০৪১. দুষ্মন্ত রাজার সহিত শকুন্তলার বিবাহ

রাজা বলে, কন্যা তুমি পরমা সুন্দরী।
রাজযোগ্যা ধনি তুমি হও মোর নারী।।
গাছের বাকল ত্যাজি পর পট্টবাস।
রত্ন-অলঙ্কার পর যেই অভিলাষ।।
এত শুনি লজ্জিতা হইয়া শকুন্তলা।
মৃদুভাষে নৃপতিকে কহিতে লাগিলা।।
শুন রাজা আমি করিলাম অঙ্গীকার।
পিতা আসি সম্প্রদান করিবে আমার।।
রাজা বলে, মুনিবর বিলম্বে আসিবে।
ক্ষণেক বিলম্ব হৈলে মম মৃত্যু হৈবে।।
বেদোক্ত বিবাহ হয় অষ্টম প্রকার।
গান্ধর্ব্ব বিবাহ লিখে ক্ষত্রিয় আচার।।
আপনি বিবাহ কর যদ্যপি আমারে।
মুনির বচনে দোষ না হৈবে তোমারে।।
রাজার বিনয় বাক্য শকুন্তলা শুনি।
রাজারে বলিল সত্য কর নৃপমণি।।
বেদের বিহিত যদি আছে পূর্ব্বাপর।
গান্ধর্ব্ব বিবাহ হৈবে শুন নৃপবর।।
আমার উদরে যেই জন্মিবে কুমার।
সত্য কর তুমি তারে দিবে রাজ্যভার।।
কামে মত্ত ভূপতি করিল অঙ্গীকার।
গান্ধর্ব্ব বিবাহে হৈল মিলন দোঁহার।।
তবে নরপতি বলে কন্যারে চাহিয়া।
রাজ্যেতে লইব তোমা লোক পাঠাইয়া।।
এত বলি নরপতি করিল গমন।
পথে যেতে নরপতি ভাবে মনে মন।।
কি বলিবে মুনিরাজ আসি নিজ ঘরে।
দুষ্মন্ত নিতান্ত ভীত ভাবিয়া অন্তরে।।
সসৈন্যে আপন দেশে গেল নরপতি।
কতক্ষণে গৃহে এল মুনি মহামতি।।
স্কন্ধ হৈতে ফলভার ভূমিতে থুইল।
শকুন্তলা এস বলি মুনি ডাক দিল।।
লজ্জায় মলিন কন্যা কন্যা না হৈল বাহির।
দেখিয়া বিস্মিত চিত্ত হইল মুনির।।
ধ্যানেতে জানিল মুনি যত বিবরণ।
হাসিয়া কন্যার প্রতি বলিল বচন।।
আমারে হেলন করি কৈলা এই কর্ম্ম।
দুষ্মন্ত নৃপতি সহ করিলা অধর্ম্ম।।
ক্ষমিলাম তোরে আমি করেছি পালন।
না করিহ ভয় চিত্তে, স্থির কর মন।।
সবিনয়ে বলে কন্যা যুড়ি দুই কর।
করিনু দুষ্কর্ম্ম মোরে ক্ষম মুনিবর।।
যোগ্য পাত্র সেই সে দুষ্মন্ত নৃপবর।
গান্ধর্ব্ব বিবাহে তারে করিলাম বর।।
ক্ষমহ রাজার দোষ আমারে দেখিয়া।
এত শুনি মুনিবর বলিল হাসিয়া।।
ক্ষমিলাম নৃপতিরে তোমার কারণ।
ইচ্ছামত বর তুমি করহ প্রার্থনা।।
ইহা শুনি অতি ধীরে শকুন্তলা কয়।
বাঞ্ছা যদি বর দিবে পিতা মহাশয়।।
প্রসন্ন হইয়া তুমি বর দেহ তবে।
অতুল প্রতাপে ধরা শাসুক গৌরবে।।
রাজ্যচ্যুত অথবা অধর্ম্ম পরায়ণ।
পুরু বংশীয়েরা যেন না হয় কখন।।
শকুন্তলা মুখে তবে শুনি এই বাণী।
তথাস্তু বলিয়া বর দিলা মহামুনি।।
হেনমতে মুনি-গৃহে আছে শকুন্তলা।
