।।
ধৃষ্টদ্যুম্ন আদি পঞ্চ দ্রৌপদীকুমার।
রহিল শিবির যেন অনাথ আকার।।
নিশিযোগে ছিল সবে নিদ্রায় বিহ্বলে।
চোররূপে তিনজন গেল সেইকালে।।
কৃপ কৃতবর্ম্মা আর দ্রৌণি দুষ্টমতি।
নিদ্রিত জনরে মারে দুর্জ্জন প্রকৃতি।।
যদি আমি থাকিতাম কিম্বা পাণ্ডুসুতে।
কার শক্তি দ্রৌপদীর পুত্র বিনাশিতে।।
কৃতবর্ম্মা কৃপ দ্রৌণি তিন দুরাচার।
ইহা হৈতে পাপকারী কেবা আছে আর।।
না বলিয়া অস্ত্র যদি প্রহারয়ে প্রাণে।
অস্ত্রহীন জনে আর হীনশক্তি জনে।।
অবিরোধি জনে যে করয়ে প্রহার।
তাহা সম পাপী নাহি বেদের বিচার।।
সকল অধর্ম্ম পথ যে জন সিঞ্চিল।
সে জন ধার্ম্মিক হ’য়ে সভাতে বসিল।।
তোমা সম কপটী, কে পাপী দুরাচারী।
সকল হইল নষ্ট তোমার চাতুরী।।
কপট তোমার যত ধর্ম্মের বিচার।
কোন ঠাঁই বীরপণা না দেখি তোমার।
জরাসন্ধ ভয়েতে ত্যজিয়া মধুপুরী।
সমুদ্র ভিতরে বৈস দ্বারকানগরী।।
ক্ষুদ্র জন বড় জন কেবা নাহি জানে।
নন্দের নন্দন তুমি বাস বৃন্দাবনে।।
গোপ অন্ন খাইয়া বঞ্চিলে গোপগৃহে।।
গোপাল বলিয়া নাম তেঁই লোকে কহে।।
জন্মের নির্ণয় তব কেবা নাহি জানে।
বসুদেব দৈবকীর পশিলা স্মরণে।।
পিতা বসুদেব হৈল দৈবকী জননী।
বসুদেব-তনয় বলিয়া সবে জানি।।
বাসুদেব নাম দিল করিয়া আদর।
সভামধ্যে কৈল তোমা যাদর ঈশ্বর।।
বসুদেব পুত্র বলি মান্য করি সবে।
দোষাদোষ নাহি লই তাঁহারি গৌরবে।।
এই হেতু হইল বড়ই অহঙ্কার।
আমারে করহ নিন্দি আরে দুরাচার।।
পৃথিবীতে যত মহারাজগণ ছিল।
ক্ষত্র সভা মধ্যে তোরে বসিতে না দিল।।

যুধিষ্ঠির রাজা যবে রাজসূয় কৈল।
এক লক্ষ নৃপতিরে বরিয়া আনিল।।
গৌরব করিয়া ভীষ্ম কহিল তাহাতে।
রাজগণ মধ্যে অগ্রে তোমায় পূজিতে।।
ভীষ্মের বচনে ধর্ম্ম পূজিল তোমারে।
সেই হেতু রুষিল যতেক নরবরে।।
বলিল সকল রাজা যত কুবচন।
সে সকল কথা তব হয় কি স্মরণ।।
দৈবেতে কহিলে তুমি বাক্য কটুময়।
তোমার সভ্য কি বসিতে যোগ্য হয়।।
পরম কপটী তুমি অতি দুরাচার।
তোমার চাতুরী কেহ নারে বুঝিবার।।
নিষ্কলঙ্ক নির্দ্দোষ নিষ্পাপ সত্যব্রতী।
হেন জনে নিন্দে যেই সেই দুষ্টমতি।।
তোমার জনকে পূর্ব্বে কেবা নাহি জানে।
গিয়াছিল দৈবকীর স্বয়ম্বর স্থানে।।
দৈবক রাজার কন্যা তোমার জননী।
