০৪. শকুনি বধের উপক্রমে নানা যুদ্ধ

সেনাগণে আশ্বাসিয়া কহে দুর্য্যোধন।
অগ্র হয়ে যুঝ শত্রু করিব নিধন।।
জয় পরাজয় মৃত্যু দৈবের ঘটন।
যথা ধর্ম্ম তথা জয় বেদের বচন।।
এত বলি কুরুপতি রথ আরোহণে।
পথেতে ভেটিল আসি ভীমসেন সনে।।
মহামত্ত হস্তী যেন করিছে গর্জ্জন।
দুই সিংহে মিলি যেন করে মহারণ।।
ভীম ডাকি বলে এস কুরু কুলাধম।
করিলে সকল নাশ করি পরাক্রম।।
এবে বুদ্ধি বল কর্ণ গেল সব কোথা।
দুঃশাসন দুর্ম্মতি মরিল দুষ্ট ভ্রাতা।।
দেখিয়া না দেখ চক্ষে তুমি অন্ধমতি।
কুলান্তক তোমাকে সৃজিল প্রজাপতি।।
রণে ক্ষমা দিয়া এবে ভজ ধর্ম্মরাজে।
জীবওনের আশা যদি মনে কর কাজে।।
নতুবা চলহ যথা ভীষ্ম দ্রোণ কর্ণ।
দুই পথ কহিলাম যাহাতে প্রসন্ন।।
দুর্য্যেধন বলে ভীম সহ পরিবারে।
শমন সদনে আজি ‍পাঠাব তোমারে।।
বারে বারে অপমান কৈল নানামতে।
এখন পূরিল কাল চল যমপথে।।
দ্রৌপদীর অপমান পাসরিলা কেনে।
কিরাত সমান হয়ে ফিরিলা কাননে।।
শুনি ভীমবলে তব জেনেছি বিক্রম।
গন্ধর্ব্বে বান্ধিয়া তোরে লইল যখন।।
নিজ বল পরাক্রম কি জানাব তোমা।
ভজ ধর্ম্মরাজে তিনি করিবেন ক্ষমা।।
শুনি দুর্য্যোধন রাজা ক্রোধে কটু কয়।
যুদ্ধ করি পান্ডবে করিব পরাজয়।।
মহাযুদ্ধ বাধিল তুমুল হেনকালে।
প্রলয় কালেতে যেন সমুদ্র উথলে।।
তীমের নারাচ বাজে দুর্য্যোধন বুকে।
ব্যাকুল সারথি রথ ফিরায় বিমুখে।।
গদা হাতে ভীম সেন যায় শীঘ্রগতি।
ক্ষণমাত্রে সংহারিল যত যোদ্ধাপতি।।
আথালি পাথালি বীর মারে গদা বাড়ি।
সহস্র সহস্র রথ ফেলে চূর্ণ করি।।
সম্মূখ বিমুখ নাই মারে খেদাড়িয়া।
পলায় সকল সৈন্য রণে ব্যস্ত হৈয়া।।
দূরে থাকি যায় সবে পাইয়া তরাস।
পাছু পাছু ধায় বীর করিয়া বিনাশ।।
একা ভীম নিবারিল সহস্র পদাতি।
তুরঙ্গ সহস্র পঞ্চ সহস্রেক হাতী।।
সন্বিত পাইয়া তবে রাজা দুর্য্যেধন।
আশ্বাসিয়া বলে ভাই নাহি যোদ্ধাগণ।।
অর্জ্জুন সহিত যুদ্ধে ধায় সৈন্যগণ।
কুঞ্জর সহিত আসে রাজা দুর্য্যোধন।।
উভয়েতে মহাযুদ্ধ বাণ বরিষণ।
আকাশে প্রশংসা করে যত দেবগণ।।
কৌরবের যোদ্ধাপতি শাল্ব নৃপবর।
হস্তীতে চড়িয়া এল সংগ্রাম ভিতর।।
হস্তীর বিনাশে বাণ পাঞ্চাল এড়িল।
বিষম প্রহারে হস্তী আপনি পড়িল।।
কোপে বীর লাফ দিয়া ভূমিতে নামিল।
দেখিয়া সাত্যকি তবে তার আগু হৈল।।
কাটিল শ্বাল্বের ধনু করি খন্ড খন্ড।
তাহা দেখি কৃতবর্ম্মা হইল প্রচন্ড।।
দুই জনে বাণবৃষ্টি ঘোর অন্ধকার।
মহা প্রলয়েতে যেন সৃষ্টির সংহার।।
সাত্যকি এড়িল বাণ কৃতবর্ম্মা বীরে।
সেই বাণ বাজে তার বক্ষের উপরে।।
বাণে বাণে আচ্ছাদিল কৃতবর্ম্মা বীর।
রথ ফিরাইল তবে সারথি সুধার।।
পুনঃ শাল্ব সাত্যকিতে বাধিল সমর।
দোঁহে দোঁহা বিন্ধিয়া করিল জর জর।।
সাত্যকির বাণে শাল্ব ত্যজিল জীবন।
