০৫. ধ্রুব উপাখ্যান

শোক ত্যজ ধৈর্য্য কর ধর্ম্ম নরপতি।
নানা সুখ ভোগ কর ভুঞ্জ বসুমতী।।
আর কিছু কহি রাজা মন দিয়া শুন।
করিয়া ত শান্ত মন শুনহ রাজন।।
উত্তানপাদ নামে রাজা পূর্ব্বেতে আছিল।
সুভগা দুর্ভগা তার দুই নারী ছিল।।
উত্তমাদি সাত পুত্র রাজার গোচরে।
সাত পুত্র লৈয়া সিংহাসনের উপরে।।
পুত্র মহারাণী বসি আছে হৃষ্টমনে।
হাস্য ও কৌতুক রাণী করে রাজা সনে।।
নানা রঙ্গ কৌতুকেতে রাজা রাণী থাকে।
সাত পুত্র বসিয়া রাজার কোলে দেখে।।
দেখিয়া ত ধ্রুব তবে চলিল সত্বর।
উঠে গিয়া ধ্রুব সিংহাসনের উপর।।
সিংহাসনে উঠিয়া যাইতে পিতৃকোলে।
হেনকালে রাণী সেই শিশুপ্রতি বলে।।
দুর্ভগার পুত্র তুমি, তোর মাতা দাসী।
কোন্ তেজে ইচ্ছা কর নৃপকোলে বসি।।
আর কভু দেখিলে কপালে দিব ঝাঁটা।
এত মনে সাধ কর দুর্ভগার বেটা।।
সিংহাসনে বসিবারে মনে কর সাধ।
আরাধনা কর তবে গোবিন্দের পাদ।।
এই দেহ ত্যজি যবে মোর পুত্র হবে।
তবে সিংহাসনোপরে বসিতে পাইবে।।
এত শুনি কান্দে ধ্রুব ধূলায় ধূসর।
কান্দিতে কান্দিতে গেল মায়ের গোচর।।
ধ্রুব বলে, মাতা মোরে সতাই মারিল।
সিংহাসন হৈতে মোরে ভূমিতে ফেলিল।।
আর বলে তোর মাতা কৃষ্ণ নাহি ভজে।
রত্ন-সিংহাসনে তুমি বৈস কোন লাজে।।
যত দিনে কৃষ্ণ ভজি শরীর ত্যজিবে।
পুনর্ব্বার তুমি মোর গর্ভেতে জন্মিবে।।
তবে সিংহাসনে তুমি বৈস মোর কোলে।
এই মত সতাই আমারে মন্দ বলে।।
শুনিয়া বচন রাণী বলিল ধ্রুবেরে।
কৃষ্ণ নাহি ভজি আমি জন্ম-জন্মান্তরে।।
দুর্ভগার পুত্র তুমি শুনহ বচন।
ভাল বৈল কর তুমি কৃষ্ণের ভজন।।
কৃষ্ণ ভজ পুত্র তুমি কৃষ্ণ সর্ব্বোপর।
ভালই বলিল সতাই তোমারে উত্তর।।
ভজন করহ পুত্র শ্রীকৃষ্ণ চরণ।
কৃষ্ণ বিনে উচ্চ পদ দিবে কোন্ জন।।
কত বড় উচ্চ তব পিতৃ-সিংহাসন।
ত্রৈলোক্য উপর ভজ শ্রীকৃষ্ণ-চরণ।।
শুনিয়া মায়ের পদে কৈল নমস্কার।
শ্রীকৃষ্ণে ভজিতে যায় দুর্ভগা-কুমার।।
পঞ্চবৎসরের শিশু তখনি চলিল।
কৃষ্ণ ভজিবার হেতু দেশ ছাড়ি গেল।।
পথেতে যাইতে নারদ সহ দরশন।
মুনি বলে, কোথা যাহ উত্তান-নন্দন।।
দণ্ডবৎ করি বলে ধ্রুব মহামতি।
কৃষ্ণের উদ্দেশে যাই কৃষ্ণ মোর গতি।।
নারদ বলিল, তুমি দুগ্ধমুখ শিশু।
সাধন-ভজন তুমি নাহি জান কিছু।।
গুরু নাহি কর তুমি শুনহ বচন।
কি মতে পাইবে হরি কঠিন ভজন।।
ধ্রুব বলে, যে হয় সে হয় এই কথা।
গোবিন্দ-উদ্দেশে যাই কহিনু সর্ব্বথা।।
কার্য্য সিন্ধ হয় কিম্বা দেহ হয় পাত।
যদি নাহি দরশন দেন জগন্নাথ।।
নিষ্ঠা দেখি মুনি মন্ত্র দিলেন ধ্রুবেরে।
অষ্টাদশ উপাসনা করাইলেন তারে।।
তবে ধ্রুব চলি গেল দণ্ডবত করি।
যমুনার কূলে গিয়া স্নান দান করি।।
ত্রিভঙ্গ হইয়া ধ্রুব এক পদে ভর।
তপস্যা করয়ে ধ্রুব চিন্তে গদাধর।।
