০৪৮. পুরুর জরা গ্রহণ ও যযাতির যৌবন প্রাপ্তি

দেশে আসি নৃপতি বসিল সিংহাসনে।
জ্যেষ্ঠ পুত্র যদুরে বলিল ততক্ষণে।।
শুক্রশাপে জরা বাপু! হইল শরীরে।
যৌবনের ভোগে মম মন নাহি পূরে।।
জ্যেষ্ঠ পুত্র হও তুমি পরম পণ্ডিত।
খণ্ডিতে পিতার হও তুমি পরম পণ্ডিত।।
খণ্ডিতে পিতার দুঃখ হয় যে উচিত।
সে কারণে মম জরা লহ রে শরীরে।।
তোমার যৌবন পুত্র দেহ ত আমারে।।
সহস্র বৎসরে পুত্র পাইবে যৌবন।
এত শুনি যদু হৈল বিরস-বদন।।
জরা সম দুঃখ পিতা নাহিক সংসারে।
অন্ন-পান-হীন, শক্তি না থাকে শরীরে।।
শরীর কুৎসিত হয়, লোকে উপহাসে।
হেন জরা লইতে মোর মনে নাহি আসে।।
আর চাহি পুত্র পিতা আছয়ে তোমার।
তাহা সবাকারে জরা দেহ আপনার।।
শুনিয়া হইল ক্রুদ্ধ, যযাথি রাজন।
জ্যেষ্ঠ পুত্র হৈয়া তুমি হৈলা অভাজন।।
তোর বংমে রাজা নাহি হবে কোনকালে।
জ্যেষ্ঠ হৈয়া তুমি মোর কুপুত্র হইলে।।
তাহার অনুজ, নাম তুর্ব্বসু সুন্দর।
তাহারে আনিয়া জিজ্ঞাসিল নৃপবর।।
শুক্রশাপে জরা হৈল, না যায় খণ্ডন।
জরা লয়ে দেহ পুত্র আপন যৌবন।।
সহস্র বৎসর পরে বৎস পুনর্ব্বার।
তোমায় যৌবন দিয়া লব রাজ্যভার।।
তুর্ব্বসু বলিল, পিতা জরা বড় দুঃখ।
আচারে বর্জ্জিত, যার সংসারের সুখ।।
হেন জরা লৈতে মোর নাহি লয় মতি।
শুনিয়া কুপিত অতি হৈল নরপতি।।
পুত্র হৈয়া পিতৃবাক্যে কর অনাদর।
এই পাপে ম্লেচ্ছ দেশে হবে দণ্ডধর।।
তব বংশে যতেক হইবে পুত্রগণ।
মূর্খ হৈয়া করিবেক অভক্ষ্য ভক্ষণ।।
দেবযানীর দুই পুত্র না শুনিল বাণী।
শর্ম্মিষ্ঠার পুত্রগণে ডাকিল তখনি।।
শর্ম্মিষ্ঠার জ্যেষ্ঠ পুত্র দ্রুহ্যু নাম ধরে।
মধুর বচনে রাজা বলিল তাহারে।।
অর্পিয়া আমারে পুত্র আপন যৌবন।
আমার এ জরাভার কর হে গ্রহণ।।
দ্রুহ্যু বলে, রাজা জরা বহু দোষ ধরে।
অন্যের থাকুক কাজ বাক্য নাহি স্ফূরে।।
না পারিব সহিতে জরার যে যন্ত্রণা।
অন্যেরে করহ আজ্ঞা লবে সেই জনা।।
শুনিয়া ক্রোধেতে রাজা বলিল তখন।
পুত্র হৈয়া পিতাবাক্য করিলা লঙ্ঘন।।
চারিজাতি ভেদ না থাকিবে যেই দেশে।
সেই দেশে রাজা হবে তোমার ঔরসে।।
যতেক করিবে আশা হইবে নৈরাশ।
কভু পূর্ণ না হইবে তব অভিলাষ।।
অনু বলি পুত্র তার কনিষ্ঠ সোদর।