বিস্মৃত হইলা রাজা রাজভোগে ভোলা।।
কতকালে প্রসব হইল শকুন্তলা।
পরম সুন্দর পুত্র, শশী ষোলকলা।।
দিনে দিনে বাড়ে পুত্র মুনির ভবনে।
ছয় বর্ষ পূর্ণ হৈল রাজা নাহি জানে।।
মহা পরাক্রান্ত-বীর হৈল শিশুকালে।
সিংহ ব্যাঘ্র হস্তী ধরি আনে পালে পালে।।
তার পরাক্রম দেখি ‍মুনি চমৎকার।
দমনক বলি নাম দিলেন তাহার।।
শকুন্তলা সহ মুনি করিল বিচার।
যুবরাজ-যোগ্য পুত্র হইল তোমার।।
পুত্র সহ যাহ তুমি রাজার আলয়।
পিতৃগৃহে কন্যা কভু সম্ভব না হয়।।
ধর্ম্মক্ষয় অপযশ হয় কুচরিত্র।
পিতৃগৃহে বহু ধর্ম্মেনা হয় পবিত্র।।
এত বলি শিষ্য এক দিলেন সংহতি।
পুত্র সহ পাঠাইলা যথা নরপতি।।
দুষ্মন্ত নৃপতি বৈসে হস্তিনা নগর।
শকুন্তলা গেল যথা আছে নৃপবর।।
পাত্রমিত্র সহ রাজা আছেন বসিয়া।
পুত্র আগে করি তথা উত্তরিল গিয়া।।
রাজারে চাহিয়া শকুন্তলা কহে বাণী।
এই পুত্র তোমার, দেখহ নৃপমণি।।
পূর্ব্বের প্রতিজ্ঞা রাজা করহ স্মরণ।
তপোবনে গিয়াছিলে মৃগয়া কারণ।।
আপনার সত্য রাজা করহ পালন।
পুত্রে কোলে করি রাজা তোষ মম মন।।
শুনি সভাসদ-লোক বিস্ময় অন্তর।
হাসিয়া দুষ্মন্ত রাজা করিল উত্তর।।
কোথাকার তপস্বিনী কাহার নন্দিনী।
কোনকালে পরিচয় আমি নাহি জানি।।
এত শুনি শকুন্তলা হইলা লজ্জিত।
ক্রোধেতে অধর ওষ্ঠ সঘনে কম্পিত।।
পুনঃ ক্রোধ সম্বরিয়া বলে শকুন্তলা।
পূর্ব্বসত্য পাসরিলা রাজভোগে ভোলা।।
কি বাক্য বলিলা রাজা, নাহি ধর্ম্ম ভয়।
তুমি হেন মিথ্যা বল, উচিত না হয়।।
দৈবে সেই সব কথা কেহ নাহি জানে।
আপনি ভাবিয়া রাজা দেখ মনে মনে।।
জানিয়া শুনিয়া মিথ্যা কহে যেই জন।
সহস্র বৎসর হয় নরকে গমন।।
লুকাইয়া যেই জন করে পাপ কর্ম্ম।
লোকে না জানিল কিন্তু জানিল যে ধর্ম্ম।।
চন্দ্র সূর্য্য বায়ু অগ্নি মহী আর জল।
আকাশ শমন ধর্ম্ম জানয়ে সকল।।
দিবা রাত্রি সন্ধ্যা প্রাতঃ বালবৃদ্ধ জানে।
ধর্ম্মাধর্ম্ম ফল তারে দেয় ত শমনে।।
মিথ্যা হেন বল রাজা, কভু ভাল নহে।
মিথ্যা হেন পাপ নাহি, সর্ব্বশাস্ত্রে কহে।।
পতিব্রতা নারী আমি, না কর হেলন।
আমারে নীচের প্রায় না ভাব রাজন।।
পুত্ররূপে জন্মে পিতা ভার্য্যার উদরে।
শাস্ত্রেতে প্রমাণ আছে জানে চরাচরে।।
সে কারণে ভার্য্যারে জননী সমা দেখি।
করিলা বিস্তর দোষ আমারে উপেক্ষি।।
অর্দ্ধেক শরীর ভার্য্যা, সর্ব্ব শাস্ত্রে লেখে।