অনাহারে তপ করে বনের ভিতরে।
বাতাহার করি তপ দ্বাদশ বৎসরে।।
তার তপ দেখি ভয় হৈল দেবগণ।
সর্ব্ব দেবগণ গেলা ধ্রুব-সন্নিধান।।
কোন দেব বলে, ধ্রুব আইল তোর বাপ।
কোন দেব বলে, অই আইল কালসাপ।।
কোন দেব পরিত্রাহি ডাকে উচ্চৈঃস্বরে।
কোন দেব বিকট মূরতি যেন ধরে।।
কোন দেব সিংহ হৈয়া আইসে মারিতে।
কোন দেব ব্যাঘ্রমূর্ত্তি ধরে আচম্বিতে।।
কোন দেব রাক্ষস-মূরতি তবে ধরে।
কোন দেব ধরে মূর্ত্তি দেখি ভয়ঙ্করে।।
হুহুঙ্কার করে সবে একত্র হইয়া।
ভয়ঙ্কর মূর্ত্তি ধরে ধ্রুব কাছে গিয়া।।
কোনরূপে ধ্যানভঙ্গ করিতে না পারে।
ত্রিভঙ্গ হইয়া ধ্রুব কৃষ্ণধ্যান করে।।
সর্ব্বদেব পলাইল স্থির হইতে নারে।
বস্ত্র ডুবাইয়া থুইল যমুনার তীরে।।
ডরে পলাইয়া গেল সর্ব্ব দেবগণ।
মহাভয় হৈল ইন্দ্র দেবের তখন।।
ইন্দ্র বলে, বুঝি ধ্রুব নিবে মোর পদ।
তেকারণে এতদিনে পাড়িল প্রমাদ।।
সর্ব্বদেবগণ বলে, হইল জঞ্জাল।
নাহি জানি দেন হরি কার অধিকার।।
এইমত দেবগণ হৈল চমৎকার।
তারপরে শুন কথা বলি কিছু আর।।
রহিতে নারিলা হরি দিলা দরশন।
গরুড়ে চড়িয়া হরি আইলা তখন।।
ডাকিয়া বলিল তবে শুনহ বচন।
কিবা চাহ বল মোরে কিবা তব মন।।
তবে ধ্রুব চক্ষু মেলি বলিল বচন।
তোমা বিনে আর মোর অন্যে নাহি মন।।
তোমার চরণ বিনে অন্য নাহি চাই।
তোমার চরণে প্রভু দেহ মোরে ঠাঁই।।
কৃষ্ণ বলেন, জানি তোমা, করিলে সেবন।
মোর বাক্যে পাবে তুমি পিতৃ-সিংহাসন।।
যাহা লাগি আইলে হেথা তাহা তুমি পাবে।
বাঞ্ছাকল্পতরু নাম সকলে ঘুষিবে।।
রাজ্যভোগ করি ছত্রিশহাজার বৎসর।
তবে তুমি মাতা সহ যাবে স্বর্গপুর।।
সর্ব্বদেব উপরেতে স্থান দিব আমি।
ধ্রুবলোক বলি বলিবেক সর্ব্বভূমি।।
সর্ব্বলোক উপরে হইবে ধ্রুবস্থান।
বিশ্বকর্ম্মা দিব্য পুরী করিল নির্ম্মাণ।।
অপূর্ব্ব হইলা পুরী জিনিয়া অমরা।
অর্দ্ধচন্দ্র বেদী যেন দীপ্ত করে তারা।।
বর দিয়া গেলা তবে দেব নারায়ণ।
চলি গেল ধ্রুব তবে আপন ভবন।।
দেশে গেলে মাতা পিতা কোলেতে করিল।
সতাই আসিয়া তার মুখে চুম্ব দিল।।
মোর দোষ ক্ষমা কর শুন মোর বাপ।
পাপিনী তোমারে আমি দিনু এত তাপ।।
ধ্রুব বলে, মাতা তুমি বল অকারণ।
তোমার প্রসাদে পাইনু হরির চরণ।।
এইমত সৎমায়ে কহিল বিস্তর।
নিজ মাতা বন্দে ধ্রুব করি যোড় কর।।
তবে রাজ্যে ধ্রুব হইলেন দণ্ডধর।
সিংহাসনে বসিয়া আপনি নৃপবর।।
ছত্রিশসহস্র বর্ষ রাজ্যে কৈল সুখে।
তবে মাতা সহিত চলিল ধ্রুবলোকে।।
আপনার পারিষদ বন্ধুগণ লৈয়া।
উচ্চপদে ধ্রুব তবে রহিলেন গিয়া।।
এই ত কহিনু রাজা ধ্রুবের আখ্যান।
ত্রিভুবনে নাহি পদ ধ্রুবের সমান।।
ধ্রুবের চরিত্র কথা শুনে যেই জন।
পাপে মুক্ত হয়সেই দুঃখ বিমোচন।।
মহাভারতের কথা অমৃত-সমান।
কাশীরাম দাস কহে, শুনে পুণ্যবান।।