তাহারে ডাকিয়া তবে বলে নৃপবর।।
মম জরা লহ বাপু, কর পুত্র কাজ।
শুনিয়া বলয়ে অনু শুন মহারাজ।।
জরা সম দুঃখ নাই জগত-সংসারে।
সদাই অশুদ্ধ দেহ থাকে অনাচারে।।
যে কিছু খাইলে জীর্ণ না হয় উদরে।
হেন জরা লৈতে পিতা না বল আমারে।।
রাজা বলে, তুমি পুত্র বড় দুরাচার।
পুত্র হৈয়া বাক্য তুমি লঙ্ঘিলা আমার।।
যতেক জরার দোষ কহিলা আপনে।
সেই সব দুঃখ তুমি ভুঞ্জ অনুক্ষণে।।
তোমার ঔরসে পুত্র যতেক হইবে।
যৌবন-কালেতে তারা সবাই মরিবে।।
তবে ত নৃপতি বড় হইয়া চিন্তিত।
সবার কনিষ্ঠ পুত্রে ডাকিল ত্বরিত।।
সবা হৈতে প্রিয় তুমি কনিষ্ঠ নন্দন।
প্রিয়কর্ম্ম করি রাখ আমার বচন।।
শুক্র-শাপে জরা হৈল আমার শরীরে।
তৃপ্তি নাহি পাই সুখে জানাই তোমারে।।
পুত্র-কর্ম্ম কর, দেহ আপন যৌবন।
সহস্র বৎসরে পুনঃ হইবে তেমন।।
মম জরা দুঃখ পুত্র লহ নিজ কায়।
গ্রহণ করিলে তুমি মম দুঃখ যায়।।
পিতার বচন শুনি কহে যোড় করে।
তোমার বচন রাজা কে লঙ্ঘিতে পারে।।
পুত্র হৈয়া পিতৃবাক্য না রাখে যে জন।
ইহলোকে অপযশ নরকে গমন।।
তব জরা দেহ পিতা আমার শরীরে।
আমার যৌবন ভোগ ভুঞ্জ কলেবরে।।
এতেক শুনিয়া রাজা হরষিত মন।
মুখে চুম্ব দিয়া পুত্রে বলেন বচন।।
বংশবৃদ্ধি হবে তব ধর্ম্মেতে তৎপর।
তোমার বংশেতে হবে রাজ্যের ঈশ্বর।।
এতেক বলিয়া শুক্রে করিল স্মরণ।
পুরু-অঙ্গে জরা থুয়ে পাইল যৌবন।।
যৌবন পাইয়া তবে যযাতি রাজন।
অনুক্ষণ ধর্ম্ম কর্ম্ম না যায় লিখন।।
যজ্ঞ হোমে তুষ্ট করি যত দেবগণে।
পিতৃগণে তুষ্ট কৈল শ্রাদ্ধাদি তর্পণে।।
দানেতে তুষিল দ্বিজ দরিদ্র ভিক্ষুক।
সুপালনে প্রজাগণে দিল বড় সুখ।।
অভ্যাগত নাহিক দুষ্ট রাজ্যের ভিতর।।
হেনমতে রাজ্য করে সহস্র বৎসর।
পূর্ব্ব বাক্যে স্মরণ করিল নৃপবর।।
জরায় পীড়িত পুত্র দেখিয়া নৃপতি।
আপনারে ধিক্কার করেন মহামতি।।
আপনার জরা দিয়া দিনু পুত্রে দুখ।
পুত্রের যৌবনে আমি ভুঞ্জিলাম সুখ।।
লোভেতে পুত্রের কষ্ট না দেখি নয়নে।
ভোগে মত্ত আমি দুঃখী করি যে নন্দনে।।
এত চিন্তি নরপতি বলিল নন্দনে।
বহু ভোগ করিলাম তোমার যৌবনে।।
পুত্রকর্ম্ম করি প্রীত করিলা আমারে।
তোমার মহিমা যশ ঘুষিবে সংসারে।।