ভার্য্যা সম বন্ধু রাজা নাহি কোন লোকে।।
পরম সহায় হয় পতিব্রতা নারী।
যাহার সহায়ে রাজা সর্ব্ব ধর্ম্ম করি।।
ভার্য্যা বিনা গৃহ শূন্য অরণ্যের প্রায়।
বনে ভার্য্যা সঙ্গে থাকে গৃহস্থ বলায়।।
ভার্য্যাহীন লোকে কেহ না করে বিশ্বাস।
সর্ব্বদা দুঃখিত সেই সর্ব্বদা উদাস।।
ভার্য্যাবন্ত লোক ইহকাল বঞ্চে সুখে।
মরণে সংহতি হৈয়া তারে পরলোকে।।
স্বামীর জীবনে ভার্য্যা আগে যদি মরে।
পথ চাহি থাকে ভার্য্যা স্বামী অনুসারে।।
মরিলে স্বামীরে উদ্ধারিয়া লয় স্বর্গে।
হেন নীতিশাস্ত্র রাজা কহে সুরবর্গে।।
ভার্য্যা বিনা পুত্র করে কাহার শকতি।
দেব ঋষি মুনি আদি যত মহামতি।।
পুত্রের সমান রাজা নাহিক সংসারে।
জন্মমাত্র মুখ দেখি পিতামাতা তরে।।
পিণ্ডদান পুত্র তার করয়ে উদ্ধার।
হেন নীতি কহে রাজা বেদেতে প্রচার।।
চতুষ্পদে গাভী শ্রেষ্ঠ, দ্বিপদে ব্রাহ্মণে।
অধ্যায়নে গুরু শ্রেষ্ঠ, পুত্র আলিঙ্গনে।।
ধূলায় ধূসর পুত্রে করি আলিঙ্গন।
হৃদয়ের সর্ব্বদুঃখ হয় ত খণ্ডন।।
হেন পুত্র দাঁড়াইয়া তোমার সম্মুখে।
আলিঙ্গন করে রাজা পরম কৌতুকে।।
অবজ্ঞা না কর রাজা, নীচ পুত্র নহে।
ইহার মহিমা যত মুনিগণ কহে।।
শত শত করিবেক অশ্বমেধ যাগ।
সসাগরা ধরার লইবে রাজ্যভাগ।।
উজ্জ্বল করিবে বংশ এই ত নন্দন।
প্রত্যক্ষে দেখহ রাজা দ্বিতীয় তপন।।
পিতার হতাশে পুত্র সদা ভাবে দুখ।
সে কারণে দেখিতে আইল তব মুখ।।
আলিঙ্গন দিয়া তোষ আপন কুমারে।
দুঃখ নাহি ত্যজ কিবা রাখহ আমারে।।
বিশ্বামিত্র পিতা মোর, মেনকা জননী।
প্রসবিয়া বনে গেল থুয়ে একাকিনী।।
জননী ত্যজিল পূর্ব্বে, তুমি ত্যজ এবে।
তোমারে বলিব কি মরিব এই ভেবে।।
নিশ্চয় মরিব আমি, নাহি তাহে দুঃখ।
এ পুত্র বিচ্ছেদে মোর বিদরিছে বুক।।
শকুন্তলা এত যদি বিনয় করির।
শুনিয়া নৃপতি তবে প্রত্যুত্তর দিল।।
অকারণে পুনঃ পুনঃ কহ কি আমারে।
তোমার বচন শুনি কেবা শ্রদ্ধা করে।।
তোমার জনক যদি বিশ্বামিত্র মুনি।
মেনকা অপ্সরী হয় তোমার জননী।।
বিশ্বামিত্র লোভী বলি জানে ত্রিজগতে।
জন্মিয়া ক্ষত্রিয়কুলে গেল বিপ্র-পথে।।
মেনকা কেমন নারী কেবা নাহি জানে।
মায়ের প্রকৃতি তোর খণ্ডিবে কেমনে।।
নিশ্চয় মায়ের মত তোমার প্রকৃতি।
এই পুত্র সেই মত, লয় মোর মতি।।
মিথ্যা প্রবঞ্চনা করি প্রতার আমারে।
যাহ কিম্বা থাক, কেহ না জিজ্ঞাসে তোরে।।