তাহা দেখি কৃতবর্ম্মা আইল তখন।।
শাল্ব বীর পড়িল দেখিয়া মহাবীর।
কৃতবর্ম্মা আসি রণে হইল সুস্থির।।
পুনঃরপি কৃতবর্ম্মা সাত্যকিতে রণ।
দোঁহাকার সংগ্রামের কি দিব তুলন।।
উভয়ে হইল রণ নাহি পাঠান্তর।
রথে চড়ি এল দোঁহে মহাধনুর্দ্ধর।।
ধ্বজ ছত্র কাটা গেল দেখি বিপরীত।
অশ্ব কাটা গেল রথ গমন রহিত।।
ভূমে নামে কৃতবর্ম্মা হইয়া বিরথী।
দেখি কৃপ নিজ রথে তোলে শীঘ্রগতি।।
পুনরপি দুর্য্যোধন যুঝে কোপমনে।
শরাসনে করে রণ পান্ডরের সনে।।
চতুর্দ্দিকে ভঙ্গ দিল পান্ডব বাহিনী।
ধর্ম্মরাজ সহ রণে মিলিল শকুনি ।।
মুহূর্ত্তেকে সমর হইল ঘোরতর।
দোঁহাকার বাণে দোঁহে হইল জর্জ্জর।।
ধর্ম্মের সারথি রথ কাটিল তখনি।
পেয়ে লাজ ধর্ম্মরাজ নামিল ধরণী।।
হেনকালে সহদেব ত্বরিতে আসিয়া।
আপনার রথে ধর্ম্মে লইল তুলিয়া।।
পুনঃ দিব্যরথ আনি যোগায় সারথি।
ধনু ধরি ধর্ম্মরাজি উঠিলেন তথি।।
সুসজ্জ হইয়া রাজা রহিয়া তথায়।
শকুনি বধিতে আজ্ঞা দিলেন ত্বরায়।।
চতুদ্দিকে সেনাগণ রহ সাবধান।
শকুনি মারিয়া কর যশের বাখান।।
পদাদি সহস্র ত্রিশ চলিল প্রধান।
এ সবার সহদেব কর্ত্তা আগুয়ান।।
জানিয়া সমরে ধায় গান্ধার নন্দন।
অনুবল পাছে থাকি দেয় দুর্য্যোধন।।
যষ্টিশত রথ অশ্ব আছেত বিভাগ।
পদাদি পঞ্চাশ কোটি সহস্রেক নাগ।।
সকল যোদ্ধার মাঝে শকুনি প্রধান।
দুই দলে মিশামিশি বাধিল সংগ্রাম।।
প্রতিজ্ঞা আছয়ে পূর্ব্বে শকুনি বিনাশে।
সেই হেতু সহদেব অধিক আবেশে।।
সহদেব শকুনি হইল মিশামিশি।
বাণে অন্ধকার, নাহি জানি দিবানিশি।।
রথে রথে গজে গজে তুরঙ্গে তুরঙ্গ।
বাধিল তুমুল যুদ্ধ দেখি যোদ্ধাভঙ্গ।।
কেশাকেশী মুখামুখী ভুজে যায় তাড়ি।
চরণে চরণ ছাঁদি ধায় গড়াগড়ি।।
হেনমতে যোদ্ধাগণ করে মহারণ।
মার মার শব্দ করি করয়ে গর্জ্জন।।
বাণে অন্ধকার হৈল সংগ্রামের স্থলী।
রথী রথী মহাযুদ্ধ সবে মহাবলী।।
বহিল শোণিত নদী অতি ভয়ঙ্কর।
হস্তী ঘোড়া ভাসে চলে সংগ্রাম ভিতর।।
বিষম সমরে বহু পড়িল বাহিনী।
সপ্ত শত অশ্ব শেষ রহিল শকুনি।।
রাজ অনুমতি মতে পরম সাহসে।
পাণ্ডব বাহিনী ভঙ্গ দিল চারি পাশে।।
সাহসে শকুনি যুঝে ধরিয়া ধনুক।
বাণাঘাতে পাণ্ডুসেনা নাহি বান্ধে বুক।।
হস্ত পদ বক্ষ কার কাটে খণ্ড খণ্ড।
কুণ্ডল সহিত কার কাটি পাড়ে মুণ্ড।।
সমরে শকুনি বহু সেনা বিনাশিল।
তাহা দেখি সহদেব সত্বরে ধাইল।।
বাহিনী-দুর্গতি দেখি কৃষ্ণ মহাশয়।
ডাকিয়া বলেন কেন সেনাভঙ্গ হয়।।
ভীষ্ম দ্রোণ কর্ণ আদি সমুদ্র তরিয়া।
শকুনির যুদ্ধে কেন মজিলে আসিয়া।।
শকুনিরে মার আজি অনর্থের মুল।
তার দোষে ক্ষত্রকুল হইল নির্ম্মুল।।
শুনিয়া অর্জ্জুন কোপে গান্ডীব ধরিয়া।
ক্ষুদ্র মৃগে ধায় যেন সিংহ খেদাড়িয়া।।
মহাভারতের কথা অমৃত সমান।
কাশীরাম দাস কহে শুনে পুণ্যবান।।