আপন যৌবন লহ জরা দেহ মোরে।
ছত্রদণ্ড দিব আমি তোমার উপরে।।
এত বলি জরা নিল নহুষ-নন্দন।
লভিলেন পুরু পুনঃ আপন যৌবন।।
পুরু রাজা হবে বলি দিলেন ঘোষণা।
পাত্র মিত্র অমাত্য ডাকিল সর্ব্বজনা।।
ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় বৈশ্য শূদ্র যত প্রজা।
রাজ্যেতে যতেক বৈসে আনাইল রাজা।।
পুরু-অভিষেক দেখি যত প্রজাগণ।
কহিতে লাগিল ভূপে করি সম্বোধন।।
নানা শাস্ত্রে বিজ্ঞ তুমি নহুষ-নন্দন।
জ্যেষ্ঠ পুত্র বিদ্যমানে বল কি কারণ।।
কনিষ্ঠ হইবে রাজ-ছত্র অধিকারী।
এ কেমন যুক্তি মোরা বুঝিতে না পারি।।
সর্ব্বগুণ-যুত যদু পরম সুন্দর।
তার বিদ্যমানে পুরু নহে রাজ্যেশ্বর।।
ধর্ম্মনীতি বহু তুমি জান মহাশয়।
কনিষ্ঠে করিবে রাজা কোন্ শাস্ত্রে কয়।।
প্রজাগণ-বচন শুনিয়া নৃপবর।
সর্ব্বজনে সম্ভাষিয়া করিল উত্তর।।
পিতৃমাতৃ-বাক্য যেই পুত্র নাহি রাখে।
তারে পুত্র বলে, হেন কোন্ শাস্ত্রে লেখে।।
পুরুকে জানি যে আমি আপন কুমার।
আর পুত্র অকারণ হইল আমার।।
পরম পণ্ডিত পুরু জানে সর্ব্বধর্ম্ম।
রাখিয়া আমার বাক্য কৈল পুত্র কর্ম্ম।।
জরায় পীড়িত আমি মাগিনু যৌবন।
মম বাক্য না রাখিল অন্য চারি জন।।
পণ্ডিত সুবুদ্ধি পুরু করিল স্বীকার।
সহস্র বৎসর নিল মোর জরাভার।।
সে কারণে রাজ্যভারে পুরু যোগ্য হয়।
হেন পুরু রাজা হবে ধর্ম্মে কেন নয়।।
প্রজাগণ বলে, শুক্র জগতে বিদিত।
তাঁহার দৌহিত্রগণ সংসারে পূজিত।।
তাদের না দিয়া অন্যে দিবা অধিকার।
হইলে শুক্রের ক্রোধ নাহিক নিস্তার।।
রাজা বলে, শুক্রে করিয়াছি নিবেদন।
যেই জরা লইবে সে রাজ্যের ভাজন।।
শুক্র বলে, যেই পুত্র লবে জরাভার।
আপনার রাজ্যে তারে দিবা অধিকার।।
প্রজাগণ বলে কিছু কহিতাম আর।
শুক্র-আজ্ঞা হইয়াছে নাহিক বিচার।।
পিতৃ-মাতৃ বাক্য যেই করয়ে পালন।
তারে পুত্র বলি হেন কহে ‍মুনিগণ।।
রাজযোগ্য হয় পুরু ধর্ম্মেতে তৎপর।
সবার স্বীকার পুরু কর দণ্ডধর।।
এত যদি বলিল সকল প্রজাগণ।
অভিষেক করিল পুরুকে ততক্ষণ।।
ছত্র দণ্ড দিল তবে নৃপতি যযাতি।
পুত্রে শিক্ষা করাইল যত রাজনীতি।।
আদিপর্ব্বে বিচিত্র যযাতি উপাখ্যান।
কাশীরাম দাস কহে শুনে পুণ্যবান।।