শকুন্তলা কহে, রাজা কহ বিপরীত।
দেবলোকে নিন্দা কর, নহে ত ‍উচিত।।
মেনকা অপ্সরা, তারে পূজে দেবগণে।
বিশ্বামিত্র মহাঋষি, কেবা নাহি জানে।।
তোমায় আমায় রাজা অনেক অন্তর।
সুমেরু সরিষা হতে যত বৃহত্তর।।
মম মাতা স্বর্গবাসী, তুমি বৈস ক্ষিতি।
স্বর্গে মর্ত্ত্যে সমতুল কর নরপতি।।
আমার দেখহ শক্তি আপন নয়নে।
এখনি যাইতে পারি যথা ইচ্ছা মনে।।
ইন্দ্র যম কুবের ভুবন আদি করি।
মুহূর্ত্তেকে চরাচর ভ্রমিবারে পারি।।
যত নিন্দা কর, সহি স্বামীর কারণে।
আপনা না জান, নিন্দা কর অন্য জনে।।
কুরূপ মনুষ্য রাজা নিন্দে সর্ব্বলোকে।
যতক্ষণ দর্পণে না নিজ মুখ দেখে।।
সত্য সম পুণ্য রাজা নাহিক তুলনা।
মিথ্যা হেন পাপ নাহি কহে মুনি জনা।।
হেন মিথ্যাবাদী তুমি হইলে নিশ্চয়।
তোমার এখানে থাকা উচিত না হয়।।
এত বলি শকুন্তলা চলিল সত্বর।
হেনকালে শব্দ হয় আকাশ উপর।।
সত্য কথা সকলি কহিল শকুন্তলা।
শকুন্তলা বাক্য রাজা না করিও হেলা।।
সতী পতিব্রতা এই তোমার ক্ষমিল।
শকুন্তলা-ক্রোধে তব নাহি হৈবে ভাল।।
বংশের তিলক রাজা এই যে নন্দন।
আমার বচনে কর রক্ষণ ভরণ।।
ভরত বলিয়া নাম রাখহ ইহার।
ইহা হৈতে বংশোজ্জ্বল হইবে তোমার।।
দুষ্মন্ত নৃপতি শুনে মন্ত্রী পুরোহিত।
এতেক আকাশবাণী হৈল আচম্বিত।।
রাজা বলে, মন্ত্রিগণ করিলা শ্রবণ।
সকলি ত জানি আমি, নহি বিস্মরণ।।
জানিয়া না জানি আমি, লোকাচারে ডরি।
লোকে বলিবেক এই লোকাচারে ডরি।
লোকে বলিবেক এই কোথাকার নারী।।
এ কারণে আমি ভাণ্ডিলাম মন্ত্রিগণে।
বেশ্যা বলি ইহারে জানিল সর্ব্বজনে।।
এত বলি শীঘ্র উঠি দুষ্মন্ত রাজন।
শকুন্তলা হস্তে ধরি ফিরান তখন।।
মহানন্দে নরপতি পুত্র লৈল কোলে।
শত শত চুম্ব দিল বদন কমলে।।
শকুন্তলায় করিল রাজ-পাটেশ্বরী।
পরম কৌতুকে চিরদিন রাজ্য করি।।
কতদিনে বৃদ্ধকালে দুষ্মন্ত রাজন।
ভরতের রাজ্যে দিয়া গেল তপোবন।।
পৃথিবীতে মহারাজ হইল ভরত।
অশ্বমেধ যজ্ঞ আদি করে শত শত।।
লক্ষ পদ্ম সুবর্ণ ব্রাহ্মণে দিল দান।
দাতা যে নাহিক কেহ ভরত সমান।।
সসাগরা পৃথিবী শাসিল ভুজবলে।
অদ্যাপি ভারতভূমি ঘোষে ভূমণ্ডলে।।
তাঁর বংশে যতজন হইল নরপতি।
ভরতের বংশ বলি পাইল সুখ্যাতি।।
ভরতের উপাখ্যান যেই নর শুনে।
আয়ুর্যশ-পুণ্য তার বাড়ে দিনে দিনে।।
আদিপর্ব্ব ভারত রচিল বেদব্যাস।
পাঁচালী প্রবন্ধে কহে কাশীরাম দাস।।