পরম রূপসী বিদ্যাধরী রূপ জিনি।।
দেখিয়া মোহিত হ’ল জনক তোমার।
কন্যা লইবার হেতু করয়ে বিচার।।
বহু রাজা আসিয়াছে স্বয়ম্বর স্থানে।
রথে তুলি লয় কন্যা সবা বিদ্যমানে।।
সত্বর গমনে যায় কন্যারে লইয়া।
চৌদিকে ভূপতিগণ বেড়িল আসিয়া।।
দেখিয়া হইল বসু ভয়ে কম্পবান।
কি করিবে কেমনে হইবে পরিত্রাণ।।
কন্যার কারণে আজি জীবন সংশয়।
পলাইতে নাহি শক্তি মরিনু নিশ্চয়।।
ভয়ার্ত জানিয়া যত সাধু রাজগণ।
ক্রোধ সম্বরিয়া গেল না করিল রণ।।
দুষ্ট রাজগণ সঙ্গে বাহ্লীক নন্দন।
বসুর উপরে করে অস্ত্র বরিষণ।।
দেখিয়া কুপিল শিনি জনক আমার।
সোমদত্ত সনে রণ করিল অপার।।
রথ অশ্ব সারথি কাটিল ধনুর্গুণে।
হাতাহাতি সমর হইল দুইজনে।।
কোপেতে জনক মোর ধরি তার চুলে।
চড় মারি দন্ত ভাঙ্গি করিল নির্ম্মূলে।।
সকল ভূপতিগণ কৈল উপরোধ।
সোমদত্তে ছাড়ি পিতা সম্বরেণ ক্রোধ।।
ভয়েতে সকল রাজা নিবৃত্ত হইল।
আপন আপন দেশে সবে চলি গেল।।
পিতা স্থানে সোমদত্ত অপমান পেয়ে।
শিব আরাধনা করে ঘোর বনে গিয়ে।।
স্তবে তুষ্ট হ’য়ে বর যাচে পশুপতি।
বর মাগে সোমদত্ত হরে করে স্তুতি।।
শিনির প্রহারে মম দহে কলেবর।
বড় অপমান কৈল সভার ভিতর।।
তেমতি আমার পুত্র হোক্‌ বলবান।
শিনি-পুত্রে মোর পুত্র করে অপমান।।
সেই হেতু ভূরিশ্রবা হৈল বলধর।
আমি কি কহিক ইহা জানে সর্ব্ব নর।।
এই হেতু আমার করিল অপমান।
না হইল শক্তি তবু বধিতে পরাণ।।
যে কালে আমার কেশ ধরিল দুর্ম্মতি।
কুমারের চক্র হেন ফিরিলাম তথি।।
কত শক্তি ধরে সেই সোমদত্ত-সুত।
দৈববলে এই কর্ম্ম করিল অদ্ভুত।।
যেই জন করিল এতেক অপমান।
বলে ছলে প্রকারে লইব তার প্রাণ।।
আমার সাহায্যে হস্ত কাটিল অর্জ্জুন।
আমি তার মুণ্ড কাটিলাম সেইক্ষণ।।
ইহাতে পাতকী বড় হইলাম আমি।
বড় ধার্ম্মিকেরে লেয়া বসিয়াছ তুমি।।
পাণ্ডব তোমার প্রিয়বন্ধু বলি জানে।
তাহাদের সর্ব্বনাশ করিলে যে জনে।।
পুত্র মিত্র বন্ধু নাশিলেক যেইজন।
নিদ্রিত জনেরে গিয়া করিলে নিধন।।
হেন জন হৈল তবে পরম বান্ধব।
জানিনু তোমার প্রিয় যেমন পাণ্ডব।।
কপট করিয়া মজাইলে পাণ্ডবেরে।
পরম কুটিল তুমি কে জানে তোমারে।।
মহাভারতের কথা অমৃত লহরী।
কাশীরাম দাস কহে ভবভয় তরি।।